শিল্প সাহিত্য

ছিন্নমূলের মর্মবেদনা: “কালো বরফ” উপন্যাসের আলোকে

-অর্ণব ভট্টাচার্য

অর্ণব ভট্টাচার্য

জাতিরাষ্ট্রের সৃষ্টি অনিবার্য ভাবেই উদ্বাস্তুর জন্ম দেয়। ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হল তখন  সীমান্তের দুপারে অসংখ্য মানুষ এক লহমায় নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেলেন। নতুন রাষ্ট্রে তাদের অবস্থান কি হবে, নাগরিক হিসেবে আদৌ তাদের অধিকার কতটা সুরক্ষিত থাকবে এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা এবং তার সাথে বিভিন্ন জায়গায় যে শারীরিক ও মানসিক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছিল তারই ফলস্বরূপ সীমান্ত পেরিয়ে নিরাপত্তার খোঁজে নিজেদের সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে দলে দলে মানুষ পাড়ি দিয়েছিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত যাদের অস্তিত্বকে  সংকটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো সেই ছিন্নমূল মানুষের মর্ম যন্ত্রণা ও জীবন সংগ্রাম নিয়ে যে সমস্ত আখ্যান বাংলায় রচিত হয়েছে তা মূলতঃ পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দেওয়া হিন্দু ধর্মাবলম্বী উদ্বাস্তুদের যন্ত্রণাদীর্ণ জীবনকাহিনী কেন্দ্রিক। দাঙ্গা ও দেশভাগের ফলে যে লক্ষ লক্ষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ পশ্চিমবাংলা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন এবং পূর্ববঙ্গে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তাদের বেদনার কথা বহুলাংশেই অনুল্লেখিত থেকে গিয়েছে।

 অনেকেই একথা মনে করেছেন যে যেহেতু মুসলমান সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরাসরি পাকিস্তান আন্দোলনের অংশীদার ছিলেন এবং দেশভাগ তাদের কাছে কাম্য ছিল তাই মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত বাস্তুহারা মানুষ দেশভাগের যন্ত্রণাকে উপলব্ধির মধ্যে আনেননি। বরং নতুন দেশের বাসিন্দা হওয়ার আনন্দ তাদের মধ্যে অধিক মাত্রায় ক্রিয়াশীল ছিল। এই ধরনের একটি ধারণা অতিমাত্রায় সরলীকরণ বলেই মনে হয়। মানুষের শিকড় থাকে তার পরিবার ও পরিবেশের মধ্যে। স্বাভাবিক ভাবেই যখন সেই পরিবেশ থেকে তাকে উৎখাত হয়ে যেতে হয় পরিস্থিতির চাপে তখন সেই বেদনা সে সারাজীবন বহন করবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে প্রক্রিয়ায় ভারত এবং পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের সব মানুষকে বিচ্ছিন্নতাকামী বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ মুসলমান উদ্বাস্তুদের বাসভূমি হারানোর যন্ত্রণাকে কার্যত স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে মুসলমান বাস্তুহারাদের যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ভিত্তির কাছে বিপদস্বরূপ। তাছাড়া পূর্ববঙ্গে ১৯৫২ সাল থেকেই যে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিসত্তা বিকশিত হয়ে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয় সেই দীর্ঘ দুই দশকের ঘটনাবহুল রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে মুসলমান উদ্বাস্তুর বাস্তুত্যাগের যন্ত্রনা তেমন ভাবে ফুটে ওঠার সুযোগ পায়নি। তবে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক তার “কালো বরফ” উপন্যাসে দেশভাগের এই অনালোচিত অধ্যায়কে তুলে ধরেছেন।উপন্যাসের কল্পজগৎ বাস্তব জীবনের বহুস্তরীয় অভিজ্ঞতাকে যেভাবে ধারণ করেছে তা কেবল সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়,সমাজতাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মনোযোগ আকর্ষণ করে।এই নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়া এক মুসলমান পরিবারের যন্ত্রণার কাহিনী। বিষয়বস্তুর নিরিখে এবং উপস্থাপনার অভিনবত্বে এই উপন্যাসটি বিশিষ্টতার দাবীদার।

মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮) এর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতের কাজীপাড়ায়। ‘কালো বরফ’ এর রচনাকাল ১৯৭৭, কিন্তু প্রকাশকাল ১৯৯২। উপন্যাসটি বাংলা ভাষায় লেখা একটি ব্যতিক্রমী আত্মজৈবনিক রচনা।দেশভাগের পটভূমিতে লেখা “কালো বরফ’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবদুল খালেকের সত্তার সাথে শেকড় হারানোর স্মৃতি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। শৈশবের যে চেনা ভুবন দেশভাগের প্রবল অভিঘাতে হারিয়ে গেছে তার স্মৃতির ভেতরে ডুব দিয়ে আত্ম অনুসন্ধান করতে থাকেন উপন্যাসের নায়ক।দেশভাগ তাকে নানা দিক দিয়ে রিক্ত করেছে। হারিয়ে গেছে চেনা পুকুরপার,খেলার মাঠ,পেয়ারাবাগান,স্কুলবাড়ি।হারিয়ে গেছে সেই তুলি পাখি, পাঁচুর দেওয়া কাঁচের চুড়ির শেকল, ঝুমির দেওয়া তেশিরা কাঁচ। শৈশবের সেই দিনগুলো তার যাবতীয় মায়াময়তা নিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছে অধ্যাপক আব্দুল খালেকের স্মৃতিকে। আর্থিক অনিশ্চয়তা আর আগ্রাসী বিপন্নতার বোধের মাঝে এই স্মৃতি তার আশ্রয়স্থল।

উপন্যাসের নায়কের ছেলেবেলা কেটেছে এক মিশ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। সেখানে কেনারাম কাকা,নগেন স্যাঁকরা,মাধু,গিরিবালারা তাদের আপনার জন। রাণীবুবুর বন্ধু ছবিদিরা সেখানে অক্লেশে মেশে মণিভাইজানের সাথে।হৃদয়ের বিনিময় হয়। দেশভাগ এই সমস্ত বিনি সুতোর বাঁধন কে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া আব্দুল খালেক (কাহিনীর পোকাবাবু) দেশভাগের বেদনাময় স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকলেও তার দাদা মণি ভাইজান এই বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারেনি। তার সত্তার গহনে এই সব ছেড়ে চলে আসা এমন এক শূন্যতার সৃষ্টি করে যেখান থেকে বেরোনোর আর কোন পথ খুঁজে পায়না মনি ভাইজান। সে আত্মহত্যা করে। আর শুধুই কি খালেক বা তার দাদা, তাদের মাও “ভেতর থেকে ভাঙা,যথাসর্বস্ব খোয়ানো” এক মানুষ।জীবনের এমন করুণ অপচয় দেশভাগের বেদনাময় উত্তরাধিকার।

দেশভাগের পর আব্দুল খালেকের বিপন্নতা আরও গভীর হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির সুবাদে যেখানে নানা চোরাগোপ্তা পথে ক্ষমতা দখলের  লড়াই চলে। কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ থাকেনা। গরিব ছেলে মেয়েদের শিক্ষার থেকে সেখানে যেনতেন প্রকারেণ দু’পয়সা কামিয়ে নেওয়াই বেশি কাঙ্খিত। এই অনৈতিক পরিবেশে কলেজের অধ্যাপক আব্দুল খালেক যে বিপন্ন বোধ করবেন তাতো স্বাভাবিক।নরহরি ডাক্তারের সাথে গল্প করে খানিকটা মানসিকভাবে হাল্কা হওয়ার চেষ্টা করেন। আর্থিক অনিশ্চয়তা মানিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু যেখানে চিন্তার দৈন্য, চরিত্রের স্খলন,নৈতিক অধঃপতন ঘটছে অহরহ সেখানে  জীবনকেই অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হতে থাকে। এক সুগভীর বিচ্ছিন্নতার বোধ আচ্ছন্ন করে খালেকের সত্তাকে।কেবল মনে হয় ভালবাসার বন্ধনে তাকে বেঁধে রাখবার মত কাউকে বড় প্রয়োজন।স্ত্রী রেখাও যেন সেই অভাব পূরণ করতে পারেনা।এই বিচ্ছিন্নতা আর প্রেমহীন নিঃসঙ্গতা উদ্বাস্তু জীবনকে বারেবারে ক্ষতবিক্ষত করে।জন্মস্থান ছেড়ে আসার সময় “সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেল সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগলো না।আর কখনো জোড়া লাগবে না”। ছিন্নমূল মানুষের জীবনের এ এক গভীর সত্য যাকে কোনো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা দিয়ে চেপে রাখা যায়না যদিও তার চেষ্টা চলতে থাকে অবিরত।

দেশভাগ সব অর্থে ছিল এক সুবিপুল মানবিক বিপর্যয়। আব্দুল খালেকের মত অগণিত মানুষ দেশ ভাগের মধ্যে কোন যৌক্তিকতা খুঁজে  না পেলেও এই বাস্তবতাকে অসহায় ভাবে মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোন পথ খোলা ছিলনা। কিন্তু রাজনীতির যুক্তি মানুষের মনের গতিপ্রকৃতি কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।এমনকি ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে হিজরতের উদাহরণকেও তার তেমন জোরালো মনে হয়না।কার্যতঃ পরিস্থিতির চাপে,প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে,সহৃদয় প্রতিবেশীদের সহযোগীতা ও পরামর্শে বাস্তুভিটা ছাড়তে হয়। তাই আব্দুল খালেকের মতো সংবেদনশীল মানুষরা চিরকাল অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হন। স্মৃতিমেদুর হয়ে জীবনের ভগ্নস্তূপে স্পন্দন আনার করুণ চেষ্টা করে চলেন।এই কষ্টের সাহিত্যরূপ অনবদ্য ভঙ্গীমায় ফুটে উঠেছে ‘কালো বরফ’ উপন্যাসে।উদ্বাস্তুজীবনের অসহায়তার যে মর্মস্পর্শী ছবি এখানে আঁকা হয়েছে তা ধর্মাশ্রয়ী জাতিরাষ্ট্রের বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করে এক সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে।ধর্মীয় পরিচিতির দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র নির্মাণের এই প্রক্রিয়ায় মানুষকে এক ছাঁচে ঢালবার ধ্বংসাত্মক পরিণতি আমাদের বিষণ্ণ করে। লেখক এই  উপন্যাসে পাঠককে নিয়ে যান ছিন্নমূল মানুষের সত্তার সেই অন্তর্লোকে যেখানে কাঁটাতার মানচিত্রকে দ্বিখণ্ডিত করলেও মানুষকে তার অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনা।দুঃখের বিষয় উপমহাদেশে আমরা এখনো ধর্ম আর রাজনীতির ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভাষ্যের বদলে এই মানবিক বয়ানকে প্রাধান্য দিতে পারলামনা। ছিন্নমূলের মর্মবেদনা তাই কোথাও ধামাচাপা পড়ে যায়,কোথাও ক্ষমতার পাশাখেলার ঘুঁটি হয়ে ওঠে।

ড. অর্ণব ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক