শিল্প সাহিত্য

পরম্পরা

রবিন গুহ

২০০৬ সালের ৩জুন। সেদিন থেকেই আমার বাবা মহাকালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেলো। তবে, তাকে আমার বিদায় জানানো হয়নি। বাবা আমার হারিয়ে যাওয়া আকাশ। আমি এখন আকাশ খুঁজে বেড়াই। ঘরে-বাইরে, হাটে-মাঠে, গাঁয়ের পুকুরের পাড়ে যেখানে তার ছেলেবেলা কেটেছে, সেই পুকুর পাড়ের শ্মশান-স্মৃতিমন্দিরে যেখানে তার অস্হি-ভষ্ম রাখা, তার প্রিয় পটিয়া স্কুল, সিটি কলেজের প্রাংগন, তার কর্মস্হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সবখানেই …..!

তবুও জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে। আহার-নিদ্রা-মৈথুন সব কিছুই চলতে থাকে মানুষের। বাবা ইহধামে চলে যাবার কিছুদিন পরেই আমরা দু’ভাই মাকে নিয়ে পুরোনো ভাড়া বাসা ছেড়ে নিজের ‘ধামে’ এলাম। একেবারে পুরোনো সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসা। নিজের বাসা, নিজের সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট। যা কিছু পুরোনো হয়ে গেছে সব বদলে ফেলা। সব জমে থাকা ধুলো-বালি ঝেঁড়ে-মুছে সাফ করে ফেলা। কিন্তু মানুষ চাইলেই কি সবকিছু বদলে ফেলতে পারে! যাপিত জীবনের যে ধুলো মনের গভীরে আস্তরের মতো জমে থাকে, তা কি মুছে ফেলা যায়! চারিদিকে ঘর আলোকিত করার জন্য নানরকমের লাইট। তবুও অন্ধকার ছাপিয়ে আলোর জলকেলি চোখে পড়েনা!

ইতিমধ্যেই নিজের একটা সংসারও হলো।মানে, বিবাহিত জীবনে পা দিয়েছি। সবই আছে, ঘর-সংসার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। কোন কিছুরই তো অভাব নেই। চারিদিকে এত মানুষ, এত কিছুর আয়োজন, তবুও কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অন্ধকার ও যেন কিছুতেই যায়না! এমনতর অন্ধকার, কোনদিন দেখিনি! কেউই বুঝি কিছু টের পায়না! কিন্তু আমি যে ঠিক টের পাই।

অন্ধকার ঘর থেকে একদিন গভীর রাতে বেরিয়ে পড়ি। রাত কটা হবে! দুইটা আবার, তিনটাও হতে পারে। ঘুটঘুটে রাত। পন্চমীর চাঁদ আকাশে। কেন জানি সে ডুবে গিয়েও,ডুবে যায়নি! ধুলি-কাঁদা-মাখা মেঠো রাস্তা। সরু পথের দুপাশে নানারকম গাছপালা অনেক দূর অব্দি দেখা যায়। কোথাও একটা জোনাকিও চোখে পড়লনা। আজকাল জোনাকীরা যেন কোথায় পালিয়ে গেছে!। অনেকটা পথ হেটে যেতেই দূর থেকে ভেসে আসা চাঁপাফুলের একটা সুন্দর গন্ধ নাকে আসে। চাঁপাফুলের গন্ধ আমার ভীষণ প্রিয়। আমি গাছটির দিকেই এগিয়ে গেলাম। না,চাঁপার মাতাল গন্ধই আমাকে সেদিকে টেনে নিয়ে দেল! গাছটার একটু কাছে যেতেই আবছা আলোতে একজন অশীতিপর বৃদ্ধকে দেখলাম দাড়িয়ে আছে। অতটুকু আলোতে যতদূর দেখা যায় পোশাকে-বসনে বেশ মলিনই মনে হচ্ছে। মাথাটা নীচের দিকে তাক করা। মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছেনা। তবে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে! একদম কাছে গিয়ে ভাল করে তাকাতেই যা দেখলাম,ভীষণ চমকে উঠলাম! -একি বাবা! তুমি এখানে!

বাবার মুখ দিয়ে শব্দ বেরোল না। তবে কিছু কথা শব্দ ছাড়াও বোঝা যায়। বাবার বোবা, অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, অনেকদিন ধরেই এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে—চাঁপা ফুল গাছের নিচে। যাকে বলে দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রজনী। বাবা জানে, চাঁপা ফুল আমার অসম্ভব প্রিয় একটা ফুল। ফুলের ঘ্রানের টানে আমি একদিন এখানে আসবোই। বাবার হাতটা ধরে আমি আমাদের ‘ধাম’-এ নিয়ে আসার জন্য যাত্রা করলাম।

যখন বাসায় ফিরলাম, সবাই তখন ঘুমিয়ে। সবগুলি বাতিই নেভানো। চারিদিকে অন্ধকার। কিন্তু কী আশ্চর্য্য! যেই না বাবা ঘরে ঢুকলো, আমার সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেলো। সে কী যে আলো ঘরে, যেন আলোর ঝর্ণাধারা বয়ে যায়! দীর্ঘ সময় ধরে জেঁকেবসা অন্ধকার আজ পিছু হটতে বাধ্য হলো! কিন্তু সে আলোতে কারোরই ঘুম ভাংলো না! শুধু একলা আমি নির্ঘুম একটা রাত সেই মোলায়েম আলোতে ভিজতে ভিজতেই কাটিয়ে দিলাম।

মাস দশেক পরের কথা। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কে যেন বলল, অত দূরে কোথাও না গিয়ে চেরাগীর মোড়ে সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালেই ওকে ভর্তি করে দাও। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের অনেকেই কাছে থাকে, প্রয়োজনে অনেকেই গিয়ে সাহায্য করতে পারবে। সকাল এগারটার দিকে বৌকে ভর্তি করানো হল। রাত নয়টার দিকে সবাই অপেক্ষা করছি। নার্স বেরিয়ে এসে খবর দিলো, ছেলে হয়েছে! মা-ছেলে দুজনই ভাল আছে। পরদিন সকাল সাতটার দিকে আবার বাসা থেকে দৌড়ে গেলাম। কেবিনে ঢুকতেই দেখলাম,আমার মা সুন্দর একটা নকসী করা কাঁথাতে মোড়ানো দেবশিশু হাতে নিয়ে বলছে, দেখ দেখ, ছেলের মুখ দেখ! একদম তোর বাপের মতো। সেই মুখের গড়ন, সেই হাসি….!

ওর এখন দশ বছর। চেহারাতে বেশ মিল, বাবার মতই বেশ ফাঁক-ফাঁক দাঁত, স্বভাবেও বেশ মিল। আবেগী অথচ অর্ন্তমুখী, ইংরেজীতে যাকে বলে ইনটোভার্ট। সত্যিই বুঝি আমার বাবা ফিরে এলো! এখন একটাই চাওয়া আমি যেন ওর কাছে আমার বাবার মতই একজন বাবা হতে পারি। একদম ঠিক বাবার মতই একজন বাবা।

“Until you have a son of your own,you will never know the joy,the love beyond feeling that resonates in the heart of a father as he looks upon his sons .”

লেখক: রবীন গুহ, সাবেক ছাত্র নেতা।