চলমান সংবাদ

অন্যের হয়ে তিন বছর কারাভোগ শেষে মুক্তির মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সেই মিনুর চির মুক্তি

৫ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে অভাব-অনটনের অথৈ সাগরে পড়েন মিনু আক্তার। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে পারতেন না তিনি। বাধ্য হয়ে সন্তানদের ভরণ-পোষণের আশ্বাস পেয়ে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির পরিবর্তে কারাগারে যান মিনু। তিনটি বছর মিনু আক্তার কাটিয়েছিলেন কারাগারের অন্ধ প্রোকষ্টে। কিন্তু আশ্বাসের টাকা বা সন্তানের খাবার, কিচ্ছু জোটেনি। অন্যের হয়ে কারা ভোগের বিষয়টি জানানানি হওয়ার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু আক্তার। প্রতারণার শিকার হয়ে মিথ্যা আশ্বাসে অন্যের হয়ে তিন বছর জেল খাটা সেই মিনু আক্তার কারামুক্তির ১৩ দিনের মাথায় ‘ট্রাকচাপায়’ মারা গেছেন। সন্তাদের কাছে যাওয়ার প্রবল আকুতি নিয়ে কারাগার থেকে মিনু মুক্তি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু মুক্ত হওয়ার পর সবচেয়ে ছোট কন্যা সন্তানটির মৃত্যুর খবর সইতে না পেরে মিনু এবার যেন চিরতরেই মুক্ত হলেন। পুলিশ জানায়, গত ২৮ জুন রাত সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোডে ট্রাক চাপায় এক নারীর মৃত্যুর পর পরিচয় শনাক্ত করতে না পেরে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ দাফন করে। গত শনিবার (৩ জুলাই) রাতে পুলিশ নিশ্চিত হয়, নিহত ওই নারী ছিলেন মিনু আক্তার। পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলের সেই রাতের সিসিটিভি ভিডিও তারা খতিয়ে দেখছে। সেখানে রাস্তায় মিনুকে ‘অস্বাভাবিকভাবে’ হাঁটতে দেখা যায়। ট্রাকের নিচে চাপা পড়ার আগে সড়কে দায়িত্বরত টহল পুলিশের সদস্যরা তাকে দুইবার সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ ও মিনুর পরিবার সূত্রে জানা যায়, মিনুর বাড়ি কুমিল্লার ময়নামতি এলাকায়। স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল ৫ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর থেকে সীতাকুন্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন মিনু। বিধবা মিনুর আয় ছিল না, অভাব-অনটনের সংসার। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে মিনু কখনো ভিক্ষা করতেন, আবার কখনো মানুষের বাসায় কাজ করতেন। সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া এবং আর্থিক কিছু সহায়তার প্রতিশ্রুতিতে কুলসুমা আক্তার নামের এক নারীর কাছ থেকে বদলি জেল খাটার প্রস্তাব পেয়ে রাজি হন তিনি । ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে এক নারীকে হত্যার দায়ে ২০১৭ সালে কুলসুমা আক্তারকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আদালত। রায়ের সময় তিনি ছিলেন পলাতক। পরে ২০১৮ সালের জুনে কুলসুমা আক্তার সেজে মিনু আক্তার স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু মিনু কারাগারে যাওয়ার পর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন কুলসুমা। আশ্বাসের টাকা বা সন্তানের খাবার, কিচ্ছু জোটেনি। প্রায় তিন বছর কারাগারে থাকার পর চলতি বছরের ১৮ মার্চ কারা কর্তৃপক্ষকে মিনু আক্তার জানান, তিনি কোনো মামলার আসামি নন। তার নাম কুলসুমাও নয়। চলতি বছরের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পক্ষ থেকে আদালতে একটি আবেদন করা হয়। এই আবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে কারাগারে পাঠানো আসামির সঙ্গে প্রকৃত আসামির মিল নেই। এছাড়া কারা রেজিস্ট্রারে থাকা দুজনের ছবির মিল নেই। কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিষয়টি জানার পর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ গত মার্চে মামলার নথিপত্র উচ্চ আদালতে পাঠান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য। উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু আক্তার। যাদের কারণে ৩ বছর জেলে থাকতে হয়েছে, কারাগার থেকে বের হয়ে তাদের বিচারও দাবি