শিল্প সাহিত্য

রঙবেরঙ একবিংশ

-হিলাল ফয়েজী

ঠাঁই দেবেন ভাই?
তখন জীবনের মধ্যগগন। তখন বুকের ভিতর দাউ দাউ আগুন। পুড়িয়ে ফেলবো জগতের সব আবর্জনা। বিদ্যমান সামরিক স্বৈরাচারকে উৎখাত করে এগিয়ে যাবো বিশ্ববিপ্লবের অংশ হিসেবে ও হিসাবে এই বাংলাদেশে।
এক এক জনের এক এক অস্ত্র। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি আমার বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখা ‘রঙবেরঙ’ অস্ত্রখানি বের করে দেখালাম। একটি সিরিয়াস বিপ্লবী সংগঠন সিপিবি। তার একটি মোস্ট সিরিয়াস সাপ্তাহিক ‘একতা’। সেখানে ‘লঘু বচনে গুরু ব্যঞ্জনা’ কেউ কেউ পছন্দ করলেন না। কেউ কেউ করলেন। কিন্তু পাঠক ভাই-বোনেরা বাঁচিয়ে দিলেন। পাঠক-প্রিয়তায় টিকে গেলো। তারপর হু হু হু প্রিয়তা বাড়তেই থাকলো। মাদারীপুরের বিপ্লবী সন্তোষদা আমার সঙ্গে প্রথম পরিচিতিতেই আমাকে জড়িয়ে সে কী! এরকম অনেক। বহুকাল পার্টি নেতৃত্বের নেকনজরে ছিলামনা। কেননা রেজিমেন্টেশন সাংগঠনিক বিন্যাস আমার সহেনা। হঠাৎ দেখলাম সিপিবি-র চতুর্থ কংগ্রেসে (১৯৮৬) আমাকে প্রস্তুতি কমিটির প্রচার প্রধান করে দেয়া হলো। জানি ‘রঙবেরঙ’য়ের জনপ্রিয়তার লেবেনচুষ।
অথচ জানি এসব কোন লেখাই নয়। সমরাঙ্গনে শত্রুর প্রতি নিক্ষিপ্ত রদ্দা হাতবোমা মাত্র। সাহিত্যের ব্রহ্মাস্ত্র, সে আমার নয়। অতএব কোনো লেখাই কোনো কিছুই গুছিয়ে জমিয়ে রাখিনি। আমার কোনো লেখায় যদি কোনো বিপ্লবী কর্মী তথা পাঠক এতটুকু উদ্দীপিত হয় সে-ই ছিল আমার পরম আনন্দ।
তারপর পৃথিবীর ‘নবম আশ্চর্য’ ঘটনাটি ঘটে গেলো। আমাদের বিশ্ববিপ্লবের প্রধান দূর্গটি ঝুরঝুর ভেঙে গেলো চোখের পলকে, ঝলকে ঝলকে। একজন গর্বাচেভ আর একজন ইয়েলেৎসিন মিলে ধাক্কা দিলেই যদি বিশাল বিশাল খাম্বার বিশালতর সোভিয়েত কাঠামো ভেঙেচুরে যায়, এমন বয়ানে সন্তুষ্ট হইনি কখনো। ভিত্তিমূলের ভিতরেই জং ধরে ফালা ফালা হয়ে গেছে, আমরা ভক্তরা কখনো বুঝিনি, ফলত আমাদের বাংলাদেশের বিপ্লবী সৌধেও টালমাটাল অবস্থা। সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক অতঃপর দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদকে উত্তরিত হলেন।সেখানে একদিন অবরুদ্ধ হলেন দুর্দান্ত অংশীদার দ্বারা।দলবল নিয়ে দৌড়ে গেলাম তাঁকে বিপন্মুক্ত করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।অতঃপর তাঁর পাশে দাঁড়ালেন নজিরবিহীন এক প্রাণবন্ধু। তিনি সংযোগ ঘটিয়ে দিলেন ব্যবসায়ী-রাজনীতিক এক উদীয়মান চৌধুরীর সাথে। অবশেষে একটি দৈনিকের স্বাধীন ধরণের সম্পাদক হিসেবে সমুজ্জ্বল অবস্থান।পত্রিকাটি পেলো পাঠক প্রিয়তা। ‘রঙবেরঙ’ ভোরের কাগজে প্রবেশাধিকার পেলো। লেখা প্রতি আড়াইশত টাকা। জীবনে লিখে প্রথম আয়। অন্য মহান কলামিয়া(কলামিস্ট)বৃন্দ পেতেন হাজার, কেউ কেউ আরো অনেক। সম্পাদকের অশেষ স্নেহ ছিলো আমার আরেক পরমানন্দ। ১৯৬৫ সালে ওনার হাত ধরেই কমিউনিস্ট সংগঠনের গ্রুপে ঢোকা। একালের ভাষায় তিনি মেন্টর। সেই সুখেই হৃদপিন্ডে টাকডুম টাকডুম ঢোল বেজে চলে বেজায়। সমাজে পরিচিতি জুটলো ওনার ‘চ্যালা’ হিসেবে। ‘চামুন্ডা’ও বলতো কেউ কেউ, ওনার প্রতি ক্ষিপ্তজনেরা।
সাপ্তাহিকে সাফল্য। দৈনিকে সাফল্য। অতঃপর সম্পাদক মহোদয়ের উল্লম্ফন। অনেক স্বপ্ন। উৎপাদন সম্পর্ক-উৎপাদিকার দিল-জ্বালাতন। অতএব সম্পাদক একদিন তার গড়ে তোলা জনপ্রিয় দৈনিকটি থেকে নতুন ভেঞ্চারে উত্তরিত হবার বিদ্রোহী ঘোষণা দিলেন। বললেন তাঁর ভিতর বসবাস করেন একজন আর্নেস্তো, একজন চে গুয়েভারা। সেই বিপ্লবে তিনি ছড়াবেন এই দেশের গণমাধ্যমে অপরূপ পূবাকাশের সূচনা-কিরণ। বেওয়াকুফ আমি। পূর্বতন দৈনিকে আছেন একজন প্রাণবন্ধু। সেখানে লিখছি। হঠাৎ এক প্রিয় মাধ্যমে খবর পেলাম ‘ মেন্টর’ আমাকে ডাক দিয়েছেন। তাঁরই গড়ে তোলা পূর্বতন দৈনিকে যেন আর না লিখি। মেন্টরের ইস্কাটনী বাসায় ইস্কাপনের খেলা। জীবনে প্রথম মেন্টরের কাছে শর্ত পেশ করলাম। এই নব দৈনিক যেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ অবস্থান বজায় রাখে। কোনক্রমেই ছদ্মবেশী আলবদরীয় বিন্যাসে নয়। এবং পত্রিকায় আমার একটি সুস্পষ্ট কেন্দ্রীয় অবস্থান নির্ণীত হয়। পূর্বতন দৈনিকের প্রাণবন্ধু নব সম্পাদক বেনজীর ভাইয়ের মনে আঘাত হেনে নব সূচনা-কিরণে উদ্ভাসিত হলাম। না, মেন্টর মহান একটি কথাও রাখলেন না। পৃথিবীর প্রতিই তখন বিশ্বাস উবে যায় উবে যায়।জুলিয়াস ফুচিকের ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’ যে বইটি কৈশোর তারুণ্যে পড়তে দিয়েছিলেন,যে বইটি আত্মদানের জীবন গড়তে উদ্দীপন যুগিয়েছিল, সেই মেন্টরের এমন বিশ্বাসভঙ্গ?
২০০১ সালে নির্বাচন কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক বীভৎসতায় সূচনা-কিরণের ভয়াল অন্ধকার চেহারা দেখে জনপ্রিয় পত্রিকার ‘জনপ্রিয়’ অবস্থানকে হেলায় তুচ্ছজ্ঞান করে ‘খড়কুটো’ পরিস্থিতিকে মেনে নিলাম। টোকাই।পথশিশু।কিছুই ভালো লাগেনা।
অবশ্য মাঝখানে কলকাতার’প্রাত্যহিক খবর’ নামে একটি মাঝারি মানের দৈনিকের বাংলাদেশ ব্যূরো প্রধানের দায়ভার পালন করলাম বছর তিনেক। নানা খবর ফিচার শত শত পাঠালাম। দুবার বিমান যোগে ব্যূরোপ্রধান সাহেব কলকাতা গেলেন আহার নিবাস সব যাতায়াত নিজের। ঢাকায় ব্যূরো অফিস পরিচালনার সব খরচ আমার।হঠাৎ পত্রিকাটির অক্কা নব্যধনিক মালিকের নির্দেশে।একটি পয়সাও মেলেনি।আমাকে আপনারা ‘জাতীয় আহাম্মক পরিষদ’ এর আজীবন চেয়ারপার্সন পদ বরাদ্দ করলে ভুল করবেননা।
ওদিকে ‘ মেন্টর’ তখন রাষ্ট্রক্ষমতার সোপান ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ঋণের বিশাল বিশ্বমহাজনকে সামনে রেখে সূচনা-কিরণ বিকীরণে মাত করে এক-এগারোর ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ হাতে নিয়ে ভাবলেন ‘কামাল হো গিয়া’! তারপর কতো কী! সৃজনশীলতায় অনবদ্য এই মেন্টর। সবখানে গণতন্ত্র চান। শুধু সূচনা-কিরণ আলয়ে নরোম স্টালিন। তিনি যা চান তা-ই হবে।
এসব কথা আজকে আর নয়। মধ্যগগন থেকে পড়ন্ত বেলায় অনিয়মিত এখানে সেখানে লিখি। লোকে কয়, লেখেন না কেন। অনেকেই চায় বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের সেই দাউ দাউ। একজন সামরিক একনায়ককে উৎখাত করে দেবার সেই পর্বের পর কতো যে খর্ব কান্ড কতোখানে!ধোকাবাজি-সম্ভোগী-চাঁদাবাজি-মনোনয়নবাজি-সম্রাটী-পাপিয়ামি-শাহেদী ইত্যাদি কায়কারবার ডান-বাম-মধ্য সবখানে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান তাকবিন্দু ছিল সম্পদশালী বাংলা। ওরা বাংলাকে শুষে-ঠুসে-দুর্ভিক্ষে একশেষ করে দিয়েছিলো। সেই বাংলার পূবধার পশ্চিমধার উভয়স্থানেই বহুকাল পর কাঁচা টাকার জোয়ার। বিশেষত আমাদের বাংলাদেশ পুঁজি সঞ্চয়ে বেশ সোমত্ত-তাগড়া। পৃথিবীর বিদ্যমান উন্নয়নধারায় সব অন্ধকারের ভিতরও এদেশে উন্নয়নের কিরণ। সূচনা-কিরণওয়ালাদের মুখ তাই ব্যাজার। এদিকে ভেবেছিলাম একদিন বিপ্লব সম্পাদন করে সোভিয়েত ওমে বিকাশের মুরগীর বাচ্চা ফোটাবো। সেই ওম গেছে আচানক গুম হয়ে। পৃথিবী বদলে গেছে। এক অস্থির অধীর জীবন।
এখন আর পরাশক্তি শুধু আমেরিকা- সোভিয়েত নয়। পতিত সোভিয়েত এখন রাশিয়া হিসেবে তরতর উত্থিত হচ্ছে। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে মার্কিনী শাসকদের বুকে চিন চিন ব্যথা ঘটিয়ে জেগে উঠেছে চীন শার্দুল। তার গর্জনে পৃথিবী কাঁপছে। এদিকে ভারতও পরাশক্তির পেখম মেলতে চাইছে।
বাংলাদেশএখন উন্নয়নে মধ্যম-মধ্যম বাক বাকুম করছে। এতো যে ভয়াল করোনা থাবা। মানুষ বহুমুখী কষ্টে। তবুও এখনও না খেয়ে মরার একটি খবরও দুই বাংলাতেই মেলেনি। এদিকে বিংশশতাব্দীর মধ্যম বয়স থেকে এই ‘রঙবেরঙ’ ঝালমুড়িওয়ালা একবিংশ শতাব্দীর একবিংশ বছরে বুড়ো-খুড়ো।
কখন চলে যাই। সাধ হলো মরিবার পূর্বে পুনঃনড়িয়া উঠি। একালের ‘রঙবেরঙ একবিংশ’নিয়ে বাজারে নামি। যদিও জানি, এতোকালের বন্ধ দোকানের পশার আর হবেনা। বিরানব্বই বছরের আইনজীবী কোনো ব্রিফ নেই। খালি হাতে প্রতিদিন আদালতে গিয়ে বসে থাকেন অভ্যাস-নেশায়। আমিও।
ঠাঁই দেবেন কেউ আর? রঙবেরঙ অস্ত্রে যে স্তরে স্তরে জং পড়ে গেছে হায়!
(হিলাল ফয়েজী: রম্য লেখক)