বিজ্ঞান ভাবনা (২০২): দায়বদ্ধতা -বিজন সাহা
বাংলাদেশ এক চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে কাল অতিক্রম করছে। যে নামেই হোক আর যার বিরুদ্ধেই হোক – সব কিছুই যে একাত্তরকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে করা হচ্ছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েক পর্ব আগে চব্বিশের ঘটনাবলীর পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আমরা কতটা দ্বিধা বিভক্ত সেটা বলেছিলাম। সেই বিভক্তি দিন দিন বাড়ছে। আর সেই সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলছে সেই শক্তি যারা কোন দিনই এর অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। দেশ – এটা শুধু ভৌগলিক সীমানা নয়, দেশ এটা শুধু এক দল মানুষ নয়, দেশ – আরও কিছু নীতিমালা, কিছু ঘোষিত লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য কোন নির্দিষ্ট পথ। যখন সমাজ সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় সে আর আগের সমাজ থাকে না। এটা অনেকটা ডাক্তারি কোর্সে ভর্তি হয়ে মাঝপথে ব্যবসা বা অন্য কোন পেশায় যোগ দেয়া। নতুন পেশায় সে সাফল্য অর্জন করতেই পারে কিন্তু ডাক্তার হবে না।
ইউরোপ ভূত দেখেছিল – কমিউনিজমের ভূত। বাংলাদেশ ইউরোপ নয়। এখানকার মানুষ তাই নাটক দেখে। দেখে কীভাবে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা কবর থেকে বেরিয়ে আসছে, গলা টিপে মারছে একটা আস্ত জাতিকে। মারছে মেটিকুলাস প্ল্যান করে। আর সেই প্ল্যানের নেতৃত্ব দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের এক পেয়ারের মানুষ। এতে অবশ্য অবাক হবার কিছুই নেই। তালিবান, আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট – কারা পশ্চিমাদের পেয়ারের ছিল না?
হঠাৎ করেই মনে হল যে গত বছর আগস্ট থেকে শুরু করে আজ জুনের প্রারম্ভ পর্যন্ত প্রায় দশ মাস সময় দেশ ও জাতি পেরিয়ে এসেছে। এই সময়টা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের চেয়ে দীর্ঘ। একাত্তরে আমার বয়স মাত্র সাত বছর হলেও সেই সময়ের অনেক স্মৃতিই এখনও অম্লান। কয়েক বছর আগে সেসব স্মৃতি নিয়ে নিয়মিত লিখেছি ফেসবুক আর নিজের ব্লগে ৪৬ পর্বে। তাই সেই সময়কার নিজেদের মানসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা এখনও টাটকা। সেই সময় ইন্টারনেট ছিল না, ছিল না দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা, তবে চারিদিকে ছিল তমস আঁধার আর অনিশ্চয়তার সর্বগ্রাসী ভয়। এখন থাকি দেশের বাইরে। তবে ইন্টারনেটের কল্যাণে দেশের খবর সেই সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত পৌঁছে আমাদের কাছে। সব দেখে মনে হয় আমরা আবারও সেই একাত্তরেই ফিরে গেছি। আবার সেই অনিশ্চয়তা, আবার সেই ভয়। তবে ভয়ের বস্তু এক – রাজাকার। তখন মানুষ লুকিয়ে থাকত রাজাকারদের ভয়ে, এখন থাকে তাদের আদর্শিক সন্তানদের ভয়ে, নব্য রাজাকারদের ভয়ে। তখন ওদের প্রধান শিকার ছিল সংখ্যালঘু আর আওয়ামী লীগ। এখনও তাই। তবে সেই সময় পাশে ভারত ছিল, বলতে গেলে ভারতই আমাদের হয়ে শেষ লড়াইটা লড়েছিল, এখন আমরা একা, একান্তই একা এবং যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দ্বিধাবিভক্ত। অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টির মত পরীক্ষিত রাজনৈতিক দলও আজকাল স্বৈরাচার ও রাজাকারের মধ্যে রাজাকারকেই বেছে নেয়, যদিও রাজাকার মাল্টি পারপাস আদর্শে বিশ্বাসী, যেখানে স্বৈরাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মধ্য যুগীয় বর্বরতা সব এক সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আমার মনে হয় বর্তমান সরকারের ডাকে সাড়া দেবার আগে সিপিবির ভেবে দেখা দরকার। কারণ এদের পেছনে না আছে রাজনৈতিক সংগ্রামের ঐতিহ্য, না আছে অন্য কিছু। এমনকি তাদের পেছনে ২০২৪ এর জনসমর্থন আছে সেটা ভাবাও ভুল। কারণ যে উদ্দেশ্যে মানুষ সেই আন্দোলনের সামিল হয়েছিল সে সব লক্ষ্য অনেক আগেই বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। আমার সোনার বাংলা, ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা এসব কালজয়ী গান গেয়ে আন্দোলনে নামলেও বিজয়ের প্রথম রাতেই চেষ্টা করেছে এসব ঐতিহ্য অস্বীকার করার। কথায় আর কাজে বার বার, হাজার বার প্রমাণ করেছে যে এই সরকার আসলে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সেবাদাস। আমার মনে আছে এর আগে যখন আওয়ামী সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে সিপিবিকে ডেকেছে, বিভিন্ন অজুহাতে তারা সেটা প্রত্যাখান করেছে, তাতে আওয়ামী লীগ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলা কষ্ট, তবে মৌলবাদীদের হাত যে আরও শক্তিশালী হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। আর তাই যদি হয়, তবে বর্তমান তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাথে বৈঠক করার অর্থ কী সেটাই আমাদের বোধগম্য নয়। কারণ সিপিবি বা বামদলগুলোর যে শক্তি তাতে এখন তাদের অবস্থান দশমিকের পরে চতুর্থ বা পঞ্চম ঘরে, যাদের চাইলেই অনায়াসে উপেক্ষা করা যায়। তার পরেও এদের ডাকে, কারণ তাতে করে সরকার প্রমাণ করতে পারে যে তারা সব দলের সাথ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে যদিও পরিবর্তন করার শক্তি নেই তবুও উপস্থিতির মধ্য দিয়ে এরা সরকারি সিদ্ধান্তকে বৈধতা দান করে। কী সেই সিদ্ধান্ত? রাজাকারের মুক্তি। কী সেই সিদ্ধান্ত? প্রতিবেশী দেশের সাথে উত্তেজনা সৃষ্টি করা। কী সেই সিদ্ধান্ত? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার প্রয়াস।
স্বীকার করতে তো দ্বিধা নেই যে বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ তরুণী মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ডাকে রাজনীতিতে এসেছে। তিনিই এতদিন সবাইকে কমিউনিজমের ওয়াজ শুনিয়েছেন। তাই যখন তাঁকে দেখি প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে গিয়ে মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের ভীড়ে হারিয়ে যেতে কিছু প্রশ্ন না করে পারি না। বন্দুক হাতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা – এটা শুধু তাঁর ছবি নয়, এটা মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী ছবি। তাঁর রাজাকারদের ভিড়ে মিশে যাওয়া এটা ৩২ নম্বর ভাঙার মতই মুক্তিযুদ্ধের আরও একটি স্তম্ভের পতন। এই যাওয়া পার্টির অনুমোদনে হয়েছিল নাকি ব্যক্তিগত উদ্যোগে – সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। তবে বিগত দিনগুলোয় সরকার ও তার চ্যালা চামুন্ডারা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে ধুলিস্যাত করেছে তাতে এই যাওয়াটা আমরা যারা এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, যারা এখনও বাম রাজনীতিতে আস্থা রাখি তাদের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পার্টি ভাঙার পর পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেতাদের বলা হত সংশোধনবাদী। তবে এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে তারা পার্টির নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেননি। যখন দেখেছেন আগের বিশ্বাস নিয়ে পার্টি করতে পারবেন না তখন হয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন অথবা ভিন্ন নামে রাজনীতি করেছেন। কাউকে ধোঁকা দেননি। এটাই ছিল পার্টির প্রতি তাদের আনুগত্যের, তাদের সততার প্রকাশ। কিন্তু এখন? হজ্ব করতে গিয়ে কেউ কেউ দোয়া চায় কর্মী ও সমর্থকদের পাপ মোচনের জন্য। আমরা কি নিজদের পাপী মনে করি? পার্টির নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনীতি করে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আঁতাত করার ম্যান্ডেট কি আপনাদের কেউ দিয়েছে? শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করতেন, আপনারা কমিউনিজমের আদর্শ বিক্রি করেন। তথাৎ কোথায়? বাংলাদেশে মুসলমান ছাড়া আর কারো নাকি ধর্মীয় অনুভূতি থাকতে নেই। এটা কি আদর্শের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? তাই সাম্যবাদের আদর্শে যারা বিশ্বাসী তাদের অনুভূতিতে আঘাত দিতে আপনাদের এতটুকু বাঁধে না। আপনারা এসব করেন, করতেই পারেন। সেই অধিকার আপনাদের আছে, যদিও নেতা হিসেবে আপনি হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থকের কাছে দায়বদ্ধ। এই যে এক যুদ্ধাপরাধী মুক্তি পেল পারতপক্ষে আপনি/আপনারা সেটাই কি এন্ডোরস করে এলেন আপনার উপস্থিতি দিয়ে? তাদের কাছে আপনাদের কোনই মূল্য নেই শুধু মাঝে মধ্যে ডেকে হাজিরা খাতায় নাম তোলা আর সেটা দেখিয়ে তাদের কাজের পেছনে জনসমর্থন আছে সেই মিথ্যা জোর গলায় বলা ছাড়া। করেন। তবে ভালো হয় যদি এসব আপনারা পার্টি বাইরে থেকে অথবা নতুন নামে নতুন পার্টির ব্যানারে করেন। সিপিবির একটা ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে। সেই ঐতিহ্য কালিমালিপ্ত করার অধিকার কিন্তু পার্টির ভেতরে আর তারচেয়েও শতগুন বেশি পার্টির বাইরে থাকা কর্মী সমর্থকরা আপনাদের দেয়নি।
শিশু যার কোন লাভ লোকসানের হিসাব নেই, স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ পাওয়ার ভয় নেই, একমাত্র সেই “রাজা তুমি ন্যাংটা” এই চরম সত্য জনসম্মুখে উচ্চ কন্ঠে উচ্চারণ করতে পারে। আচ্ছা একাত্তরের আর কত স্মৃতি ধ্বংস করলে, আর কত একাত্তরের ঘাতকদের বেকসুর খালাস দিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিবিদ বলে পরিচিত নেতারা বলতে পারবে যে বর্তমান সরকার রাজাকারের দোসর, বর্তমান সরকার একাত্তরের ঘাতক দালালদের সরকার? এখনও যারা এর পেছনে আওয়ামী স্বৈরাচারের দোষ খুঁজে তাদের বলব – অন্যের দোষ নয়, নিজেদের মেরুদন্ড খুঁজতে। চব্বিশ শুধু একাত্তরকে হত্যা করেনি, চব্বিশ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে।
এদেশের মানুষ সত্যিই দুর্ভাগা। আজীবন সবাই তাদের ঠকিয়েই গেল। এমনকি যারা এদের দারিদ্র্য নিয়ে রাজনীতি করে তারাও একদিন বড়লোক বনে যায়, শুধু এদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। জন্ম নেয় নতুন নতুন মীরজাফর। শেখ হাসিনা বলতেন শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করেছে, নব্য বিপ্লবীরা বলে তারা দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হল গত আগস্টে দেশে সাধারণ মানুষই শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু তার পরিবর্তে একজন নির্লোভ, দেশপ্রেমিক ও অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য কাউকে তারা পায়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান তৈরি করা হয়েছিল উত্তর প্রদেশের মুসলিম এলিটদের ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের পথ সুগম করার জন্য। এরপর থেকেই চলছে রাজা বদলের পালা। জনগণের ভাগ্য বদলের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এলেও মূলত রাজাই বদল হয়, নতুন এলিট তৈরি হয়, কিন্তু মানুষের ভাগ্য বদলায় না। সব বিপ্লবই ঝুটা হয়ে যায়। এটাই এদেশের মানুষের বড় দুর্ভাগ্য। তাই কী বাম, কী ডান যারা রাজনীতি করে তাদের মনে রাখা দরকার আন্তোয়ান দে এক্সুপেরির ছোট্ট রাজপুত্রের সেই কথাটি “যাদের তুমি বশ করেছ তাদের কাছে তুমি দায়বদ্ধ।”
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো