চলমান সংবাদ

সরকারের সামনে ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ

গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৪৯ ভাগ৷ ওই ছয় মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল হিসেবে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার৷ আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) একই সময়ে যা ছিল ১০৫ কোটি ডলার৷

গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল হিসেবে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি

অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) মোট আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হবে ৩২৮ কোটি ডলার৷ আগামী অর্থ বছরে অঙ্কটা দাঁড়াবে ৪০০ কোটি ডলার৷ এরপর এর পরিমাণ বাড়তেই থাকবে৷ ২০২৯-৩০ সালে যা হবে ৫১৫ কোটি ডলার৷ ঠিক এখন সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ সাত হাজার ৭৬ কোটি মার্কিন ডলার৷

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্তঃব্যাংক ডলার লেনদেনের সুদের হার (সিকিউর্ড ওভারনাইট ফাইনান্সিং রেট-এসওএফআর) বেড়ে গেছে৷ এখন এই রেট পাঁচ ভাগের বেশি হলেও ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ছিল এক ভাগ৷ আর বাংলাদেশের বাজারভিত্তিক( শর্ট টার্ম) ঋণ ক্রমাগত বাড়ছে৷ ফলে সুদ বেশি গুণতে হচ্ছে আর সময়ও কম পাওয়া যাচ্ছে৷ আর বেশকিছু মেগা প্রকল্প, যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিদেশি ঋণের ‘প্রেস পিরিয়ড’ শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি৷

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য যে ঋণ নেয়া হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে৷ এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর যদি আমাদের রপ্তানি খাতে অবদান রাখতে পারে, যদি আমরা আরো বেশি পরিমাণ রপ্তানি করতে পারি, বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারি, তাহলে ঋণের চাপ কমবে৷ আমাদের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিদেশি মুদ্রায়৷ তাই আমাদের রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ সময় নেয়া হয়েছে৷ এর সঙ্গে প্রকল্প ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে৷  এখন যা শুনছি সরকার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার কথা বলছে৷ নতুন কোনো প্রকল্প তার আগে না নেয়ার কথা বলছে৷ তাতে মনে হচ্ছে, সরকারের একটা রিয়েলাইজেশন হয়েছে৷ তবে এরই মধ্যে যে ঋণ নেয়া হয়েছে, যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সেই প্রকল্পগুলোও রিভিউ করা দরকার৷ কতদিন লাগবে বাস্তবায়ন করতে৷ কতটা ভায়েবল হবে৷”

তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “তারপরও দেশে যে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে আমাদের ঋণ লাগবে৷ কিন্তু আমাদের দেখতে হবে আমরা কোন ধরনের ঋণ নেবো৷ এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে৷ বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- এইসব বহুপাক্ষিক সোর্সগুলোতে ঋণের সুদ কম এবং গ্রেস পিরিড বেশি থাকে৷ কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে ঋণ নেয়া হয়, তার সুদের হার বেশি থাকে এবং সেগুলো শর্ট টার্ম হয়ে থাকে৷ গত ১০ বছরে আমরা এই শর্ট টার্ম ঋণ বেশি নিয়েছি৷ ফলে তা শোধ করতে হচ্ছে৷ বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিলে তাদের অনেক শর্ত থাকে৷ সেটা এড়িয়ে যেতেই হয়তোবা সরকার শর্ট টার্ম ও বেশি সুদে ঋণের দিকে ঝুঁকেছে৷ কিন্তু এই ঋণ আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ৷”

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “দুই দিক থেকে বিদেশি ঋণের চাপ বাড়ছে৷ একটা  হলো, ডলারের দাম বাড়ছে, যা আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে৷ আর হলো, ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ডেফিসিট৷ আমরা যে ঋণ ইদানিংকালে  নিয়েছি, সেগুলোর ব্যবহার যথাসময়ে করতে না পারায় ওই ঋণ থেকে রিটার্ন আসছে না৷ কিন্তু টাকা ফেরত দেয়ার সময় চলে এসেছে৷ ফলে আয় নেই, কিন্তু দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে৷”

তার কথা, “যে ঋণ আমরা নিয়েছি, সেটা তো আমাদের ফেরত দিতে হবে৷ ফেরত না দেয়ার তো কোনো বিকল্প নাই৷ এখন এই ঋণ পরিশোধ করতে হলে আমাদের রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে৷ আর কোনো পথ দেখছি না৷ আমাদের ডলার আয় বাড়াতে হবে৷ নয়তো ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অন্যখাতে না আবার ডলার সংকট তৈরি করে৷ আর নতুন ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে৷ যেসব ঋণ সস্তায় পাওয়া যায়, দীর্ঘ মেয়াদে পাওয়া যায়, সেটা নিলে আমাদের  চাপ বাড়বে না৷ যেমন, বিশ্বব্যাংক, এডিবির ঋণ ৩০ বছর মেয়াদে৷ দুই থেকে আড়াই শতাংশ সুদ৷ আরো পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যায়৷ তবে তাদের তো আবার পছন্দের প্রকল্প আছে৷ সেটা ধরে আমাদের জন্য যেগুলো ভায়াবল হবে, সেগুলো আমরা নিতে পারি৷ আর চীনসহ যেকেনো দ্বিপাক্ষিক ঋণেরই সুদের হার বেশি৷ সময় কম৷ আবার তাদের শর্তও বেশি৷ তাই ওই ধরনের ঋণ নিলে হিসাব করে নিতে হবে, যাতে প্রকল্প থেকেই ঋণ শোধ করা যায়৷ পেলেই নিতে হবে, সেটা নয়৷ লাভজনক হলে নেয়া যাবে৷”

এ বিষয়ে সদ্য সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, “আমরা ঋণ করেছি, তা  তো শোধ করতে হবে৷ ঋণের চাপ তো বাড়বেই৷ গত ছয় মাস, নয় মাস নির্বাচনের কারণে , রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতি চাপে ছিল৷ রাজস্ব আদায়, বিনিয়োগসহ আরো অনেক দিকে সমস্যা হয়েছে৷ আমার মনে হয় এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে৷ যদি ছয় মাসও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে, তাহলে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে৷”

তার কথা, “প্রধানমন্ত্রী তো নতুন প্রকল্পে না গিয়ে, কৃচ্ছতা সাধন করে, যে প্রকল্প আছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন৷ আমার মনে হয় ভয়ঙ্কর কিছু হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অর্থনীতিতে একটা মেসেজ যাবে৷ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা যাবে৷”

# হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা