বাজেটে শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: একটি পর্যালোচনা -ফজলুল কবির মিন্টু

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ সরকার। এটি দেশের ৫৪তম এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বাজেটকে কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এবারের বাজেট মানুষকেন্দ্রিক এবং সামগ্রিক উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে—শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষের প্রত্যাশা এই বাজেটে তেমনভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
২০২৪ সালের গণভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান শ্লোগান ছিল: “একটি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা”। এই শ্লোগানের পেছনে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা জড়িত ছিল। এই লক্ষ্য পূরণে বাজেটে যে বিষয়টি বিশেষভাবে থাকা উচিত ছিল, তা হলো বেসরকারি খাতে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও সময়োপযোগী নিম্নতম মজুরি কাঠামো এবং এর বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এবারের বাজেটে এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা বা প্রতিশ্রুতি দেখা যায়নি। ফলে দেশের প্রায় সাড়ে কোটি শ্রমজীবী মানুষ হতাশ হয়েছেন।
বিশেষত, শ্রমঘন এলাকা ও নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু এবং ন্যায্যমূল্যের দোকান স্থাপনের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটিও বাজেটে উপেক্ষিত থেকে গেছে। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগ শ্রমজীবী মানুষের জন্য জীবিকা রক্ষার সহায়ক হতো। কিন্তু এই বাস্তব ও জরুরি চাহিদাগুলোকে উপেক্ষা করায় শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী নতুন করে সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেট কথায় “মানুষকেন্দ্রিক” হলেও বাস্তবে তা “কথার বাজেট” হয়েই থাকছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বাজেটে বৈষম্য কমানোর কথা থাকলেও তার বাস্তবায়নের কৌশল অনুপস্থিত। কৃষি, শিল্প ও বিনিয়োগ খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান অনিশ্চিত, অথচ সেটিই শ্রমজীবী মানুষের প্রধান প্রত্যাশা ছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও, এর বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক ড. মাহফুজ কবীরও মনে করেন, মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের ঘূর্ণিপাকে শ্রমজীবী মানুষ আরও বিপদে পড়তে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, এনবিআরকে উচ্চ কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হলেও কর কাঠামোতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়নি। বরং ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর নতুন করের বোঝা চাপানো হয়েছে। এতে শ্রমজীবী মানুষদের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
শেষ কথা:
২০২৪ সালের গণআন্দোলনে যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল দেশের মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী—তা পূরণে এবারের বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপ অনুপস্থিত। নিম্নতম মজুরির নিশ্চয়তা, রেশনিং ব্যবস্থা, ন্যায্যমূল্যের দোকান কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার জোরালো কাঠামো—এসব মৌলিক চাহিদার কোনোটিই পূরণ হয়নি। কথায় “মানুষকে প্রাধান্য” দেওয়া হলেও, নীতিতে ও বরাদ্দে সেই প্রতিফলন স্পষ্ট নয়।
সত্যিকারের মানুষকেন্দ্রিক বাজেট কেবল ভাষণে নয়—বাস্তব পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়। এবং সেটা এখনও অধরাই থেকে যাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের জন্য।
