বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪৩)

– বিজন সাহা

বিবর্তন – এটা প্রকৃতির ধর্ম। প্রকৃতি অনবরত পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হচ্ছে। শুধু প্রকৃতি নয়, পরিবর্তিত হচ্ছে মহাবিশ্ব। ধারণা করা হয় যে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে আজ থেকে প্রায় ১৩৮০ কোটি বছর আগে জন্ম নিয়েছিল আমাদের মহাবিশ্ব। তারপর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেখানে জন্ম নিয়েছে গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে এসব সম্পর্কে পাল্টিয়েছে আমাদের ধারণা। ৫০০ বছর আগেও ধারণা করা হত যে সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র এসব পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। একে বলা হত ভূকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব। পরে তার স্থান দখল করল সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব যখন বলা হল যে সব কিছু ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। এরপরে আমরা জানলাম সূর্য কোটি কোটি নক্ষত্রের একটা মাত্র। সেও ঘুরছে মিল্কি ওয়ের কেন্দ্রকে ঘিরে। আর বর্তমানে আমরা জানি মহাবিশ্বের কোন কেন্দ্র নেই, প্রতিটি বিন্দুই তার কেন্দ্র হতে পারে। অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু এটা কোন কল্পনাবিলাস নয়, এটা জীবনের বাস্তবতা। প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য আসছে আমাদের জীবনে আর এই নতুন তথ্যের ভিত্তিতে বদলে যাচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বদলে যাচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের ব্যাখা।

 

এই বিবর্তনের সূত্র ধরেই এক কোষী প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে জীব জগতের উদ্ভব, অন্তত বিজ্ঞান সেটাই মনে করে। শুধু মনেই করে না, সেটা মনে করার পেছনে তার অনেক শক্তিশালী ভিত্তিও তার আছে। তাই অনেক মনীষীই বলেছেন মহাবিশ্বে পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। শুধু জীব জগতেই নয় পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ জীবন, একটার পর একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্তর অতিক্রম করে আজ আমরা সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু এই বিবর্তন ঘটে বিভিন্ন রকমে, কখনও পরিমাণগত কখনওবা গুনগত। পরিবর্তন যখন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণগত অবস্থায় পৌঁছে তখন তার গুনগত পরিবর্তন ঘটে। এটা অনেকটা বালতি বালতি জলের একত্রে মিলে পুকুর হওয়ার মত। এভাবেই আদিম সমাজ থেকে আমরা এসেছি সামন্তবাদী ব্যবস্থায় তারপর সেখান থেকে পুঁজিবাদে। আসলে এ সবই সময়ের দাবি। বর্তমানে পুঁজিবাদ বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বিভিন্ন সময়ে সে নিজেকে বিভিন্ন ভাবে পরিবর্তিত করেছে, চেষ্টা করেছে অবকাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে নিজের জীবন রেখাকে বাড়িয়ে নিতে। আর সেটা করতে গিয়ে সে কখনও মানবতা, কখনও গণতন্ত্র, কখনও বা বাক স্বাধীনতা – ইত্যাদি ইত্যাদি স্লোগান সামনে নিয়ে এসেছে। ব্যাপারটা এই নয় যে বৃহৎ পুঁজি খুব মানবিক, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাকে মানবিকতার স্লোগান দিতে হয়, কিছুটা হলেও মানবিক মুখোশ পরে নিজের সামনে চলাকে অব্যাহত রাখতে হয় আর এতে সাহায্য করে সেই সব মানবাধিকার রক্ষাকারী মানুষেরা যারা পুঁজিবাদের ছিটেফোঁটা প্রসাদ পেয়ে নিজেরাও সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে ভেতরে ভেতরে পুঁজিবাদ তার চরিত্র এতটুকু বদলায়নি, পরীক্ষার সময়ে সে তার দাঁত ঠিকই দেখায়। আর একারণেই মানবতার কথা বললেও সে কখনই যা মানুষকে তার মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সেই শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেনি, কখনই সমাজকে শোষণ মুক্ত করার জন্য পথে নামেনি, বরং সব সময়ই বেশি বেশি করে মানুষকে শোষণের নাগপাশে বেঁধেছে। আর সেই শোষণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার কিছু অংশ সাধারণের মধ্যে বিলিয়ে নিজেকে মহান করেছে। একশ টাকার এক শতাংশ আর একশ কোটি টাকার এক শতাংশ অনুপাতের দিক থেকে সমান হলেও দুয়ের মধ্যে বিশাল ফারাক। এখন পুঁজিবাদ অনেক বেশি মুনাফা করে বলেই তার দান খয়রাত আমাদের কাছে বিশাল মনে হয়, তবে তাতে যে ধনী আরও ধনী আর গরীব আরও গরীব হয় সেটা তো আমরা দেশে দেশেই দেখতে পাচ্ছি।

মানবিকতার, গণতন্ত্রের, সমান অধিকারের কথা বললেও তারা নিজেরাই ঘৃণা, বিদ্বেষ, বৈপরীত্য – এই সব মানবিক বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে দেশে দেশে যুদ্ধ লাগাচ্ছে। হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মারণাস্ত্র। কারণ? মুখে যাই বলুক – পুঁজি বা অর্থ – একমাত্র এটাই তাদের কাছে অর্থবহ। বিভিন্ন উচ্চ মার্গের স্লোগান – এসব সেই অর্থ উপার্জনের এক একটা মাধ্যম মাত্র। আজ পৃথিবীতে এমন একটা প্রজেক্টের নাম কি করতে পারব আমরা তা সে পরিবেশ আন্দোলনই হোক, বিএলএম হোক আর যাই হোক যার পেছনে বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ ছিল না, যার পেছনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল না? সমস্যা হল সাধারণ মানুষ বারবার এসব ভাল ভাল কোথায় বিশ্বাস করে রাস্তায় নামে আর এই সব লোকেরা সমস্ত ফসল ঘরে তুলে নেয়।

আচ্ছা মানবিকতার এত এত স্লোগান দিয়েও আমরা সত্যিকার অর্থে মানবিক হয়ে উঠতে পারছি না কেন? সত্যিকার অর্থে মানবিক হওয়া এত কঠিন কেন? মানুষ চাইলেই তো মানবিক হতে পারে, তার আশেপাশের মানুষকে ভালোবাসতে পারে। এতে নিজেও যেমন শান্তিতে থাকা যায়, অন্যদেরকেও শান্তিতে থাকতে দেওয়া যায়। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা হলো, মানবিক হওয়া মানে শুধু মানুষকে ভালোবাসা নয়, মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করা, মানুষই যে তার ভাগ্য বিধাতা এই বিশ্বাসে আস্থা রাখা। বিশ্বাস করা মানুষের সমতায়। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ যে সমান তাতে বিশ্বাস রাখা। আসলে মুখে যতই বলুক সবাই নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় ভাবতে ভালবাসে। নিজের খারাপ অবস্থার জন্য ভাগ্যকে দোষ দিলেও সাফল্যের জন্য সে কিন্তু নিজেকেই বাহবা দেয়, যদিও মুখে বলে সবই ঈশ্বরের কৃপা। আর এ জন্যেই অনেক জাতি নিজেদের এক্সক্লুসিভ মনে করে। আর এই মনে করা থেকেই আসে অসাম্য। এখান থেকে সে জাতি অন্য জাতির উপর নিজের ইচ্ছা আরোপের যুক্তি খুঁজে পায়। এটা জাতির জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য মানুষের জন্য। কিন্তু নিজেকে আর দশ জনের মত ভাবা কি এতই সোজা? সাম্যের বাণী অন্তরে ধারণ করা কি এত সোজা? যে মানুষ যুগ যুগ ধরে অতিপ্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাস করে আসছে, নিজের অক্ষমতা নির্দ্বিধায় তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে শান্তিতে ঘুমোচ্ছে সে কোন সাহসে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে?  নিজের ব্যর্থতার দায়িত্ব নেবার জন্য যে মনোবল দরকার ক’জনের সেটা আছে?

বিজ্ঞানের দিশারীরা আমাদের সে পথেই চালিয়েছেন, সে পথই দেখিয়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করা আর বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া এক কথা নয়। বিজ্ঞানী না হয়েও বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যায়, কিন্তু বিজ্ঞানী হলেই যে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিজ্ঞান যাদের জন্য শুধুই পেশা, অন্যান্য অনেক পেশার মত শুধুই জীবিকা নির্বাহের উপায় তাদের বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া বলতে গেলে অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞান যাদের জীবন দর্শণ, বিজ্ঞান যাদের জীবনের মিশন, বিজ্ঞান যাদের জীবন তাঁদের কথা ভিন্ন।

তাই মানবিক হতে হলে বিজ্ঞান শিক্ষা অপরিহার্য, সব কিছুতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া