মতামত

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী ভরাডুবি এবং ভারতে বামপন্থার ভবিষ্যত

-সাঈদ ইফতেখার আহমেদ

কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা স্বাধীন ভারতে এবারই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে কোন আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। কংগ্রেস এবং বাম দলগুলোর কোয়ালিশন, বামফ্রন্ট দীর্ঘসময় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন ছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তারা একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী।

তৃণমূলকে হটাবার জন্য আব্বাস সিদ্দীকির আইএসএফ এর সাথে জোট বেঁধেও নির্বাচনে এবার তাদের চরম ভরাডুবি ঘটেছে। ভোটের ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেন তাদেরকে আর ক্ষমতার আশেপাশে দেখতে চাইছে না।

কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের মাঝে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা প্রশ্নে, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিভিন্ন ইস্যুতে মত পার্থক্য থাকলেও মোটা দাগে তাদের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল রয়েছে—সেটা হল তারা উভয়েই মতাদর্শগতভাবে সেক্যুলার।

জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতকে সাংবিধানিক ভাবে সেক্যুলার পরিচিত দেবার ব্যাপারেও এ দুটো দলের ভূমিকা মুখ্য। যদিও স্বাধীনতা পূর্ববর্তি–পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কংগ্রেসের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

অনেকে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে কংগ্রেসকে নরম সাম্প্রদায়িক দল বলে মনে করেন। কংগ্রেসের দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, মুখে সেক্যুলারিজমের কথা বললেও, চর্চার ক্ষেত্রে এসে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি থেকে কংগ্রেস নানাভাবে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে।

কংগ্রেসের সেক্যুলার দল হিসাবে গড়ে উঠতে বারবার ব্যর্থতা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল হিসাবে ধর্ম-নির্ভর ভারতীয় সমাজ কাঠামোর সেক্যুলার রূপান্তর ঘটাবার কোন প্রচেষ্টা তারা নেয়নি। বস্তুত এরই ফলশ্রুতি হল, বিজেপি, আরএসএস, শিবসেনার মত দল এবং সংগঠনগুলোর ব্যাপক উত্থান।

ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে পড়বে না বা এর ছোঁয়া লাগবে না—এতদিন এমনটিই ভাবা হচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট দীর্ঘ একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। এর পূর্বে দীর্ঘ সময় কংগ্রেসের শাসন ছিল এ রাজ্যে।পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম ও বিকাশও বাংলা থেকেই।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অতটা সফল না হলেও ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় অসাম্প্রদায়িক, সেক্যুলার রাজনীতির একটা বাতাবরণ বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে তৈরি করতে পেরেছে–অনেকে এরকমই ভেবে আসছিলেন।কিন্তু এবারের ভোটের ফলাফল,এ সমস্ত ভাবনাকেই বাতিল করে দিয়েছে।

এবার বিজেপি ক্ষমতায় না আসতে পারাটাকে অনেকে স্বস্তি হিসাবে দেখছেন। তাঁরা মনে করছেন, বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থেকে বাংলাকে বাঁচান গেল। কিন্তু আসলেই বিষয়টা কি তাই?

এবারের ভোটের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক “হিন্দুত্ববাদী” শক্তির—যেটাকে অনেকে উত্তর ভারতীয় ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’ মনে করেন– এক অবিশ্বাস্য রকম প্রবল উপস্থিতিই বরং জানান দিচ্ছে।

২০১১ সালের নির্বাচনে বা তার পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কোন আসনে জিতে আসতে পারেনি। ২০১১ তে ২৮৯ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলটি পেয়েছিল ৪.০৬ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালে বিজেপি প্রথম ৩টি আসন পায় আর তাদের ভোটের হার দ্বিগুনের চেয়েও বেড়ে দাঁড়ায় ১০.১৬ শতাংশে । এ ৩টি আসন থেকে এক মেয়াদ পরেই, ২০২১ এ এসে তাদের আসন সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭ টিতে। ভোটের হার বেড়েছে প্রায় চারগুণ  (৩৮.১৩ শতাংশ) ।

এবারের নির্বাচনে তৃনমূল প্রাপ্ত ভোটের হার ৪৭.৯৪ শতাংশ। তাদের প্রাপ্ত ভোট ২কোটি ৮৭ লক্ষ ৩৫ হাজার ৪২০। অপরদিকে, বিজেপি পেয়েছে ২ কোটি ২৮ লক্ষ ৫০ হাজার ৭১০। ৯২ টা আসনে বিজেপি এক হাজার এর চেয়ে কম ভোটের ব্যবধানে হেরেছে।

বিজেপির ভোটের উল্লম্ফনের যে ধারা, এ ধারা আগামী মেয়াদেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা, জাতীয় এবং রাজ্যের রাজনীতিতে এমন কোন মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি যেটা নির্দেশ করছে যে, মানুষ বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

এ ধারা অব্যাহত থাকলে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, আগামী নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় নিয়ে বিজেপি সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের যে ধারা, সেটি অনুসরণ করলে বোঝা যায়, সেখানে কোন দল বা জোট ক্ষমতায় এলে, জনগণ তাদেরকে পরপর কয়েকটা মেয়াদে ক্ষমতায় রাখতে চায়। তার মানে বিজেপি ক্ষমতায় আসবার অর্থ হচ্ছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা।

ভোটের হার এবং প্রাপ্ত ভোটের যে উল্লম্ফন, সেটি একই সাথে ২০১০ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনোজগতে যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, সেদিকেও ইঙ্গিত করে।অর্থাৎ, সেখানকার জনমানসে দীর্ঘদিন লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির, সেক্যুলার মননের জায়গাটি দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ধর্মভিত্তিক, সম্প্রদায় বিদ্বেষের রাজনীতি।

অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকে আজকে বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত থাকলেও মননগত ভাবে ধারণ করছেন বিজেপির রাজনীতি।

বিজেপির বিপরীতে বামফ্রন্টের প্রধান শরীক সিপিআই (এম) ভোটের হার গত দশ বছরে নেমে গেছে অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত গতিতে। ২০১১ এর নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪০ টি আসন আর মোট ভোটের ৩০.০৮ শতাংশ। ২০১৬ তে তাদের আসন নেমে আসে ২৬ এ, আর প্রাপ্ত  ভোটের হার ১৯.৭৫ শতাংশে। ২০২১ এ এসে সিপিআই (এম) সহ সমস্ত বাম দলের সম্মিলিত আসন সংখ্যা হয়ে গেছে শুন্য।  সিপিআই (এম) এর ভোটের হার নেমে এসেছে  ৪.৭৩ শতাংশে।

সমস্ত বাম দলের আজকে পশ্চিমবঙ্গে সম্মিলিত ভোট ৫শতাংশের মত। অর্থাৎ ২০১১ সাল থেকে বামদলগুলোর দ্রুত পতনের যে ধারা অব্যাহত রয়েছে, এটা যদি চলতে থাকে, তাহলে আগামী নির্বাচনে তারা ১ শতাংশ ভোটও পাবে কিনা, এটি এখন প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে টেনেটুনে সম্মিলিত ভাবে বামদের ভোট ১ শতাংশের মত। আজকে বাংলাদেশে জাতীয় রাজনীতিতে বামদের যে অবস্থা, রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে না পারলে, পশ্চিমবঙ্গে বামদেরও হয়ত সে পরিণতি বরণ করতে হতে পারে।

বামপন্থার রাজনীতি বাংলাদেশে কখনই গণভিত্তি পায়নি। ভোটের রাজনীতিতে বামদের অবস্থা এখানে অত্যন্ত করুণ । জিন্নাহর “দ্বিজাতি-তত্ত্ব” অনুসরণ করে মুসলিম জাতীয়াতাবাদের একটা শক্তিশালী ধারা এ দেশে সবসময় বিরাজমান রয়েছে। সেক্যুলার মতাদর্শ নানাবিধ কারণে এ দেশে শক্তিশালী শিকড় গাড়তে পারেনি।

মুসলিম জাতীয়তাবাদী, “ইসলামপন্থী” এমনকি বিএনপির একাংশের মাঝে বামপন্থার মানে হচ্ছে নাস্তিকতাবাদ। সেক্যুলার মতাদর্শ তাদের কাছে নাস্তিকতার কাছাকাছি মতবাদ। এ সমস্ত ধারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী হবার ফলে মানুষ বাম রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছে। জনগণের একটা বড় অংশের কাছেও সেক্যুলার মতাদর্শ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

পশ্চিমবঙ্গে সেক্যুলার মতাদর্শ কখনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। পশ্চিমবঙ্গে ৩০শতাংশ জনগোষ্ঠী ধর্মীয় ভাবে সংখ্যালঘু—যার মধ্যে ২৭ শতাংশের উপরে হল মুসলমান। এ ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠী সেক্যুলার মতাদর্শের সবচেয়ে বড় সমর্থক।

কংগ্রেস, তৃণমূল, এমনকি বিজেপি চর্চার ক্ষেত্রে না হলেও, তাত্ত্বিকভাবে কখনো ভারতের মূল আদর্শ, সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধাচারণ করেনি। ফলে বাংলাদেশের বামদের মত পশ্চিমবঙ্গে বাম দলগুলোকে বৈরি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে থেকে রাজনীতি করতে হয়নি।

বাংলাদেশে যেখানে বামদলগুলো সাংগঠনিক ভাবে অত্যন্ত দুর্বল, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) এখনো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী,যার শিকড় তৃণমূলে প্রোথিত। এত বড় সাংগঠনিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, তাদের আসন শূন্যতে কেন নেমে আসল, এ নিয়ে অনেকে  চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থা থেকে সিপিআই (এম) কি নিজেদের ফেরাতে পারবে, নাকি তাদের অবস্থাও বাংলাদেশের বামপন্থীদের মত রাষ্ট্র ও সমাজে চরম প্রান্তীয় অবস্থানে চলে যাবে?

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে গণআন্দোলনের ফলে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ক্ষমতাচ্যুত হবার পর সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে একটা বড় ধাক্কা লাগে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ  যে সমস্ত দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাসীন ছিল না, সে সমস্ত দেশের পার্টিগুলি ভাঙ্গনসহ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়, যা থেকে পরিত্রানের পথ বামপন্থীরা এখনো বের করতে পারেনি।

তাত্ত্বিক ভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও সিপিআই (এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো ভারতে ভোটের হিসাব বা জনসমর্থন, কোন দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সোভিয়েত পতনের পর ২০০৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে সিপিআই (এম) তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৩টি আসন লোকসভাতে পায়।

কিন্তু এরপর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মত জাতীয় নির্বাচনেও তাদের আসন দ্রুত কমে যেতে থাকে, যা বর্তমানে মাত্র তিনটাতে এসে ঠেকেছে। অর্থাৎ, শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও সিপিআই (এম) তথা বাম রাজনীতির ভবিষ্যত আজকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।

সোভিয়েত পতন পরবর্তী সারা দুনিয়াতে যখন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নাভিশ্বাস অবস্থা, সেসময় সিপিআইর (এম) ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে ভালো করেছে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সেই তাদের এখন এমন কী হল যে, ভারতে বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গে আজকে তাদের রাজনীতি ধরে রাখাই দায় হয়ে উঠেছে।

পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতে সিপিআই(এম) এর আজকে সবচেয়ে বড় যে সঙ্কট, সেটা হল নেতৃত্বের সঙ্কট। জাতীয় রাজনীতিতে হরকিষাণ সিং সুরজিত বা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর মত নেতা তারা আর তৈরি করতে পারেনি।

জ্যোতি বসুর ইমেজের জোরেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দুটো নির্বাচনে বামফ্রন্টকে উৎরে এনেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব পরবর্তী সময়ে মানুষ আস্থা রাখতে পারে বা নির্ভর করতে পারে, এমন কোন নেতৃত্ব সিপিআই(এম) থেকে আর উঠে আসেনি।

দশ বছরের অধিক সময় বামফ্রন্ট ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে তৃণমূলের নানা দুর্নীতি, অনাচার, সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে সুবিধা লাভ–এসবের বিরুদ্ধে গণমানুষকে সংগঠিত করে তারা কোন আন্দোলন/সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি।

অপরদিকে, বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল, তাদের নানা ডান ঘেঁষা অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাই তাঁর দলকে জনমানুষের আস্থাভাজন করে তুলেছিল।

রাষ্ট্র সেক্যুলার হলেও ভারতের সমাজ কাঠামোর সেক্যুলার রূপান্তর কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট ঘটাতে পারেনি। ভারতীয় সমাজ কাঠামোতে একটা শক্তিশালী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আবহ বা সংস্কৃতির উপস্থিতি সব সময়েই ছিল।

এ আবহ বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট সে অর্থে লড়াই করেনি।রাষ্ট্র সেক্যুলার—এ বিষয়টাই তাদের কাছে মুখ্য ছিল। অপরদিকে, কংগ্রেস সাম্প্রদায়িকতার সংস্কৃতিকে নানা ভাবে ব্যবহার করেছে, তাদের রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসাবে।

বিজেপিসহ সংঘ পরিবার, আন্তোনিও গ্রামসি যেটাকে বলেছেন passive revolution বা নীরব বিপ্লব, তার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সংস্কৃতিকে সমাজ কাঠামোর অনেক গভীরে প্রোথিত করেছে—যার শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আজ সারা ভারতে “হিন্দুত্ববাদের” ব্যাপক উত্থান ঘটেছে।

আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের রাজনীতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে–সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সংস্কৃতির শক্তিশালী হেজিমনিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে–সমাজ কাঠামোর সেক্যুলার রূপান্তর ঘটাবার লক্ষ্যে, কাউন্টার হেজিমনিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবার উপর।

এছাড়া যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল,গণমানুষকে সাথে নিয়ে আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম গড়ে তোলা। এটি করতে পারলে, এর ধারাবিকতায় নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

উল্লেখ্য, সিপিআই (এম) এবার এক ঝাঁক তরুণ নেতৃত্বকে মনোনয়ন দিলেও তাঁদের কেউই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তরুণ নেতৃত্বকে তাই ভাবতে হবে, কীভাবে জনগণের দাবী দাওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাথে একাত্ম হওয়া যায়। এটা করতে না পারলে, আগামী নির্বাচনেও তরুণদের মনোনয়ন দিয়ে কোন লাভ হবে না।

সর্বোপরি যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপির চেয়ে বামফ্রন্টের মৌলিক তফাৎটা কোথায়, সেটা স্পষ্ট করা।

ক্ষমতায় থাকাকালীন বামফ্রন্ট বড় দাগে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করেছে। সাথে থেকেছে কিছু সমাজ কল্যাণমূলক (Social welfare policy) কার্যক্রম। সেটা মমতার তৃণমূলও করেছে। ফলে, অন্য দলগুলোর চেয়ে কোন মৌলিক গুণগত পার্থক্যের দিক বামফ্রন্ট জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি।

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বয়স ১০০ বছরের বেশী হল। সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কথা কমিউনিস্ট পার্টি তার জন্মলগ্ন থেকে বলে আসছে। সোভিয়েত উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতে তারা সেটি কীভাবে বাস্তবায়ন করবে—এ বিষয়টি আজকে তাদেরকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করতে হবে।

এ সমস্ত বিষয়ে বামফ্রন্ট কী অবস্থান নিবে, তার উপরেই নির্ভর করছে আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে বাম রাজনীতির ভবিষ্যত।

______________________

ডঃ সাঈদ ইফতেখার আহমেদ, শিক্ষক, স্কুল অফ সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিস, আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেম, পশ্চিম ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।