করেছিলেন মিনু আক্তার। মিনু আক্তার জেলে যাওয়ার পর তার দুই ছেলে ইয়াছিন ও গোলাপ ছলিমপুরের একটি মাদ্রাসায় ছিল। আর সবার ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে লালন পালন করতেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। গত এপ্রিলে রোজার মধ্যে মেয়েটির মৃত্যু হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর মেয়ের মৃত্যুর খবর পান মিনু। মুক্তি পাওয়ার পর ছেলেদের নিয়ে মিনু তার ভাই রুবেল হোসেনের বাসাতেই ছিলেন। রুবেল জানান, মেয়ের মৃত্যু মিনু কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না, খুব কান্নাকাটি করতেন। গত ২৮ জুন সকালে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। পরের দুদিন তাকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও পাননি। এখন পিতা-মাতাহারা মিনুর দুই সন্তানকে রুবেলই দেখাশুনা করবেন বলে জানান। বর্তমানে মিনুর এক সন্তান গোলাপ (৭) সীতাকুন্ডের জাফরাবাদ ইমাম হোসাইন হাকিমিয়া লোকমানিয়া সুন্নিয়া হেফজখানা ও এতিমখানায় পড়াশোনা করে। বড় সন্তান ইয়াছিন (১০) একটি চায়ের দোকানে কাজ করে। বায়েজিদ থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বলেন, ২৮ জুন রাতে বায়েজিদ লিংক রোডে ট্রাক চাপায় আহত হওয়ার পর ভোর ৫টার দিকে মারা যান মিনু। কিন্তু তখন তার পরিচয় জানা যায়নি। আমরা গাড়ির ধাক্কায় নিহত এক অজ্ঞাত নারীর লাশ উদ্ধার করি। হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম অজ্ঞাত লাশ হিসেবে দাফন করে। ওসি বলেন, অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে আমরা আইনী সব পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। শনিবার রাতে সীতাকুন্ডে গিয়ে ছবি দেখালে তার আপন ভাই রুবেল ছবি দেখে মিনুকে শনাক্ত করেন। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ নেওয়া হয়েছে। কোন গাড়ি তাকে চাপা দিয়েছে তা শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ওসি বলেন, ঘটনার রাতে সেখানকার টহল পুলিশ ২-৩ বার উনাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। তারপরও তিনি বারবার লাফিয়ে রাস্তায় নেমে মাতম করছিলেন। উনার হাঁটাচলা স্বাভাবিক ছিল না। এদিকে যার মাধ্যমে মিনু কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, তার আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ মিনুর এই মৃত্যু অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন। মৃত্যুর কারণ জানতে তিনি আদালতের দারস্থ হবেন জানিয়ে গোলাম মাওলা বলেন, তিন বছর জেল খাটার পর মুক্তির অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এভাবে মৃত্যু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমরা আদালতের কাছে আবেদন করব বিষয়টি তদন্তের জন্য। তিনি বলেন, মিনু যখন জেলে যান, তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস তখন কোলের শিশু। গত রোজায় জঙ্গল ছলিমপুরের একটি পাহাড়ে শিশুদের সাথে খেলার সময় উপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় মেয়েটি। মেয়েটিকে একবার জেলখানায় মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিন বছর পর মুক্তি পেয়ে মিনু আর মেয়েকে পায়নি। জানা গেছে, ২০০৬ সালের ৯ জুলাই নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় পোশাককর্মী কোহিনুর আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। প্রথমে আত্মহত্যা বলা হলেও পুলিশি তদন্তে উঠে আসে কোহিনুরকে গলা টিপে হত্যা করে তা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর আত্মহত্যা মামলাটি হত্যা মামলায় রূপ নেয়। মামলার প্রকৃত আসামি কুলসুমা আক্তার মামলার সাজা হওয়ার আগে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। মামলার বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর আসামি কুলসুম আক্তারকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। সাজার পরোয়ানামূলে কুলসুম আক্তারের বদলে মিনু আক্তার ২০১৮ সালের ১২ জুন কারাগারে যান।

# ০৫.০৭.২০২১ চট্টগ্রাম #