সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড: বাংলাদেশে রাসায়নিক দ্রব্য নিরাপদে রাখতে নিয়ম কানুন কতটা আছে

বাংলাদেশে শিল্প খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন, পরিবহন ও গুদামজাতকরণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বিধি বিধান না থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মতো করেই নিরাপত্তা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে।
যদিও বিস্ফোরক অধিদপ্তর বলছে তারা যেসব প্রতিষ্ঠানকে আমদানির জন্য লাইসেন্স দেয় তাদের একটি গাইডলাইন দেওয়া হয় এবং কখনো কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষণাগারগুলো তারা পরিদর্শনও করে থাকে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে কিংবা কোথায় কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে সে সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি বিধান না থাকায় প্রায়শই ছোটো বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।
শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৪৬ জন নিহত হবার পর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আবারো প্রশ্ন উঠেছে।
এর আগে ২০১০ সালের ৩রা জুন পুরনো ঢাকর নিমতলীতে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে আগুন লেগে ১২৪ জন মারা গিয়েছিলো।
কিন্তু তারপরেও সারাদেশে বিশেষ করে বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা আরও নিখুঁত করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।

সীতাকুণ্ডের ডিপোতে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসকে পর্যন্ত ডিপোতে থাকা রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে ধারণা দেয়া যায়নি। ফলে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন ফায়ার ফাইটার।
বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন সবার জন্য প্রযোজ্য হবে এমন কোন বিধি বিধান বা গাইডলাইন রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষেত্রে নেই, বরং বিভিন্ন জায়গার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
“প্রত্যেকটি কেমিক্যালের সাথেই একটি গাইডলাইন সাঁটানো থাকা দরকার যে এটিকে কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে, কোথায় কিভাবে রাখতে হবে। কিন্তু এগুলো নিশ্চিত করার কোন প্রক্রিয়া বা নির্দিষ্ট কোন নিয়ম কানুন নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
অর্থাৎ এগুলো আসলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে ঠিক করে। অপর্যাপ্ত লোকবল নিয়ে সেগুলো মাঝে মধ্যে যাচাই করে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা এ ধরনের আরও কিছু প্রতিষ্ঠান।

বিস্ফোরক অধিদপ্তর যা বলছে
বাংলাদেশের শিল্প খাতে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় সেগুলোর ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব বিস্ফোরক অধিদপ্তরের।
সরকার ৫৪টি কেমিক্যালকে শিল্পখাতের জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবে আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে এবং এগুলো আমদানির জন্য লাইসেন্স দিয়ে থাকে বিস্ফোরক অধিদপ্তর।
প্রতিষ্ঠানটির উপপ্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ডঃ মোঃ আব্দুল হান্নান বিবিসি বাংলাকে বলছেন প্রতিষ্ঠানগুলো কেমিক্যাল আমদানি করে নিজেদের গুদামে রাখে এবং তারাও মাঝে মধ্যে এ ধরনের গুদাম পরিদর্শন করেন।
“সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন না থাকলেও লাইসেন্স দেয়ার সময় ও পণ্য আমদানির সময় আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গাইডলাইন দিয়ে থাকি কোথায় কিভাবে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলো নিজেদের মতো করেই এসবের ব্যবস্থাপনা করে থাকে।
অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন একেক ধরনের কেমিক্যাল একেকভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটি ঠিক মতো অনুসরণ করা হয় না।
অর্থাৎ কোন কেমিক্যাল কোথায় রাখতে হবে, কোনটির কাছে কোনটি রাখা যাবে না, কিংবা গুদামগুলোর প্রকৃতি কেমন হবে বা ভেন্টিলেশন সিস্টেম কেমন হবে সে সম্পর্কিত কোন নিয়ম কানুন নির্দিষ্ট করা নেই।

কত জায়গায় রাখা হয় রাসায়নিক দ্রব্য
বাংলাদেশে প্রায় সব ধরনের শিল্পখাতেই বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে গার্মেন্টস, ঔষধ, অটোমোবাইলস, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ইলেকট্রনিকসসহ কয়েকটি খাতে রাসায়নিক দ্রব্য বেশি দরকার হয়।
বাংলাদেশে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো ছাড়াও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাসায়নিক গুদাম আছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরেও রাসায়নিক গুদাম আছে।
এর বাইরে নিমতলীসহ কিছু জায়গায় নানা ধরনের শিল্প-ভিত্তিক রাসায়নিক দ্রব্য বেচাকেনা হয় বলে সেসব এলাকাতেও অনেকে নিজস্ব গুদামে এগুলো সংরক্ষণ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ জাতীয় কর্তৃপক্ষ, রাসায়নিক অস্ত্র কনভেনশনের (বিএনএসিডব্লিসি) এর একটি বিশেষজ্ঞ দল গত বছর বিমানবন্দর, নৌ বন্দর ও স্থলবন্দরের গুদামগুলো পরিদর্শন করে কিছু গাইডলাইনও দিয়েছিলো।
এ তথ্য দিয়ে তখন আইএসপিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিলো যে বাংলাদেশে শিল্প-ভিত্তিক অর্থনীতির ব্যাপক প্রসার ঘটছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় রাসায়নিক দ্রব্যের চাহিদাও ব্যাপক হারে বেড়েছে।
“এ বর্ধিত চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন দেশ হতে বাংলাদেশে স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দর দিয়ে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক দ্রব্য দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং তা অনেক সময়ই বিভিন্ন কারণে বন্দরে মজুদ থাকে। তাই বন্দরে এসব মজুদকৃত রাসায়নিক দ্রব্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না হলে যেকোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।”
অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলছেন ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংস্থাগুলো নিজেদের মতো কাজ করছে কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকা দরকার যাতে করে প্রতিটি কেমিক্যাল যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে ধরনের প্রটোকল অনুসরণ করে
বাংলাদেশের শ্রম আইনে শ্রমমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় শিল্প, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের বিধান আছে যার মূল উদ্দেশ্য শিল্পখাতে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা।
তাদের নীতিমালা অনুসরণ করে বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির সাথে মিলিয়ে রাসায়নিক দ্রব্যের বিষয়ে কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করেছে।
এছাড়া বাংলাদেশ কেমিক্যাল কর্পোরেশনের একটি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা আছে।
যদিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ক্ষেত্রে মূলত তাদের বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা বিধি তৈরির চেষ্টা করে।
তবে কারখানার অভ্যন্তরে অনেক ক্ষেত্রেই এসব নিয়ম কানুন যথাযথভাবে পালন করা হয় না বলে অভিযোগ আছে।
একাধিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে যে তাদের দরকারি রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়া তারা অনুসরণ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে কারখানার মধ্যে কেমিক্যাল সরবরাহকারী, ব্যবহারকারী ও ব্যবহারের সাথে জড়িতদের মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি কেমিক্যালের সঠিক ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
কারখানায় কেমিক্যালের ধরন ও চরিত্র অনুযায়ী সঠিক তাপমাত্রায় আলাদা সংরক্ষণ এবং ক্রেতাদের নিষেধাজ্ঞা আছে এমন কোন রাসায়নিক দ্রব্য না কেনার কথা বলা হয়েছে।
এই গাইডলাইনে বলা হয়েছে যে কেমিক্যালের কনটেইনার বা জারের গায়ে সন্নিবেশিত গাইডলাইন অনুযায়ী সব কেমিক্যাল সংরক্ষণ করতে হবে এবং সব কেমিক্যাল কমপেটেবেলিটি পৃথক পৃথক চেম্বারে সংরক্ষণ করতে হবে।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা