বিজ্ঞান প্রযুক্তি

ড. কুদরাত-এ-খুদা: দেশজ গবেষণার পথিকৃৎ

-ড. প্রদীপ দেব

ড. প্রদীপ দেব

আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার গোড়াপত্তন হয়েছিল যাঁর হাত ধরে তিনি বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদা। আমাদের দেশের পাট, নারিকেল, বাঁশ, ঘাস ইত্যাদি অতিপরিচিত জিনিস থেকে বিরাট শিল্প গড়ে উঠতে পারে তা আমাদের হাতে-কলমে শিখিয়ে গেছেন এই বিজ্ঞানী। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা যে কত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা করার জন্য বিজ্ঞানের অনেক অনেক বই যে বাংলায় লেখা দরকার – তা তিনি শুধু যে দেখিয়ে গেছেন তা নয়, নিজের হাতে লিখে গেছেন অনেকগুলো বই – একেবারে স্কুল শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্যও।

আমাদের দেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশ করা শুরু হয়েছিল ড. কুদরাত-এ-খুদার হাত দিয়ে। তাঁর উদ্যোগে ১৯৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বিজ্ঞান সাময়িকী ‘পুরোগামী বিজ্ঞান’। শিশুকিশোরদের জন্য বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বিজ্ঞানের জয়যাত্রা’ও প্রকাশিত হয় তাঁর উদ্যোগে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। একটি নতুন দেশের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাশেষে বিশ্বমানের মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য যে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই তা তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন সেই ১৯৭৪ সালেই।
শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের কথা আমরা অনেক সময় উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু বিজ্ঞানী ডক্টর খুদা’র বৈজ্ঞানিক অবদান সম্পর্কেও আমাদের আরো অনেক বেশি জানা দরকার। ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডি.এসসি ডিগ্রী অর্জনকারী বিজ্ঞানী। অথচ শৈশবে তাঁর মা-বাবা, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন তাঁকে বানাতে চেয়েছিলেন পীর। সে উদ্দেশ্যে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায়। কুদরাত-এ-খুদার জন্ম ১৩০৭ বাংলার ২৬শে বৈশাখ, ১৯০০ ইংরেজির ৯ মে, ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলার মাড়গ্রামে মামার বাড়িতে। তাঁর বাবার নাম হযরত শাহ সুফী খোন্দকার আবদুল মুকিত, মাতার নাম সৈয়দা ফাসিহা খাতুন। তাঁর বাবার বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার সীমান্তে মৌ গ্রামে।
কুদরাত-ই-খুদা নামটি রেখেছিলেন খোন্দকার আবদুল মুকিতের পীর কলকাতার তালতলার হযরত সায়ীদ শাহ মুর্শিদ আলী আল কাদেরী। সেই ব্রিটিশ আমলে হাতেগোনা কয়েকজন ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের একজন ছিলেন খোন্দকার আবদুল মুকিত। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেছিলেন। ইংরেজ সরকারের যেকোনো উঁচু পদে চাকরি পেতে পারতেন তিনি। কিন্তু তিনি চাকরির কোন চেষ্টা করেননি। পীর বংশের ছেলে। নিজেও পীর ছিলেন। ছেলেকেও পীর বানানোর ইচ্ছেয় ভর্তি করে দিলেন মাদ্রাসায়। কোরান-এ হাফেজ হওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু হলো। কিন্তু একদিন এক ব্যাপার ঘটলো তাঁর মামার বাড়িতে। কলকাতায় পড়ুয়া এক চাচাতো মামা ছুটিতে এসে বালক কুদরাত-এ-খুদাকে একটি বাংলা বর্ণমালা শেখার বই দিয়ে বললেন সব শিখে ফেলতে। বিকাল বেলা মামা যখন দেখলেন কুদরাত-ই-খুদা অন্য ছেলেদের সাথে খেলছে – তখন ধমক দিয়ে চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “যে বই পড়তে বলেছি সেটা পড়া হয়েছে?” পড়া হয়েছে বলার পর মামা পরীক্ষা নিয়ে দেখলেন বালক কুদরাত-এ-খুদা মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাংলা বর্ণমালা লিখতে পড়তে শিখে ফেলেছে। তারপর মামা কুদরাত-এ-খুদাকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করলেন। মাড়গ্রাম প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু হলো কুদরাত-ই-খুদার স্কুলশিক্ষা। তারপর কলকাতার উডবার্ন স্কুল। তারপর কলকাতার মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ১৯১৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন কুদরাত-ই-খুদা। স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে কেমিস্ট্রিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএসসি পাস করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে যান ডক্টরেট করার জন্য। সেখানে থিসিস শুরু করলেন স্যার জে এফ থর্প-এর তত্ত্বাবধানে। প্রফেসর থর্প কুদরাত-এ-খুদাকে স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে দিলেন। ফলে তিনি চার বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ কাজ করলেন। ১৯২৯ সালে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি নিয়ে তিনি দেশে ফিরলেন। এত বড় বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক পেলেও উপযুক্ত কোন চাকরি জুটল না কুদরাত-ই-খুদার। আড়াই বছর বেকার থাকতে হয়েছে তাঁকে। সেই সময় প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে আবার একটি গবেষণা থিসিস লিখলেন তিনি। দীর্ঘ চেষ্টার পর ১৯৩১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে লেকচারার পদে যোগ দিয়ে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই ডিপার্টমেন্টের প্রধান অধ্যাপক পদ লাভ করেন।
১৯৪২ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক অধ্যাপক কুদরাত-এ-খুদাকে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন কুদরাত-এ-খুদা। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পূর্ব-পাকিস্তানে চলে এলেন কুদরাত-ই-খুদা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত জনশিক্ষা দপ্তরের পরিচালক, ১৯৫০-৫৩ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞান উপদেষ্টা, ১৯৫৩-৫৪ পূর্ব-পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি রাজশাহী ও চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার।
আমাদের দেশীয় শিল্পের বিকাশ শুরু হয় তাঁর হাত দিয়ে। ১৯৬৬ সালে অবসরগ্রহণ পর্যন্ত তিনি নিরলস গবেষণা করেছেন, গবেষণার নির্দেশনা দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। এই সময়ের মধ্যে প্রশাসনিক কাজের প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও ৬৩টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক রিসার্চ জার্নালে, পেয়েছেন ১৮টি প্যাটেন্ট। আমাদের দেশের সহজলভ্য প্রাকৃতিক সম্পদকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে লাভজনক শিল্পে পরিণত করার পথ দেখিয়েছেন ড. কুদরাত-এ-খুদা। তাঁর বনৌষধি ও গাছপালার গুণাগুণ, পাট, কাঠকয়লা, লবণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার ফল আমরা সবাই ভোগ করছি। পাটের আঁশের ব্যবহার আমরা অনেক দিন থেকেই জানি। কিন্তু আঁশ ছাড়া পাটের আর কোন অংশই তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কাজে লাগতো না।
কুদরাত-এ-খুদা পাটকাঠি থেকে মন্ড তৈরি করে সেই মন্ড থেকে অতি উন্নতমানের দৃঢ় তক্তা তৈরি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। পার্টেক্স কাঠ কুদরাত-এ-খুদার অবদান। তাছাড়া পাটকাঠি থেকে সেলুলজ মন্ড তৈরি করে সেই মন্ড থেকে প্যাকিং কাগজ তৈরি করা সম্ভব। কাগজের মন্ড আলাদা করার পর যে আঁশ থাকে সেখান থেকে নাইলন উৎপাদন করা যায়। পাটের বীজ থেকে শুধুমাত্র নতুন পাট গাছের চারাই হয় না, র্যাফিনোজ (Raffinose -C18H32O16) নামক চিনিও পাওয়া যায়। র্যাফিনোজ খুব ভালো চিনি। পাটের বীজে এই চিনির উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকে। ১ কেজি র্যাফিনোজের দাম প্রায় ২২৫ ডলার। সাড়ে ছয় কেজি পাটের বীজ থেকে এক লিটার ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। সমুদ্রের পানিতে খাবার লবণ সোডিয়াম ক্লোরাইড ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড থাকে। তাছাড়া স্বল্পমাত্রায় ব্রোমিনও থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসব রাসায়নিক বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয় এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এসব আমাদের আমদানি করতে হয়। সমুদ্রের পানি থেকে আমাদের লবণচাষীরা যে পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন করে তাতে শুধুমাত্র খাদ্যলবণ ছাড়া আর কোন কিছুই সংগ্রহ করা যায় না।
ড. কুদরাত-এ-খুদা হিসেব করে দেখিয়েছেন বড় কোন কারখানায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লবণ আহরণ করা হলে যে কারখানা বছরে ১ লক্ষ টন লবণ উৎপাদন করবে সেখানে ১০ হাজার টন ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড, ১০ হাজার টন ম্যাগনেসিয়াম সালফেট এবং সেই অনুপাতে পটাসিয়াম ক্লোরাইড উৎপাদিত হবে। ১৯৬৬ সালে অবসর গ্রহণের পর ড. কুদরাত-এ-খুদা কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। আমাদের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। তিনি সেই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক জাতি গঠনের জন্য সেই কমিশনের রিপোর্ট অত্যন্ত কার্যকরী দিক-নির্দেশনা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতার কারণে সেই কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭৬ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৭ সালের ৩রা নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।