মতামত

১৩৭তম মে দিবস এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

-ফজলুল কবির মিন্টু

১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট চত্বরে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে শ্রমিকরা সমাবেশ করে। সমাবেশ চলাকালে পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়।
উক্ত ঘটনাকে স্মরণ করে ১৮৯০ সাল থেকে ১লা মে বিশ্বব্যাপী অন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। মূলত তখন থেকে বিশ্বব্যাপী ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস স্বীকৃতি পায়। অর্থাৎ দিনের ২৪ ঘটা সময়কে তিনভাগে ভাগ করা হয়। শ্রমিক দিনের তিন ভাগের একভাগ  মালিকের জন্য শ্রম দিবে। একভাগ নিজের জন্য কাজ করবে এবং বাকী এক ভাগ শ্রমিক ঘুম যাবে  এবং বিশ্রাম নিবে।

১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) গঠিত হওয়ার পর তার গৃহীত ১ম কনভেনশনটি হচ্ছে, দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম বিষয়ক। এই কনভেশনটিতে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এ এর ধারা ১০০তে  ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের বিষয় উল্লেখ আছে। কিন্তু এ যেন, কাজির গরু খাতায় আছে কিন্তু কিন্তু গোয়ালে নাই অবস্থার মত। কেননা আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এই ব্যাপারে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ – বিলস কর্তৃক উপস্থাপিত  এক প্রতিবেদনের তথ্য আলোচনা করলে বিষয়টি কিছুটা পরিস্কার হবে।

বিলস’র উক্ত প্রতিবেদন ছিল নিরাপত্তাকর্মী, পরিবহনকর্মী, হোটেল/রেস্তোরাঁ শ্রমিক, রি-রোলিং মিলের শ্রমিক এবং হাসপাতাল/ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শ্রমিকদের উপর। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ৮০% শ্রমিককে দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বাধ্য করা হয়। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, দূরপাল্লার পরিবহন খাতের শতভাগ শ্রমিকই দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করে। এছাড়া রি-রোলিং এর ৯২ ভাগ, হোটেলের ৯৮ ভাগ, হাসপাতালের ৪২ ভাগ ও নিরাপত্তাকর্মীদের ৮০ ভাগ শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এছাড়া আরো উল্লেখ করা হয় নিরাপত্তাকর্মীদের ৬৬ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না; ৮৮ ভাগ মে দিবসে ও ৮৬ ভাগ সরকারি ছুটির দিনে ছুটি পান না। এই প্রতিবেদনটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত হলেও বাস্তবতা এখনো পরিবর্তন হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হয়তো আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রাথমিকভাবে দুইটা প্রধান কারনে আমাদের দেশে এ সমস্যা আজও বিরাজমান। একটা কারন হচ্ছে, পুঁজিবাদের ধর্মই  হচ্ছে প্রয়োজন থাকলেও মোট শ্রম শক্তিকে সে তার শ্রম বাজারে ব্যাবহার করে না। কাজে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকলেও শ্রম দিতে সক্ষম এরকম একটা বড়  অংশকে সে কৃত্রিমভাবে কাজের বাহিরে রেখে দেয়ার চেষ্টা করে। এতে কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকেরা দেখতে পায় তারা কাজ না করলেও বাহিরে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক অপেক্ষামান আছে। ফলশ্রুতিতে মালিক  অনায়াসে কম মজুরিতে শ্রমিক পেয়ে যায় কিংবা কম মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার জন্য মালিকের দর কষাকষির সুযোগ তৈরি হয়। দ্বিতীয় কারন হচ্ছে, যেহেতু শ্রমিক কম মজুরিতে কাজ করে সেহেতু শুধু ৮ ঘণ্টা শ্রমের মজুরির উপর ভর করে বেশীরভাগ শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। তাকে জীবন জীবিকার জন্য বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত শ্রমের মজুরির উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে আমাদের কাছে মনে হতে পারে শ্রমিকের জীবন ধারনের স্বার্থেই তাকে ৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।

তাই দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রম প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে জীবন ধারনের মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। এজন্যই হয়তো আমরা দেখতে পাই,  সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ এর ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদ, ১৯৬৫ সালের অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ৭ম অনুচ্ছেদ এবং আই এল ও’র কনভেনশন ১৩১ এ একজন শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করে যাতে সে আত্ম সম্মান নিয়ে জীবন যাপন করতে পারে ও তার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, এমন মজুরী নির্ধারন করার কথা বলা হয়েছে।

একথা আজ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যতদিন শ্রমিক শ্রেণির ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত হবেনা ততদিন পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় স্বদেশের জন্ম। এদেশের মূল চেতনা হচ্ছে জনকল্যাণমূলক -আর একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে জনগণের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব অধিকার পূর্ণ করার সূযোগ সৃষ্টি করা। জনগনের বৈষয়িক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির যোগান দেবে রাষ্ট্র ও তার নানা সংগঠন ও সংস্থা।  কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ এসব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাহিদা থাকে অপূর্ণ। তার স্বজন ও সন্তান সন্ততিরাও অপ্রাপ্তির একই চক্রে আটকে থাকে।

আমাদের মনে রাখতে হবে একজন শ্রমজীবী কেবল শ্রমদাস নয়। তার হাত দিয়েই ভোগের উপকরন সৃষ্টি হয়। আজকের বিশ্বসভ্যতার যে এগিয়ে চলা তার ভিতটিও নির্মাণ করেছে শ্রমজীবী মানুষ। কাজের নির্দিষ্ট সময় ও ন্যায্য মজুরী এজন্যই প্রয়োজন যাতে কর্মজীবী মানুষ পরিপূর্ণ বিশ্রাম, বিনোদনের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। এটি কেবল তার কর্মক্ষমতাই বাড়ায় না বরং তাকে মানসিক তৃপ্তিও দেয়। সে মনে করে তার ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো হচ্ছে।

লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক