মতামত

আহমদ ছফার রাজনৈতিক ও সমাজ চিন্তার ধরণ

-রবীন গুহ

আমাদের চারপাশের সবকিছু নির্মোহভাবে দেখার বা বোঝার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা প্রয়োজন তা সব মানুষের থাকেনা। তাই অন্য কারো দ্বারা নিসৃত আলোতেই তারা অনুসন্ধান করেন জীবনের উপলব্দিগুলোর অন্তর্নিহিত সত্যকে। এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। বাঙালীর মেধা ও মননের জগতে রবীন্দ্রনাথের বিচরণ যেন সর্বগ্রাসী। তবুও, এদেশের যে ক’জন বুদ্ধিজীবি রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে নিজস্ব একটা বলয় তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে আহমদ ছফা অন্যতম। বর্তমানে এদেশের তরুণ বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ছফার অনুসারীদের সংখ্যা বিশাল। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবি সলিমুল্লাহ খান ছফার মূল্যায়ন করছেন এভাবে-“আমার ধারণা এখনও পরিবর্তিত হয় নাই। আহমদ ছফাই এখনও আমাদের কালের নায়ক। কি ভাবের ঘরে কি ভাষার দরবারে তাঁহার সহিত তুলনা দিবার মতন কোন লেখক- অন্তত ভূ-বাংলাদেশে যাঁহারা বাংলায় লেখেন তাঁহাদের মধ্যে- আমি খুঁজিয়া পাই নাই। কেহ যদি দুই চোখে আঙ্গুল প্রবেশ করাইয়া দেখাইয়া দেন আমি চিরবাধিত থাকিব। প্রয়োজনে নিজের নামটা কাটিয়া ফেলিব।”

সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, মীর মোশাররফ হোসেন আর কাজী নজরুল ইসলামের পরে আহমদ ছফাই বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক। ছফা তাঁর লেখা প্রবন্ধ, গল্প  ও উপন্যাসের মধ্য বাঙালী মুসলমান সমাজের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার সীমাবদ্ধতা ও সুবিধাবাদের স্বরূপ উন্মোচনের  চেস্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি  এলিট বুদ্ধিজীবিদের সাথে চেনাপথ ধরে হাটতে চাননি। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে নতুন পথ তৈরী করেই সেপথে চলার চেস্টা করেন। এই অনন্য, বৈপ্লবিক গুণ আর স্পর্ধিত বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিমত্তাই হয়তো আজকের তরুণ বুদ্ধিজীবিদের কাছে ছফাকে  নতুন যুগের নায়ক হিসেবে হিসাবে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সৃষ্টিশীলতা আজকের দিনে হুমায়ুন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খান সহ দেশের আরো অনেক শীর্ষস্হানীয় ও তরুণ লেখক, শিল্পী, চলচিত্রকর ও বুদ্ধিজীবিদের অনুপ্রাণিত করেছে।

ছফা মনে করেন, এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বর্তমান বাস্তবতার আবহে স্বকীয় পথ তৈরী করতে ব্যর্থ। ওপার বাংলার আরেপিত বুদ্ধিবৃত্তিক লেজুড় ছুড়ে ফেলে বাংলাদেশের নিজস্ব পথ বিনির্মানের কথা বলেন তিনি। যদিও তত্ত্ব ও প্রায়োগিক দিকগুলির সঠিক বিশ্লেষণের অভিযোগ তুলে এদেশের ‘অভিজাত’ বুদ্ধিজীবি মহলে তাঁর মূল্যায়ন সেভাবে করা হয়নি। আহমদ ছফার ‘সর্বাধিক আলোচিত এবং অনেকাংশে বিতর্কিত ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের কথা বর্ণনা দেন এবং এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা ভবিষ্যতে দেশে একটা বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন।

ড: আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধসংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর সেরা দশ চিন্তার বইয়ের একটি বলে মনে করেন। তিনি প্রবন্ধটিতে  হাজার বছরের সাহিত্য ও ইতিহাস ঘেঁটে  নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কারণ অনুসন্ধান করেচেন। কারণ হিসেবে তিনি বাঙালি হওয়া বা মুসলমান হওয়াকে নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষ  দীর্ঘ একটা সময় যে বৈষম্যের মধ্য দিয়ে গেছে তার কথা বলেছেন। এছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পট পরিবর্তনের ক্রমবিবর্তমান ধারাকেও  দায়ী করেছেন৷

ছফা লিখছেন, “যে জাতি উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হতে পারে না, অথবা সেগুলোকে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র্র সৃষ্টিও সম্ভব নয়। যে নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভালোমন্দ নিরূপণ করতে অক্ষম, অপরের পরামর্শ এবং শোনা কথায় যার সমস্ত কাজ-কারবার চলে, তাকে খোলা থেকে আগুনে কিংবা আগুন থেকে খোলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়।”

সুদীর্ঘ সময় ধরে বারবার ধর্ম পরিবর্তন করার ফলে বাইরের খোলস বদলানো ছাড়া এদেশীয় মুসলমানের  চিন্তা আর মননের জায়গায় মৌলিক কোন পরিবর্তন আসেনি। নিজস্ব যুক্তি, বিশ্লেষণ আর দর্শনের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়ে দেন বাঙালী মুসলমানের চিন্তাজগতের কাঠামোগত দুর্বলতা।

ছফার সৃষ্টিকর্ম একদিকে যেমন সমাজসংশ্লিষ্ঠ অন্যদিকে তীক্ষ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষণপূর্ণ। সাহিত্যকর্মে তিনি সমাজ ও রাজনীতির গভীরতম চিন্তাকে যুক্ত করেন। এদেশের রাজনীতি নিয়ে তার ছিল স্বকীয় পর্যবেক্ষন।

মার্কসবাদের পথে চলেননি, তবে বামপন্হী রাজনীতি  নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছফা বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে  এগারোটি কারণ নির্দেশ করেছেন।

বামপন্থার ব্যর্থতার এগারো কারণ:

১)জাতিসত্তার প্রশ্নটি পাশ কাটিয়ে বামপন্থী রাজনীতি বিপ্লবের প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল এবং তাই বামপন্থী রাজনীতি জাতীয় নেতৃত্বে অবস্থান হারিয়েছে।

২)আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতাদর্শগত দ্বন্দটি আমাদের দেশের বামপন্থী দলগুলো যতটা বড় করে দেখেছে, আমাদের দেশের শোষিত জনগণের প্রশ্নটি তাঁদের চোখে সে তুলনায় গৌণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

৩)অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা মৌলিক উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের সংযোগ সাধন করে পরিবর্তনকামী শক্তিগুলো একটা জঙ্গী ঐক্যমোর্চায় টেনে আনার ব্যাপারে তারা বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

৪)আমাদের শোষিত জনগণের সামগ্রিক স্বার্থটির প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার কারণে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে মধ্যশ্রেণীভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কনিষ্ঠ অংশীদার হওয়ার প্রবণতা জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অসম্ভব করে তুলেছে।

৫)মেহনতি জনগণের সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে তাদের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা সামন্ত সংস্কৃতির রিক্তাবশেষকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে, যা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহযোগিতায় বারবার আমাদের সংস্কৃতির গতিধারার সুষ্ঠু বিকাশ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে।

৬)বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানসচৈতন্যের শুশ্রূষা করে তার মান উন্নত এবং বোধ উপলব্ধিতে নতুন সমাজের ভ্রূণ গ্রহণ করার পরিবেশ সৃষ্টি না করে আহত করার প্রবণতা বৃহত্তর জনগণকে বামপন্থীর প্রতি বিমুখ করে তুলছে।

৭)সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জাতিসমূহের নিরাপত্তা এবং জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের অধিকারের প্রতি যথেষ্ট অঙ্গীকারসম্পন্ন না হওয়ার কারণে, তাদের মধ্যে বিছিন্নতার অনুভূতি জন্ম দিয়েছে।

৮)বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দ সমস্ত জাতির নেতৃত্ব দেয়ার বদলে সমাজে বিশেষ বিশেষ অংশকেই কর্মক্ষেত্র মনে করেন বলে তাঁরা একটা পলায়নবাদী, পরাজিত মানসিকতার শিকারে পরিণত হয়েছেন। সে কারণে বামপন্থী রাজনীতিকে আমাদের রাজনীতির প্রধান ধারা হিসেবে তাঁরা চিন্তা করতেও সক্ষম নন।

৯)বিশ্বপরিসরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলর পতন আদর্শিকভাবে আমাদের বামপন্থী দলগুলোর নেতা এবং কর্মীদের হতবিহ্বল করে ফেলেছে। তাই তাঁরা আমাদের শোষিত জনগণের উত্থানক্ষমতার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পারেন না।

১০)বাজার অর্থনীতির জয়যাত্রা বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনীতিবিদদের একাংশকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। তাঁরা জনগণের শ্রমনির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশের পথ পরিহার করে বাজারের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করছেন। তাঁদের এ দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক নয়। বিকল্প অর্থনৈতিক যুক্তি নির্মাণে বামপন্থী অর্থনীতিবিদদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এ সকল আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ধনী দেশগুলোর স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতটি তাঁরা উপেক্ষা করে থাকেন।

১১)বেসরকারি সাহায্য সংস্থাসমূহ তথা এনজিও-এর কার্যক্রম বামপন্থার জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছফার সৃষ্টিকর্ম তত্ত্বের বিচারে প্রশ্নাতীত নয়। তাঁর বিশ্লেষনের পদ্ধতি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে— তা বলা যাবেনা। তবে তিনি তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় অসীম চিন্তাশক্তি আর অদম্য সাহসিকতা দিয়ে  ইতিহাসের নির্মোহ পাঠকে বর্তমান বাস্তবতার সাথে সংশ্লেষণ ঘটান। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও এদেশের মানুষের প্রতি তার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দায়কে পাশ কাটিয়ে যেতে চাননি। আজকের দিনে  বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত তরুণদের  অনেকেই যারা বিদ্যমান কাঠামোর সঙ্গে লড়তে প্রচলিত বয়ান আর ক্ষমতাকাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধও করছেন, তারা ফিরে যান ছফার কাছে। ছফার সৃষ্টিকর্ম তাদের চিন্তা জগতের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখায়। ছফা প্রায় চার যুগ আগে বলেছিলেন, আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়ে চিন্তা করতে হয়। এই কথাটি আজো প্রাসংগিক। বাংলাদেশে প্রথাবিরোধী ও মুক্তচিন্তার বাহকদের এই যুগেও রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে হয়। ক্ষমতার কাঠামোকে ঝাঁকি দিয়ে নাড়িয়ে দিতে হলে জেল-জুলুম-গুম-খুনের ভয় মাথায় নিয়েই চিন্তাকে এগিয়ে নিতে হয়।

 

আজ ৩০ জুন লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণমানুষের বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

 

তথ্যসূত্র:

১) উইকিপিডিয়া

২) আহমদ ছফা রচনাবলী