মতামত

‘ যে ফুল না ফুটিতে’

-সুভাষ দে

স্কুল কিংবা খেলার মাঠ থেকে শিশু-কিশোররা ফিরবে মায়ের কাছে-না, সে সন্তানরা সড়কে দুর্ঘটনায় লাশ হয়ে ফিরছে ঘরে, কখনো সন্তানকে স্কুলে দিয়ে মা-বাবা দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যুবরণ করছে, এসব নিত্যদের চিত্র। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বা সন্তান ঘর থেকে বেরুলে স্বজনরা নিরাপদে ফেরার উৎকণ্ঠায় থাকেন। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন এরূপ বিষাদগাথা রচিত হচ্ছে স্বজন হারানো ঘরে কিন্তু কোথাও মানুষের শোকের, বেদনার বিষাদের আঁচড় লাগছে না। সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয় কিংবা বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি), মালিক-শ্রমিক সংগঠন কেউ কোনো দায় নিচ্ছে না এসব মৃত্যুর।
সম্প্রতি রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ‘সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু নিহত’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত ২৮ মাসে ১ হাজার ৬৭৪ শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে (সূত্র: দেশ রূপান্তর, ২০ মেÑ২০২২)। সে হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে মারা যায় ৬০ শিশু। তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া আসার সময় দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৭৩১ শিশু। মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ধরে হাঁটার সময় গাড়ি চাপায় বা গাড়ির ধাক্কায় বেশি শিশু মারা গেছে। এদের সংখ্যা এক হাজার ২৭।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয় ‘গ্রামীণ সড়কে শিশু বেশি হতাহত হচ্ছে, গত ২৮ মাসে মারা গেছে ৮৮৯ শিশু। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে গ্রামীণ সড়কের অধিকাংশই বাড়িঘেঁষা, গ্রামীণ সড়কে চলাচলকারী যানবাহন কোনো নিয়ম মানে না, অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্করা গ্রামীণ সড়কগুলিতে চালকের আসনে, শিশুরা সড়ক ব্যবহারের নিয়মনীতিও জানেনা, শিশুদের অভিভাবক কিংবা পরিবারের লোকজনের এ ব্যাপারে সচেতনতার অভাবও রয়েছে’। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বা স্থানীয় প্রশাসনের শিশুমৃত্যু নিয়ে উদ্বেগও নেই। শিশুরা বাড়ি থেকে বেরুলেই রাস্তা, রাস্তায় তারা খেলা করে, স্কুলে যাওয়া আসা করে, গ্রামীণ সড়কগুলো একেত সরু, রাস্তায়ও নানা গর্ত, সংস্কার নিয়মিত হয় না। গ্রামীণ সড়কে এখন অটোরিকশা, রিকশা, টেম্পো, ছোট ভ্যান ছাড়াও ভারি যানবাহনও চলাচল করছে। গ্রামে ঘরবাড়ি স্থাপনা উঠছে, নানা উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে, নির্মাণসামগ্রী ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে মিনি ট্রাক, বড় ট্রাক গ্রামের রাস্তা দিয়ে ছুটছে, এই সড়কগুলিতে ফুটপাতও নেই হাঁটার, রাস্তার ওপর দিয়েই চলতে হয়। একটু অসতর্ক হলে বিপদ, দুর্ঘটনা, মৃত্যু অবধারিত। শহরে ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা নেওয়া করেন অভিভাবক, গ্রামে শিশুরা নিজেরাই চলাফেরা করে স্কুল, দোকান, হাটবাজারে। গ্রামীণ সড়কে দুর্ঘটনায় আহত হলে হাসপাতালে কিংবা নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার সময় যানবাহনও থাকেনা, আবার দরিদ্র পরিবার বলে সন্তান স্বজনদের দ্রæত চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়ে ওঠে না। নিহত কিংবা আহত পরিবার কোন প্রকার সাহায্য, ক্ষতিপূরণ পায় না। যানবাহন চালককে ধরবে কে? রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গ্রামীণ সড়কে মৃত্যুর যে তথ্য দিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তা আরও অনেক বেশি। এসব সড়কে সব মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে আসে না। ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা উপজেলা প্রশাসনে মৃত্যু কিংবা আহতের পরিসংখ্যানও নেই। সব ঘটনার তো মামলা হয় না, ফলে যানবাহন চালকেরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যায়।
