মতামত

প্যালেস্টাইনে গনহত্যা ও বিশ্ব রাজনীতি

হাসান তারিক চৌধুরী

হাসান তারিক চৌধুরী

অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, প্যালেস্টাইনে জায়নবাদী ইসরাইলী বাহিনীর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড আর কতদিন চলবে? এই ভয়াবহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কি কোন বিচার হবে না? স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র আর কতদিন পরে দেখতে পাবো? সবার মতো এইসব প্রশ্ন আমারো। যুগ যুগ ধরে এইসব প্রশ্ন বুকে ধারন করেই আমাদের বয়স বেড়েছে। অনেকে এইসব প্রশ্ন অমীমাংসিত দেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আবার অনেকে শিশুকাল থেকে যৌবনকালে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অথচ, প্যালেস্টাইনের সঙ্কট যেই অন্ধকারে ছিল, সেই অন্ধকারেই রয়ে গেছে। গত কয়েক সপ্তাহে ইসরাইলী বাহিনী সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে ২৪৪ জনেরও বেশী নিরীহ প্যালেস্টাইনী নাগরিককে হত্যা করেছে। দুধের শিশু থেকে শুরু করে অতিবৃদ্ধ কেউই এ হত্যাযজ্ঞ থেকে বাদ যায় নি। পবিত্র আল-আকসা মসজিদে রোজাদার প্যালেস্টাইনি নাগরিকরা রমজান মাসের শেষ জুম্মার নামাজ অর্থাৎ জুমাআতুল বিদা আদা করতে গেলে প্রার্থনারত মানুষদের উপর নির্বিচার গুলি চালায় ইসরাইলী বাহিনী। এরপর থেকে সংঘাত ভয়ানক আকার ধারন করে। জায়নবাদী ইসরাইলী বাহিনীর এই নৃশংস মানবতা বিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সারাদুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ বিশেষ করে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে। বাংলাদেশেও কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা এই হামলার রাজপথে ও ভার্চুয়াল মাধ্যমে নানা প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। প্যালেস্টাইনের পক্ষে এরকম বিশাল বিশ্ব জনমতকে পদদলিত করে ইসরাইলী বাহিনী তাদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে এবারের সংঘাতকে বলা হচ্ছে ২০১৪ সালের পর সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত। ২০১৪ সালের ওই সংঘাতে দুই হাজার ২৫১ প্যালেস্টাইনী নিহত হন। ইসরাইলের পক্ষে প্রাণহানি ছিল ৭৪, যাদের অধিকাংশই সেনাসদস্য।

১১ দিনের রক্ত ঝরানো সংঘাত শেষে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সন্ধি চুক্তি  সম্পাদিত হয়েছে।  গত ২০ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা থেকে (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোর ৫টা) এটি কার্যকর হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ইসরাইল ও হামাস উভয়পক্ষ বলেছে— অস্ত্রবিরতি চুক্তির কোনোরূপ লঙ্ঘন হলেই শক্ত জবাব দেওয়া হবে। মধ্যস্থতাকারী মিসর জানিয়েছে, অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণে দুই জায়গায় দুটি প্রতিনিধিদল পাঠাবে তারা।

এদিকে ১১ দিনের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গাজায় গত ১১ দিন ধরে প্যালেস্টাইনীরা ইসরাইলি হামলার আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় পার করছেন প্রতিটি মুহূর্ত।  অস্ত্রবিরতির খবরে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন।  তারা গাজার রাস্তায় নেমে আসেন।  মসজিদগুলোর মাইকে মাইকে ঘোষণা করা হয়, ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিজয় অর্জিত হয়েছে। অস্ত্রবিরতির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে প্যালেস্টাইন সরকার।  গত ১১ দিনের হামলা চলাকালে প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ভূমিকা অনেকটাই গুরুত্বহীন ছিল। হামাস-ফাতাহ দ্বন্দ্বে পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ক্ষমতাসীন ফাতাহ দলের নিযুক্ত ফিলিস্তিন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়েহ বলেন, ‘মিসরের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শক্তির যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সাফল্যকে আমরা স্বাগত জানাই।’  ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে এবারের সহিংসতায় ২৪৪ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গাজা ও পশ্চিমতীরে ইসরাইলি হামলায় অন্তত ২৩২ প্যালেস্টাইনী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি নারী ও শিশু।  নিষ্পাপ ৬৫ শিশুকে হত্যা করেছে তারা।  আহত হয়েছে এক হাজার ৭০০ জনের বেশি প্যালেস্টাইনের। ইসরাইলের দাবি, গাজায় তাদের হামলায় কমপক্ষে ১৫০ জন ‘সন্ত্রাসী’ নিহত হয়েছে।  অবশ্য ইসরাইলি হামলায় সংগঠনের সদস্যদের প্রাণহানির বিষয়ে হামাস কোনো তথ্য দেয়নি। ইসরাইলের ভাষ্য, সংঘাতে গাজা থেকে প্রায় চার হাজার রকেট ছোড়া হয়েছে।  রকেটে দুই শিশুসহ অন্তত ১২ ইসরাইলি নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে অন্তত ৩৩০ জন।সংঘাতে ইসরায়েল ও হামাস উভয় পক্ষ নিজেদের জয় দাবি করেছে।  যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর পরই গাজার রাস্তায় নেমে আসেন প্যালেস্টাইনেররা।  তারা স্বস্তি ও উল্লাস প্রকাশ করেন।ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবিরতি প্রকৃত সুযোগ এনেছে।স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ইসরাইলের রাজনৈতিক নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা আসে।  তার পরই হোয়াইট হাউসে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন বাইডেন।ইসরাইলি মন্ত্রিসভার বিবৃতিতে বলা হয়, মিসরের দেওয়া সমঝোতা প্রস্তাব অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতিতে তারা সম্মত। তবে এই যুদ্ধবিরতি হবে ‘দ্বিপক্ষীয় ও শর্তহীন’।

