বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন
গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে। বিচার বিভাগকে স্বাধীন করার যে প্রত্যাশা ছিল, তা কতটা পূরণ হয়েছে—তা নিয়ে আইনজীবী ও বিশ্লেষকদের মধ্যে গভীর হতাশা ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করলেও বিচার বিভাগের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি।
বিচারকদের সিদ্ধান্তে ভয় ভীতি ও চাপ
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “সুপ্রিম কোর্টে যেসব বিচারক আছেন, তাদের অনেকে এখন ভয় পাচ্ছেন আদেশ দিতে। কোন রায় দিলে কী হয়—এই চিন্তা মাথায় কাজ করে।” তিনি বলেন, এখনকার ভয়টি আগের চেয়ে বেশি জটিল ও অদৃশ্য। আগে গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে চাপ আসছে, তা বোঝা যেত। এখন সেই ভয় আসছে এমন এক অন্ধকার ‘সুরঙ্গ’ থেকে, যেটা চিহ্নিত করা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, “একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে, যেটা বিচার ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত।”
বিচার ব্যবস্থার ভিতরে-বাইরে আতঙ্ক
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন মনে করেন, “এখন এমন কোনো বিচারক নেই যিনি মনে করেন যে, তিনি নিশ্চিন্তে আদেশ দিতে পারবেন। কেউ যদি রায়ের কারণে সমালোচনার শিকার হন, তাহলে তার পুরো বিচারিক ভবিষ্যত শেষ হয়ে যেতে পারে।”
তিনি বলেন, “গত এক বছরে বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত কোনো বড় পরিবর্তন আসেনি। হাইকোর্ট থেকে বিচারকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে—কেন, তা আজও অজানা। সংবাদমাধ্যমও এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করছে না।”
সুপ্রিম কোর্ট বিটের অভিজ্ঞ সাংবাদিক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, “বিচারকদের অবসরের পর প্রতিহিংসামূলক আচরণ বিচার বিভাগের ওপর সরাসরি হুমকি। উচ্চ আদালতের উচিত ছিল এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া।”
ব্যক্তিগত সততা না থাকলে স্বাধীনতা অর্থহীন
সাবেক জেলা জজ ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্টার জেনারেল ইকতেদার আহমেদ বলেন, “সংবিধানে বিচারকদের স্বাধীনতা স্বীকৃত। কিন্তু সেটি কতটা ব্যবহার করা হবে, তা নির্ভর করে ব্যক্তিগত সততা ও নৈতিকতার উপর। দুর্নীতিগ্রস্ত হলে সেই স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাসদার হোসেনও একমত পোষণ করে বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ৯০ শতাংশ নির্ভর করে বিচারকের নিজের মনের শক্তি ও নৈতিকতাবোধের উপর। কেবল কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।”
‘মাসদার হোসেন মামলার ৮ নম্বর দফা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি’
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পার হলেও এখনও বিচারকদের নিয়োগ, পদায়ন ও শৃঙ্খলার বিষয়গুলো রয়ে গেছে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। মাসদার হোসেন মামলার ৮ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, বিচারকদের কর্মকাণ্ড যেন সংসদ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়, তার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন করতে হবে।
কিন্তু মাসদার হোসেন বলছেন, “আজও প্রধান বিচারপতি পৃথক সচিবালয়ের জন্য সফল হতে পারছেন না। সরকারের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তারা আন্তরিক নয়। এটি একটি সুস্পষ্ট ব্যর্থতা।”
অ্যাটর্নি জেনারেলের সাম্প্রতিক মন্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “তিনি বলেছেন, সরকারের কিছু বক্তব্য আছে সচিবালয় গঠনের বিষয়ে—যা থেকে পরিষ্কার, আলাদা সচিবালয়ের পথেই বাধা।”
অব্যাহত সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, “বিচারকদের মধ্যে এখন আদেশ দিতে ভয় কাজ করছে। এ অবস্থায় আপনি কখনোই বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন বলতে পারেন না।”
তিনি আরও বলেন, “২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় দুই আদালতের বিপরীত রায় এসেছে। অপরাধ রয়ে গেলেও, অপরাধীদের বিচার নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এই দ্বৈততা বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলে।”
উপসংহার
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি ছিল—বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। একদিকে কাঠামোগত সংস্কারের অভাব, অন্যদিকে অদৃশ্য চাপ ও আতঙ্কের কারণে বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। বিচার বিভাগের এই অচলাবস্থা কেবল আদালতের জন্য নয়, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও বড় সংকেত হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে, যদি শিগগিরই প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে জনগণের আস্থা ও ন্যায়বিচার—উভয়ই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