সংস্থাটির তথ্যে দেখা যায় গত মার্চ, এপ্রিল মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী বেশি। এপ্রিলে মৃত্যু ৬১ জনের, মার্চে ৭৪ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সড়কে শিশু এবং শিক্ষার্থীদের মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনা খুবই মর্মান্তিক এবং উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী মহাসড়ক, জেলাÑউপজেলা সড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বেশি। অতিরিক্ত বেগ, প্রতিযোগিতা, অদক্ষতা, অসতর্কতা দুর্ঘটনা ডেকে আনে। মানব সম্পদের এই ক্ষয় জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। সম্ভাবনাময় কত শিশু কিশোর তরুণ অকালে ঝরে পড়ছে অথচ সমাজ কিংবা রাষ্ট্র এ নিয়ে খুব একটা ভাবছে না। সরকারের মন্ত্রণালয় কিংবা নানা সংস্থা কেউ এসব মৃত্যুর দায় নিচ্ছে না।
সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি, সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কিংবা যানবাহন মালিক, শ্রমিক সংগঠন কেউ কোন এসব অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর দায় নিচ্ছেনা। অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক, লাইসেন্সবিহীন চালক গাড়ি চালাচ্ছে। সড়ক মহাসড়কে কম গতির যানবাহন চলছে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, চালকদের মাদকাসক্তি, নির্ঘুম গাড়ি চালনা এসব দেখার কেউ নেই। শহরের ফুটপাত হকার ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের দখলে, ছেলে মেয়েদের বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে স্কুল কলেজে যেতে হচ্ছে। গ্রামে বাড়ি থেকে বেরোলেই রাস্তা, মহাসড়কের পাশে অনেক স্কুলÑকলেজ, মহাসড়কে ফুটপাত নেই, ছোট যানবাহনের জন্য সার্ভিস লেন নেই, রাস্তা পারাপারে বিশেষজ্ঞ মতে ৫০০ মিটার পরপর আন্ডারপাস থাকা প্রয়োজন। যারা সড়ক বানাচ্ছেন তারা এসব বিষয় চিন্তা করছেন না। মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই রাস্তা চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে অথচ সড়কের নির্মাণ ব্যয় প্রতিবেশি দেশগুলিত বটেই, অনেক উন্নত দেশের চাইতেও বেশি। সড়ক দুর্ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ। প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, নগরের ফুটপাতগুলি অবৈধ দখলমুক্ত করা, মহাসড়কে ৫০০ মিটার পর পর আন্ডারপাস নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পরিবার থেকে শিশুদের সড়ক ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। (দেশ রূপান্তর ২০ মে-২০২২)।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন’২০১৮ এর কোনো কার্যকর প্রয়োগ নেই। এতদসংক্রান্ত আইনটি পর্যালোচনায় আটকে আছে। যানবাহন মালিক, শ্রমিক সংগঠনের নেতারা নিজেদের মতো করে বক্তব্য দিচ্ছেন গণমাধ্যমে কিন্তু নিজেদের অবহেলা, দায়িত্বহীনতার বোঝা অন্যের ঘাড়ে চাপান। কেন মালিক ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে তুলে দেন মহাসড়ক, জেলা উপজেলা সড়কে ট্রাক, বাস, কাভার্ডভ্যানে চাপা পড়ছে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, পথচারীÑস্বজনÑহারানোদের বিলাপÑআর্তনাদে ভারী হচ্ছে আকাশবাতাস। কত বিষাদ ছেয়ে আছে এসব পরিবারে। প্রতিটি অনভিপ্রেত মৃত্যু, অকাল বিয়োগ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেয়, কেউ কি কোনো দায় নেবে না এসব ট্রাজেডির! যে নিষ্পাপ, ফুলের মতো শিশুরা না ফোটার আগেই ঝরে পড়ছে তা কি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বোধিতে কোনো আঁচড় কাটবে না?
লেখক : সাংবাদিক