শিল্প সাহিত্য

মধ্যসত্ত্বভোগী কবি আল মাহমুদ: এক

– শোয়েব নাঈম
কবি আল মাহমুদ (ফাইল ছবি)

 আল মাহমুদ কবিতা লিখে যতবড় কবি হয়েছিলেন তারচেয়ে বেশি সুবিধাবাদী চেতনায় বামন ছিলেন। যে মৃত্তিকার ঘ্রাণকে, লোকজ উপাদানকে, মিথাশ্রয়ী এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করে বাংলার চিরায়ত আবহাওয়াকে অনুভব করে ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’ একদা সৃষ্টি করেছিলেন এই আল মাহমুদ , লোভের কলসের মতো উবু হয়ে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য চেতনাকে ধারণ করে ১৯৭৬-এ ইউটার্ণে ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো’ প্রকাশ করে সেই আল মাহমুদ একটি প্রকাণ্ড উগ্রবাদী জঙ্গিবৃক্ষ রোপণ করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্যভূমিতে।

১৯৬৬ তে ‘কালের কলস’ কাব্যগ্রন্থে লিখলেন— “[…] চিড় খায় পলেস্তরা, বিশ্বাসের মতন বিশাল হুড়মুড় শব্দে অবশেষে ধসে পড়ে আমাদের পাড়ার মসজিদ…” ঠিক দশবছর ব্যবধানে ১৮০° টার্ণ করে সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিতে লিখলেন, “[…] তবু আমার মনে হলো ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কাত হয়ে পড়া গম্বুজটিই বুঝিবা খানিকটা উঁচু হয়ে আছে…. ” ( মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো) ১৯৬৬ তে ‘সোনালি কাবিন’এ যে হাহাকারে তিনি লেখেন— ” সোনার দিনার নেই, দিনমোহর চেয়ো না হরিনী যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি, আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি…” কিন্তু ১৯৭৬ থেকে পরবর্তী ৪৩ বছর পর্যন্ত আল মাহমুদ বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে জঘণ্য এবং ঘৃণিত ‘আত্মবিক্রয়ের’ এক স্ববিরোধিতার জীবন্ত দলিল হয়ে আছেন এবং লোভের অভিযাত্রিক একজন ‘কবি’ হয়ে থাকবেন অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও।

আল মাহমুদ আজীবন ছিলেন সুবিধা আদায়ের এক মধ্যসত্ত্বভোগী কবি, সেই মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত । তার কোনো একটি কবিতাও নেই যা এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের অধিকার আন্দোলনকে ধারণ করে আছে, গণআন্দোলনের চেতনাকে প্রভাবিত করেছে। যাহা কিছু লিখেছেন এর সবই একই প্রতিমানের এবং যতটুকু লিখেছেন সবসময়ই নিজের স্বার্থ সুবিধাপ্রপ্তিকে বিবেচনায় রেখে। যিনি মধ্যসত্ত্বভোগীর সুবিধাবাদী চরিত্র নিয়ে সারাজীবন শুধু নিজেকে বিবর্তন করেছেন আর প্রাপ্তি ঘটিয়েছেন বৈষয়িক ঐশ্বর্যের! পাখির মতো বন্য হতে চাওয়া এদেশের প্রেমিকদের বিভ্রান্তের নিশানা দিয়ে আরো ভয়ঙ্কর অভীপ্সার ফাঁদ পেতেছিলেন বাংলা সাহিত্যে ভিনদেশী এক দখলদার বখতিয়ারের ঘোড়ার প্রণয়প্রার্থী করার ষড়যন্ত্রের জাল বুনে, কবিতার ছত্রে-ছত্রে জিকিরের তালে-তালে ‘জিহাদ…. জিহাদ’ লিখে-লিখে। এদেশের জাতিসত্তার বেড়ে ওঠার ভিতরে যেসব Nexus তৈরি করে দিয়ে গেছেন, এ কারণেই ‘আল মাহমুদ’ পাঠে যথেষ্ঠ সতর্কতা অবলম্বন করা স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখন্ডে অত্যন্ত জরুরি ও বাঞ্ছনীয়।