অনেকের ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখন ক্ষমতাসীন। ফলে প্যালেস্টাইন ইস্যুতে বিরাট অগ্রগতি দেখা দেবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, জো বাইডেনের দল শ্রেণীগত বিচারে শ্রমিকশ্রেনীর দল নয়। রিপাবলিকান দলের শ্রেণী চরিত্র ও ডেমোক্র্যাট দলের শ্রেনী চরিত্রের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু সেটি সব সময়ই বিবেচনায় রাখতে হবে। যে কারনে, বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলী বাহিনীর সাম্প্রতিক হামলার কোন আনুষ্ঠানিক নিন্দা করে নি। একথা ঠিক যে, বেশ কিছু বড় বড় যুদ্ধ বিরোধী গ্রুপ ডেমোক্র্যাট দলের ভেতরে ক্রিয়াশীল। তাঁরা হয়তো সে দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেটিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনের বিকল্প ভাবা খুবই ভুল হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, এর পর কি? বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, প্যালেস্টাইনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আগামী ২৭ মে একটি বিশেষ অধিবেশনে বসছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ। খুব সঙ্গত কারনেই প্রশ্ন ওঠে, প্যালেস্টাইনের সমস্যা কি শুধু মানবাধিকারের আলোচনার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকবে? নাকি এর একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথেও এগুতে হবে? একবিংশ শতকে এসে বছরের পর বছর এরকম হত্যাকাণ্ড সারা পৃথিবীর মানুষ আর দেখতে চায় না। সকলেই জানেন, বেলফুর ঘোষণার মাধ্যমে অন্যায়ভাবে ইসরাইলী রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার মধ্যদিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ  যে ঐতিহাসিক পাপ সংঘটিত করেছিল। সেটির ভেতরেই আজকের প্যালেস্টাইন সঙ্কটের জন্ম। অতি সংক্ষেপে ইতিহাসটি হলো, প্যালেস্টাইনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকা। সেখানে ১৯৩০’র দশকে পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদীরা কৃষি খামার গড়ে তুলেছিল।ইহুদিদের পাশেই ছিল প্যালেস্টাইনী আরবদের বসবাস। সেখানে আরবদের কৃষি খামার ছিল। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে বসবাস করছিল। সে সময় মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।

ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০,৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী প্যালেস্টাইন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল বৃটেন বিরোধী জোটে৷ তখন যুদ্ধ জয়ে প্যালেস্টাইনদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন৷ যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত৷ যেহেতু আরবরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই তারা ধরে নেয়৷ কিন্তু এই ঘোষণার মাঝে বৃটিশদের যে বিরাট ধাপ্পাবাজি লুকিয়ে ছিল তা প্যালেস্টাইনীরা বুঝতে পারেনি৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর বৃটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে৷ মূলত এই সময়টিই প্যালেস্টাইনকে আরব শূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্র ৷ ব্রিটিশরা একদিকে ইহুদিদের জন্য খুলে দেয় প্যালেস্টাইনের দরজা, অন্যদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা প্যালেস্টাইনীদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেক প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন৷ তার মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ প্যালেস্টাইনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে৷ কিন্তু ১৯৩০’র দশকে প্যালেস্টাইনীরা টের পেলো যে তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে-দলে সেখানে আসছে এবং জমি ক্রয় করতে শুরু করেছে। ১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্যালেস্টাইনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, প্যালেস্টাইনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে। এভাবেই নিজভূমে পরবাসী হয় আরবরা আর দখলদার জায়নবাদীরা গড়ে তোলে ইসরাইল নামক এক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। ১৯৭৪ সালের আরব লীগের সম্মেলন, ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালের অসলো চুক্তির অভিজ্ঞতা থেকে আজ এটি প্রমাণিত যে দুটি পৃথক রাষ্ট্র অর্থাৎ একদিকে স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র এবং অপরদিকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অনুগত ধর্মনিরপেক্ষ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নাই। তাই ব্রিটিশ-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী চক্রের বিরুদ্ধে এবং প্যালেস্টাইনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের স্বপক্ষে আমাদের মানবিক সাহায্য-আন্তর্জাতিক সংহতি আরো জোরদার করতে হবে।

[ হাসান তারিক চৌধুরীঃ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং বিশ্ব গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ]