শিল্প সাহিত্য

আমাদের সন্তান ও আমরা’

– কাওসার পারভীন

কাওসার পারভীন

বিশ্বায়নের ভালো দিক রয়েছে, আবার অনিশ্চয়তার প্রচ্ছন্ন একটা দোলাচলেও ভুগছে সন্তানেরা । অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আর ডিগ্রীর পর একটা কাংখিত জীবিকার ব্যবস্থা অনেকক্ষেত্রে সময় অনুযায়ী হচ্ছে না। তবে, হাল ছাড়া চলবে না । আমাদের অভিজ্ঞতা, বাস্তব বিষয়জ্ঞান ছেলেমেয়েদের কাছে খুলে বলার অভ্যাস সহায়ক হতে পারে। জটিল অবস্থা, অবিবেচনা-প্রসূত বিপদ, স্বপ্নভঙ্গের মতো বিষয়গুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করার সঠিক দিক নির্দেশনা তারা যাতে পায় সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে । কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই । নিবেদিত হয়ে জ্ঞানার্জন, পাঠ্যসূচির বাইরে বিবিধ বিষয়ে পড়ার অভ্যেস, আত্মবিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, শরীরচর্চা-স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রচেষ্টা – সব মিলিয়ে নিয়মতান্ত্রিক অভ্যাস গড়তে হবে। গৃহে-স্কুলে বা যে কোন স্থানে সহমর্মিতা বোধ, সে অনুযায়ী ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ, যা বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ছোটবেলা থেকে সন্তানকে শেখানো উচিত । ওদেরকে বয়স আর অবসর অনুপাতে আমাদের কাজে সম্পৃক্ত করার সুফলও অনেক।

কৃতজ্ঞ বোধ করা এবং অকুন্ঠভাবে তা প্রকাশ করা ব্যবহারের অংশ হতে হবে । মানুষকে শুধু ‘মানুষ’ হবার জন্যই সম্মান করা, কৃতজ্ঞ হওয়া, বিনয়ী থাকা অভ্যাস করতে হবে । বন্ধু নির্বাচনে সময় দিতে হবে, অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হওয়ার আগে নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে – ধীরে বুঝে-শুনে এগোতে হবে । চর্চা/জা’জমেন্টে না-যেতে পারলে স্রষ্টার দয়া আর মানুষের মায়া মিলবে । জেদ ধ্বংস আনে – এটা বাদ দেয়ার জন্য বোধের গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন । মানুষ এবং ঘটনা অস্থায়ী, তাই ‘পেতেই হবে’ ধরণের জেদ কল্যাণকর না । একটি ক্ষণ, একটি দিন বা রাত জীবনে আর কোনদিন ফিরবে না। সময় অমূল্য ! সময়কে একটু গড়াতে দিলেই, নৈঃশব্দে সে অনেকদূর এগিয়ে যাবে । প্রকৃতির মায়ার স্পর্শ পাওয়ার চেষ্টা দরকার – জীবনকে, পথ চলাকে, মানুষকে বুঝতে সহজ হয় তাতে। সময়ের সাথে প্রতিদিন আমরা বদলাচ্ছি, কৈশোর তারুণ্যে এটা আরও বেশী প্রকট । পেশা, সখ, প্রেম, বন্ধুত্ব – প্রতিটা বিষয়ে স্থিরতা আর সহনশীলতা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন । তাৎক্ষণিক মোহ তাড়িত সিদ্ধান্ত বিপদ ডেকে আনতে পারে । বন্ধুর নামে বিপদ, অনলাইনে ব্ল্যাকমেইল, যে কোন দিক থেকে এই দানবীয় বিপদ আসতে পরে – একটা আলোচনা মঞ্চের বাইরে অনলাইন যোগযোগকে ঠাঁই না-দিলেই মঙ্গল ।
 
বস্তুবাদ আর ভোগের বিভ্রান্ত চটুল জগতের ফাঁদ চারপাশে । সৃষ্টিকর্তার কাছে নিবেদন প্রশান্তি এনে দেয় । রাগ বহন করে না-বেড়ানো আর যে বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক জটিল মনে হয় সম্মান এবং সুন্দর ভাবনা নিয়ে শান্তিপূর্ণ ইতি টানা শ্রেয় – এটা তাদের বোঝাতে হবে । সময়ের সাথে সাথে বিষাদের রঙ হালকা হয় আর মানুষ নূতন পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয় । ফ্যান্টাসীর পর্যায়ে ‘না হলেই নয়’ ধরণের ভাবনাটা ধোঁয়াশা। মানুষের যোগ্যতা অসীম। সন্তান আর বাবা-মা দু’পক্ষই খোলা আলোচনা বা লিখে জানানোর একটা অভ্যাস তৈরী উপকারে আসে । সন্তান আর জনক-জননীর সম্পর্ক পৃথিবীর বাকি যে কোন সম্পর্কের চেয়ে আলাদা, অটুট আর অকপট, অধিকার বা ভার অর্পণের সে স্থান অন্য কোথাও নেই – কোন পক্ষেরই এটা ভোলা ঠিক না।
পড়ালেখার শেষ প্রান্তে যাবার আগেই ছোট উদ্যোক্তা, সৃজনশীল কাজ, কৃষিনির্ভর কাজ, কোন বিশেষ দক্ষতা থাকলে সে বিষয়ে নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষকতা/স্পীকার হওয়ার চেষ্টা করা যায় । সনদ লাভ দরকারী । অভিজ্ঞতা, আত্মবিশ্বাস আর কর্মদক্ষতা একই সাথে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । নিজের দায়িত্ব নেয়া, এরপর পরিবার আর সমাজের দায়িত্বপালনের বড় স্বপ্ন আর প্রচেষ্টা নিয়ে পরিশ্রম করতে হবে । সে লক্ষ্যে মানসিক আর শারিরীক স্বাস্থ্য রক্ষা আর আধ্যাত্মিকতার চর্চা অপরিহার্য্য । মন্দ কেউ যতো মন্দই হোক্, নিজেকে রক্ষা করতে শেখা এবং ঘৃণা না-করে অকল্যাণের ছোঁয়া থেকে নিজেকে পৃথক করতে পারার বুদ্ধিমত্তা, উদারতা আর ন্যায্য কৌশল শিখতে হবে । দাম্ভিকতা, রুক্ষ আচরণ, পরচর্চা জাতীয় ক্ষতিকর বিষয় সব অর্জন নষ্ট করতে পারে । সত্যবাদী হওয়া, প্রতিজ্ঞার মূল্য দেয়া, আচরণে ভদ্র, মতবাদ/গোষ্ঠির উর্দ্ধে থেকে মানুষকে সম্মান করা, ইতর ভাষা বর্জন, পক্ষপাতদুষ্ট না-থাকা – অর্থাৎ ব্যক্তিত্ববান, বিশ্বস্ত, মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে সন্তানদের অবশ্যই অনুপ্রাণিত করতে হবে ।
 
