মতামত

আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবসে

শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরপত্তা প্রসঙ্গে

– ফজলুল কবির মিন্টু

২৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস। কর্মক্ষেত্রে দূর্ঘটনার শিকার, আহত বা নিহত শ্রমিকদের স্মরণে জাতিসংঘের আহ্বানে বিশ্বব্যাপি শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

১৯৮৪ সাল থেকে কানাডিয়ান ইউনিয়ন অব পাবলিক এমপ্লয়িজ এর উদ্যোগে এই দিবসটি কেবল কানাডায় পালিত হতো। পরবর্তীতে  ২০০৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) এবং বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাণা প্লাজা ধ্বসের কারণে ১১৩৬ জন শ্রমিকের প্রাণ হানির পর বাংলাদেশেও শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০১৬ সাল থেকে দিবসটি পালন করছে। এটি আন্তর্জাতিক দিবস হলেও সারাবিশ্বে একই দিনে পালিত হয়না। বিশ্বের বিভিন্ন  রাষ্ট্র নিজ নিজ সুবিধা অনুসারে বৎসরের একটি সুনির্দিষ্ট দিনকে আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে সেই অনুসারে পালন করে থাকে। বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে রাণা প্লাজা ধ্বসে নিহত শ্রমিকদের স্মরনার্থে ২৪ এপ্রিলকে আন্তর্জাতিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস হিসাবে ঘোষণা করার দাবি জানালেও সম্ভবত গার্মেন্টস মালিকদের বিরোধীতার কারনে তা গ্রহণ করা হয়নি।

শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বলতে বুঝানো হয় – কর্মক্ষেত্রে তথা কোন নিয়োগ কর্তার অধীনে কর্মরত থাকা থাকা অবস্থায় শ্রমিককে পেশাগত দুর্ঘটনা এবং রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়া।

পেশাগত দুর্ঘটনা তিন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন- ছোট দুর্ঘটনা, গুরুতর দুর্ঘটনা এবং মারাত্মক দুর্ঘটনা।  কোন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারনে আহত হওয়ার পর ৩ দিন থেকে ২০ দিন চিকিৎসাধীন থাকলে এবং কাজে যোগদান করতে আপারগ হলে তখন তাকে ছোট দুর্ঘটনা বলে। কোন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারনে আহত হওয়ার পর ২০ দিনের অধিক সময় চিকিৎসাধীন থাকলে এবং কাজে যোগদান করতে আপারগ হলে তখন তাকে গুরুতর দুর্ঘটনা বলে। কোন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারনে আহত হওয়ার পর মৃত্যবরণ করলে তাকে মারাত্মক দুর্ঘটনা বলে।

শ্রমিক আহত হওয়ার পর মালিককে অবহিত করার ৩ দিনের মধ্যে মালিক শ্রমিকের পরীক্ষা-নিরিক্ষা এবং চিকিৎসার উদ্যোগ নিবে। শ্রমিক যদি চলাচল করতে অপারগ হয় তাহলে শ্রমিক যেখানে অবস্থান করবে সেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা এবং চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে হবে। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আহত শ্রমিক সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত সবেতন ছুটি প্রাপ্য হবে। তবে শর্ত থাকে যে, প্রথম ২ মাস পুর্ণ মজুরি, পরবর্তী ২ মাস দুই তৃতীয়াংশ মজুরি এবং পরবরতী বাকী ৮ মাস অর্ধেক মজুরি প্রাপ্য হবে। শ্রমিক সম্পূর্ণ সুস্থ্য না হওয়া পর্যন্ত আহত শ্রমিকের যাবতীয় চিকিৎসার দায়ভার মালিকের। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের দেশে মালিক পক্ষ শ্রমিক আহত হওয়ার পরপর প্রাথমিক চিকিৎসা দিলেও পরবরতীতে আর তেমিন কোন খজ খবর রাখেনা। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক মালিক শুরু থেকেই দায়িত্ব এড়িয়ে চলার সুযোগ খুঁজে। ফলে আহত শ্রমিকেরা এক দুর্বিসহ জীবনের মুখোমুখি হয়।

শ্রমিকেরা আহত হয়ে স্থায়ী পঙ্গু হলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপুরন পায়। আবার আংশিক পঙ্গু হলে তফসিল ১ এর নির্দেশনা মতে কত শতাংশ পঙ্গু তা নির্নয় করার পর ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার আনুপাতিক হারে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবে। কোন শ্রমিক আহত হয়ে মৃত্যবরণ করলে তার পোষ্যরা ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু আহত-নিহত হলে ক্ষতিপূরন সংক্রান্ত শ্রম আইনের বিধান সমূহ আন্তর্জাতিক শ্রমমান এবং আইএলও কনভেনসন ১২১ এর সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।মূলত যেকোন দুর্ঘটনা সংক্রান্ত বিষয়ে মূলনীতি হওয়া উচিৎ – প্রতিরোধ, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ।  আমাদের শ্রম আইনে প্রতিরোধ এবং পুনর্বাসন বিষয়টি খুব বেশী গুরুত্ব পাইনি। অন্যদিকে ক্ষতিপূরনের পরিমানও খুবই অপ্রতুল। ক্ষতিপূরণ হওয়া উচিৎ ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের মজুরি, হারানো আয়ের বছর (Loss of year earnings) এবং ভোগান্তি (Sufferings and pain) ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে ক্ষতিপূরণ নির্ধারন করা উচিৎ।

আমাদের দেশের শ্রম আইনের তফসিল ২ এ ৩৩ ধরণের রোগকে পেশাগত রোগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে ভুক্তভোগী শ্রমিককে চিকিৎসা সেবা সহ সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত সবেতন ছুটি প্রদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পেশাগত রোগ চিহ্নিত করে তার জন্য প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। আবার শ্রমিকরাও এ ব্যাপারে খুব বেশী সচেতন নয়। ফলে পেশাগত রোগে আক্রান্ত হয়ে কোন শ্রমিক চিকিৎসা সেবা এবং সবেতন ছুটি পেয়েছে এমন কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। এই বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন কোন খোঁজ খবর রাখে বলে মনে হয়না। তারা শ্রমিকদের একদম খুব সাধারণ এবং প্রাথমিক অধিকার নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে পারেনি- সেখানে পেশাগত রোগের ব্যাপারে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা দুরাশা ছাড়া আর কী হতে পারে?  আমাদের শ্রম আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে – এ আইনটি প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র ১৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের।

দেশে বর্তমানে সাড়ে ৬ কোটির অধিক শ্রমজীবী মানুষ আছে। যাদের ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে (Informal Sector) কর্মরত রয়েছে। এসকল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা মূলত দিন মজুর ছাড়া আর কিছুই নয়।  সিংহভাগ শ্রমিকের কোন সুনির্দিষ্ট নিয়োগ কর্তা নাই। তারা শ্রম আইনে বর্ণিত সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। এ সকল অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের ব্যাপারে রাষ্ট্রেরও যেন কোন দায় নেই।

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা এবং নিরাপত্তা সুবিধা প্রতিটি শ্রমিকের বৈধ এবং আইনগত অধিকার। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদেরকে একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্ম পরিবেশ প্রদান করা এবং কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপদ পরিবেশের অনুশীলন করা প্রত্যেক মালিকের নৈতিক ও আইনগত কর্তব্য। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক -অপ্রাতিষ্ঠানিক  নির্বিশেষে প্রত্যেক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চূড়ান্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

 

লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি