চলমান সংবাদ

ব্যাংক খাত: ২৪টি অনিয়ম ও লুট হওয়া ৯২ হাজার কোটি টাকা

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে ১৫ বছরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে, যা চলতি বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি৷

সম্প্রতি পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংককে মূলধন ঘাটতি কাটাতে নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

এই অর্থ নানা অনিয়ম ও ঋণের নামে লুটপাট হয়েছে৷ কিন্তু এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সামান্যই৷ অন্যদিকে এমন পরিস্থিতিতে দেশে কমপক্ষে ২০টি ব্যাংক এখন মূলধন সংকটে ভুগছে৷

সিপিডি বলছে, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বড় ধরনের ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে৷ সিপিডি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই হিসাব দিয়েছে৷

২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা৷ সেটি এখন বেড়ে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা হয়েছে৷ তবে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ এর তিনগুণ বলে মনে করছে আইএমএফ৷ কেননা, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায়ই নানা সুবিধা দিয়ে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করে৷ সেগুলো তখন আর খেলাপির তালিকায় রাখা হয় না৷

ব্যাংকিং খাতের এই পরিস্থিতির জন্য সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা৷ দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদাহরণ না থাকায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন তারা৷

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘আমরাও সানেমের পক্ষ থেকে চার বছর আগে গবেষণা করে দেখিয়েছিলাম খেলাপি ঋণের কারণে আমরা দেড় ভাগের মতো জিডিপি হারাচ্ছি৷ আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পরিকল্পনা করছি তার সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের যে অবস্থা তা আসলে যায় না৷ এইরকম ব্যাংকিং খাত নিয়ে আসলে ওই উন্নয়ন করা কঠিন৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণের বড় অংশই লুটপাট হচ্ছে৷ তারা টাকা নেয় ফেরত না দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে৷ এরা রাজনৈতিকসহ নানাভাবে প্রভাবশালী৷ বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারি হয়, ব্যবস্থাও নেয়া হয়৷ কিন্তু আমাদের এখানে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার তেমন কোনো নজির নেই৷”

তিনি বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণের বড় একটি অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে৷ যা উদ্বেগজনক৷”

বাংলাদেশের ১৪টি ব্যাংক এখন মূলধন সংকটে আছে৷ তাদের মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা৷ এর বাইরে পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংককে মূলধন ঘাটতি কাটাতে নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ নানা অনিয়মমের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে৷

সিপিডি তাদের পর্যালোচনায় আলোচিত কয়েকটি ঋণ কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করেছে৷ তার মধ্যে আছে, ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা, যার সঙ্গে এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে৷ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংকে নানা অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটে৷ এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৬০টির মতো মামলা করেছে৷ এই ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু৷ ৫০টির বেশি মামলা হলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি৷

২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়৷ এছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে৷ ২০২১ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় পিকে হালদার ১১ হাজার কোটি লোপাট করেন৷ ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে জনতা ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের ৮১৬ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে শহিদুল আহসানের ৭০১ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে এবি ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে৷ এর বাইরেও আরো ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা আছে৷

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘ব্যাংকিং সেক্টর একটা দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন৷ সুতরাং এখনকার সংকট দূর না করে অর্থনীতি এগিয়ে নেয়া কঠিন৷”

এই টাকা আদায় এবং খেলাপি ঋণ যাতে আর না বাড়ে তার ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ তার। তিনি বলেন, ‘‘সেজন্য আমরা আইন করা এবং একটি ব্যাংকিং কমিশন করার কথা বলেছি৷ একটা ব্যাংকিং অ্যাক্ট করা হয়েছে৷ এখন সেই আইন অনুযায়ী স্বেচ্ছা খেলাপি এবং প্রকৃত খেলাপি আলাদা করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আর দেউলিয়া আইনকে কার্যকর করতে হবে৷ এখন সব অর্থঋণ আদালতে যায়। আপনি ঋণ খেলাপি হবেন আবার মার্সিডিজ হাঁকাবেন তা তো হতে পারে না৷ আর বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তারা যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে পারে। কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না।”

তার মতে একটি কমিশন গঠন করে খেলাপি ঋণের টাকা কোথায় গেছে তা বের করতে হবে৷ দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুক তা উদ্ধার করতে হবে৷ আর ঋণের বিপরীতে যে জামানত বা সম্পদ দেখানো হয়েছে তার কী অবস্থা তাও দেখতে হবে৷ ‘‘এই কাজগুলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে করতে হবে। তা না হলে আইন করে কোনো কাজ হবে না। আইন যদি প্রয়োগ করা না যায় তাহলে তো সেই আইনে কোনো লাভ নেই,” বলেন তিনি৷

# হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে,  ঢাকা