যাঁরা প্রজ্ঞায়, উৎকর্ষে শীর্ষে আছেন তরুণদের পথ দেখানোর জন্য তাঁদের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা আর সুচিন্তিত দিক নির্দেশনা তরুণদের অনেক সাহায্য করবে ।
 
প্রকৃতির অন্বেষণ, সংষ্কৃতি-সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গণের সাথে সম্পৃক্ততা আর সমাজ হিতৈষী কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত রাখার চেষ্টা সন্তানদের থাকতে হবে, আর এ বিষয়ে অভিভাবক-বিদ্যাপীঠ দু’দিক থেকেই সহযোগিতা থাকবে । বহুমাত্রিক আচরণে মানুষ অভ্যস্ত হচ্ছে, অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হচ্ছে । তবে কোন্ অংশ, কোন্ সংস্কৃতি, কোন্ দিক্ – কী যে কাকে কতোটা টানছে, কে কতো পরিমাণ নিজের-ও-অন্যের সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করবে তার সীমারেখা জটিলতম । মানুষ পরিবর্তিত হতে থাকে – যদিও, এক একজনের পারিপার্শ্বিকতা-ভাবনা-কাল একেক রকম – প্রত্যেকে নিজ অবস্থান থেকে বদলাচ্ছেন । পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী, পড়শী, দোকানী থেকে অসংখ্য সম্পর্কের অগুণতি স্তর, মানুষের সামাজিক দায়িত্বের সাথে সম্পর্ক রয়েছে – ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করতে হয় নিত্যদিনের-বাঁধা-সময় । সবার বোধের বিস্তার এক না ! সম্পর্ক ভয় বা হাহাকারের মধ্যে পড়ছে । ‘সম্পর্কের ভেতর সম্পর্কে’র প্রকৃতিপ্রদত্ত সহজাত অনুপ্রবেশ ও সম্পর্কের পরিবর্তিত সহজাত প্রকারভেদ অসংখ্য । মূর্তমান বাস্তবতা নিয়েও মানুষ নিরাশায় ডুবে যায় – এর মাঝে বেশীরভাগ কোন অসৎ উদ্দেশ্য ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত না । সুর কেটে যাচ্ছে, মিল খুঁজে পাচ্ছে না, বিষাদ আক্রমণ করছে – ‘কি করলাম, কেন পারলাম না, কেন হেরে গেলাম’ – ভাবতে ভাবতে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকতে হয় কখনও । ভ্রান্তি-রিপুর ব্যাপার ছাড়াও বুদ্ধিমত্তা, জীবনদর্শন, পরিপ্রেক্ষিত, দৃষ্টিভঙ্গী সহ কতো সহস্র বিষয়ে মানুষ একে অন্যের চেয়ে আলাদা । মানবিক সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা ছাড়া মানুষ জন্মায় না ! কারুর খুব সখের বিষয়ে দেখা গেলো অন্যজনের হয়তো তাতে ‘ফোবিয়া’ – সমন্বয় কষ্টকর ! মনোজগত মহাসাগরের মতো বিস্তৃত । ‘সম্পর্ক’ ছকে বাঁধা বিষয় না, প্রতিটিই তার নিজের মতো করেই ভিন্ন ।
 
পরিবারে বড়-ছোট সবার ন্যায্যভাবে মর্যাদা সুনিশ্চিত হওয়া এবং সদস্যদের দায়িত্ব, সময়, শ্রম, ব্যবস্থাপনা, মেধা সব বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব বন্টন ও ছোট সদস্যকেও কিছু কাজে যুক্ত করা এবং সব সদস্যের বিমূর্ত-মূর্ত বিষয়কে শ্রদ্ধা করার রীতি নিশ্চিত করা কাংখিত । সম্পর্ক মায়ায় বাঁধা থাকলে, বিশ্বে শান্তি থাকবে ! অর্থ বা জাগতিক অর্জন যতো কম-বেশী হোক্ আত্মজ-আত্মজার সাথে জনক-জননীর সম্পর্ক সবসময় অমূল্যজীর্ণ শনের ছাউনীতে বা শ্বেতপাথরের দালানে এ ঐশ্বর্য্য একই ! সম্পর্কের ছোট বড় ক্ষণগুলো আর ছোট্ট ছোট্ট প্রচেষ্টা মনি-মুক্তো হয়ে থাকুক্ সবার জীবনে !!