আল মাহমুদে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীগোষ্ঠীরা তাদের আন্দোলনের ট্যাগলাইন বানিয়েছে লক্ষশহীদের বাংলাদেশে ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’কে— “[…] মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি; আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি…” শুধু জঙ্গি না হয়েও কেবলমাত্র কবি আল মাহমুদের কবিতার বিষয় এদেশে বাস্তবায়ন করেই একইসাথে ‘গাজী’ ও ‘শহীদ’ এমন যুগল জগাখিচুড়ি মার্কা খেতাবপ্রাপ্তদের দ্বারা এই স্বাধীন বাংলাদেশকে কঠিন সংকটে ফেলা দেওয়া সম্ভব। এসব কবিতার মাধ্যমে যে কতটা ভয়ঙ্কর উগ্রবাদী চিন্তার উম্মেষ এবং বিকাশ ঘটানো সম্ভব, এদেশে তার অনন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘ইসলাম বাঁচানেওয়ালা’ আল মাহমুদের পানি ঘোলা করা বিষয়ধর্মী কবিতাগুলি।

এই কট্টর মানসিকতাকে তিনি আদর্শস্থানীয় করেছেন এদেশের অপরাপর শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের অস্তিত্ব ও বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে অস্বীকার করে, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি ঘৃণায় আধিপত্যবাদী মনোভাবে। হুংকারী মওলানাদের ভাষার আচরণের মতো তিনিও চিৎকার দিয়েছিলেন— “…আমাদের হাতে একটিমাত্র গ্রন্থ আল কুরআন, এই পবিত্র গ্রন্থ কোনদিন, কোন অবস্থায়, কোন তৌহীদবাদীকে থামতে দেয়নি। আমরা কি করে থামি?…. আমাদের পতাকায় কালেমা তাইয়্যেবা, আমাদের এই বাণী কাউকে কোনদিন থামতে দেয়নি আমরাও থামবো না….” —কবিতা: ‘আমাদের মিছিল’। বর্তমান পাকিস্তান দেশটি সৃষ্টির পর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র-সমাজের মধ্যে যে মাত্রায় প্রভাবিত করে আছে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিঘনিষ্টতা, সেসবের বেশ কিছু প্রতিফলন দেখেছি আমাদের দেশের কিছু কবি সাহিত্যিকদের লেখনিতে স্বাধীনতার পূর্বকালে ও উত্তরকালে । স্বঘোষিত ‘নায়েবে রসূল’দের তাণ্ডবে টালমাটাল পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয়চরিত্রের কালনাগিনীদের লেজের মতোই আল মাহমুদের লেজও নড়া শুরু হয়েছিল প্রাক-একাত্তর পাকিস্তানমুখীতা অন্ধকারের সেই সত্তুর দশকের শেষের থেকে। তার মনোঃজগতকে তার কবিতার উদাহরণ দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ শব্দমালারা রক্তাক্ত হয় এই কবির কূটচালে ভিনদেশীয় আরবের তলোয়ারে— “…… কেন এক প্রাচীন তৌহীদবাদী জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার রজ্জু / তুমি পরাক্রান্ত পৌত্তলিকদের হাতে তুলে দিতে চাও?/আমরা কি বংশানুক্রমে তোমার দাস নই?/আমরা তোমার নামের কোনো জেহাদেই অতীতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি….” — কবিতা: ‘কদর রাত্রির প্রার্থনা’। আল মাহমুদের কবিতায় উগ্রবাদী রাজনীতির উপকরণ আছে বিধায় বাংলাদেশের উগ্রবাদী এবং ধর্মান্ধগোষ্ঠীরা তার কবিতায় তাদের রাজনীতির স্বাভাবিক মিত্রকে খুঁজে পায়— “ইসরাফিলের চোখ দুটি ঈষৎ রক্তবর্ণ ধারণ করলেও অনন্তকালের মধ্যে তিনি সজাগ / শৃঙ্গধারী এক ফেরেস্তা। তবুও তার চোখের কোল বেয়ে কিসের দুটি দাগ? তিনি কি / তার প্রথম ফুৎকারের পরিণাম দর্শনে মুহূর্তের জন্যও কেঁদে ফেলেছিলেন? তার / বৈদুর্যমণির মত চোখ দুটি থেকে কি ঠিকরে গড়িয়ে পড়েছিল বৃষ্টি? . . . ” — কবিতা: ‘পুনরুত্থানের ফুৎকার’। দুনিয়ায় লাভ যতবেশি করেছিলেন তিনি, তারচেয়ে দ্বীন বরবাদ করেছিলেন সেই অনুপাতে অনেক বেশি । বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলামের ভুখন্ডে কতলের রক্তপাতের ধর্মীয় সন্ত্রাসের মুওদূদী ধারা কায়েম করতে চিয়েছিলেন কূটকৌশলে। যে বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় বহিছে মুসলিম সুফি হজরত শাহ জালাল-শাহ পরান-শাহ মখদুম-হাজী দানেশমন্দ’দের স্থাপন করা ইসলামী সিলসিলা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মরমীয়া ইসলামের নির্যাস, সেখানে আল মাহমুদ আহ্বান করেছেন সুদূর তুরস্কের ধর্মোন্মাদ এক উগ্র ইমামের আগমনী বার্তা দিয়ে— “… ঢাকা তোমার মুখ । কারণ/ মগরের নকীবেরা এখন দাজ্জালের আগমন শিঙায়/ ফুঁক দিচ্ছে/ ঢাকো তোমার বুক। কারণ/ সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে আমরা/ হকের তালিকায় লিপিবদ্ধ ।/ চলো অপেক্ষা করি সেই ইমামের/ যিনি নীল মসজিদের মিনার থেকে নেমে আসবেন… ” — কবিতা: ‘নীল মসজিদের ইমাম’। আল মাহমুদের জীবনকালে এবং কাব্যযাত্রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে কখনোই ধারণ করতে পারেন নাই তার সহজাত মানস চরিত্রে। মানুষে মানুষে সহাবস্থানের মধ্যে যে ঐক্যের, যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়েছে এদেশে হাজার হাজার বছরের যাপিত জীবনে, সেখানে ইসলামের নামে কবিতার আখ্যানে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংস্রতা ঢুকিয়ে দিয়েছেন চাতুর্যপূর্ণ কপটাচারে। সকলধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবান না হয়ে দেশবিরোধী গোষ্ঠীদের সাথে নিয়ে মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন এভাবে— ” অথচ হাজার বছর আগে/ বেবিলনের ঝিলগুলো থেকে তোমার এস্ত উড়ালের শব্দে/ আমি আনন্দ প্রকাশ করতাম। বলতাম / পালাও পালাও/ মাংসাশী বাঘমানুষ/ সিংহমানুষ/ চিতা-মানুষদের থেকে মেঘের গম্বুজে আত্মগোপন করো …. ” — কবিতা: ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’। পরমতসহিষ্ণুতার নীতিবোধে উন্মুখ করে না, উদ্বুদ্ধ করে না এই কবির কবিতা পাঠে। তার কবিতা প্রভাবিত করে না দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিময় সমাজজীবন গঠনে। বীজ বপন করে দিয়েছেন ইসলামের নামে ভয়ানক আরবীয় কট্টর সংস্কৃতি এই ভূখন্ডে এক মধ্যসত্ত্বভোগীর ধূর্ত মস্তিষ্কে। আল মাহমুদের কবিতাগুলি পাঠ করলে স্পষ্ট অনুভব করা যায় অন্ধকার দানবের উল্লসিত মুখ।

পর্ব – দুই,  ১৪ জুন ‘২১সোমবার প্রকাশ করা হবে