চলমান সংবাদ

বিশ্ব মানবাধিকার দিবস

-তপন দত্ত

পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ উগ্ররুপ ফ্যাসিবাদের উত্থানের ফলে বিশ্বের দখলকৃত উপনিবেশ সমূহের পুনর্বন্টন ও পুণর্বিন্যাসের লক্ষ্যে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান, মুসোলিনির নেতৃত্বে ইটালি ও জাপানের তোজো সরকার। আফ্রিকা, এশিয়ার এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনেকগুলো অনুন্নত দেশ তখন বৃটেন, ফ্রান্স, স্পেন পর্তুগাল ইত্যাদি দেশের জবর দখল করা উপনিবেশ ছিল। বাংলাদেশসহ ভারত বর্ষ ছিল বৃটেনের দখলে প্রায় ২০০ বছর ধরে। উনবিংশ শতাব্দীর ২য় দশকে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর পৃথিবীর দেশে দেশে বৃটেন সহ পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাঁধন আলগা হতে থাকে।

সমসাময়িক কালে অনুন্নত ঔপনিবেশিক দেশগুলোকে নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য যে নব্য ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ঘটে হিটলারের নেতৃত্বে। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৫ সালে গোটা বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাজার দখলে লালসার বলি হয় বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ। মানুষের শ্রমে ঘামে সৃষ্ট সভ্যতা, উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রাভিযানে হিটলারের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন আমেরিকা তার নব আবিস্কৃত পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নসহ গোটা বিশ্বকে পারমানবিক বোমা ভীতির মধ্যে রাখা। ফলে ২টি শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে। মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী একটি বিভীষিকাময় নরক যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করে। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার কারণে এখনো হিরোসীমা নাগাসাকিতে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে প্রবল ঘৃণা/জনমত গড়ে ওঠে।

১৯৪৫ সালে ৯ মে ২য় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়। হিটলারের পতনের পটভূমিতে শান্তি পূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ গঠিত হয়।

জাতিসংঘ যুদ্ধের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নেয়। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধহীন বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা গৃহীত হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ১ম ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত না হলেও আঞ্চলিক যুদ্ধের অবসান হয়নি যা আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের বাতাবরন তৈরী করে রেখেছে। বিশ্বের বিভিন্ন অংশে আঞ্চলিক যুদ্ধ এখনও অব্যাহতভাবে চলমান। এইসব আঞ্চলিক যুদ্ধের সর্বগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত।

আমাদের দেশ জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য সনদে স্বাক্ষর করেছে, যাকে সংক্ষেপে এস.ডি.জি বলা হয়।

এস ডি জি র ৮নং ধারটির লক্ষ্য হচ্ছে শ্রম ও শ্রমিক সংক্রান্ত। এই ধারায় ১৭টি উপধারা সংযুক্ত হয়েছে। প্রধান প্রধান বিষয়গুলো শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, শ্রমজীবী মানুষের মানুষ পরিবার নিয়ে বাঁচার মত মজুরি, কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পন্ন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসমূহ নিশ্চিত করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করেনা।

শ্রমিকদের জীবন ধারণের উপযুক্ত মজুরি নিশ্চিত নয়। সংগঠন করার অধিকার মালিকপক্ষ ছলে বলে কৌশলে খর্ব করে রাখে। প্রশাসন ও এগুলো নিশ্চিত করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনা। ফলে দেশের ৭ কোটি ৩৩ লক্ষ (বিসিএস জরিপ অনুযায়ী) শ্রমজীবী মানুষ উপযুক্ত খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান থেকেও বঞ্চিত। অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষ তার মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি, মজুরী বৈষম্য, মাত্রাতিরিক্ত খাটুনির ফলে সংসার জীবন ও মসৃণ নয়। মানবাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই সমস্ত বিষয়গুলো। অথচ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ২৩,২৪,২৫ ধারায় স্বাধীনভাবে চাকুরি বেছে নেওয়ার বেকারত্ব থেকে রক্ষা পাওয়া, সমান কাজের জন্য সমান মজুরী, শ্রমজীবি মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য অনূকুল ও ন্যায্য পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, স্ব–স্বার্থে বলার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার অধিকার, কর্মের যুক্তিসঙ্গত সীমা, বিশ্রাম, অবসরের অধিকার, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান–চিকিৎসা প্রয়োজনীয় ইত্যাদি নিশ্চিত করা হযেছে।

সার্বজনীন মানবাধিকারে ধারা (৩০ নং) উল্লেখ করা হয়েছে। ‘কোন রাষ্ট্র, ব্যক্তি গোষ্ঠী এ ঘোষণা পত্রের কোন কিছুকেই এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেনা, যার বলে তারা এই ঘোষণা পত্রের উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ লক্ষ করতে পারে এমন কাজে লিপ্ত হতে পারেন কিম্বা যে ধরনের কোন কাজ সম্পাদন করতে পারেন।’ বাংলাদেশ এস ডি জি তে স্বাক্ষরকারী ও মানবাধিকার রক্ষায় স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে সকল প্রকার সামাজিক বৈষম্য নিরসনে অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা এই সব অঙ্গীকারের সাথে সামঞ্জস্যহীন।

শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী কোন সেক্টরে নিশ্চিত নয়, ভদ্রভাবে সামাজিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংঘবদ্ধ হবার অধিকার মানবাধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আইনী স্বীকৃত হলেও মালিকদের ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী, প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়। বিদ্যমান শ্রম আইনের ট্রেড ইউনিযন অধিকারকে অবাধ করে না এবং আইএলও কনভেনশন ৮৭, ৯৮ এর সংঙ্গতিপূর্ণ নয়।

দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবি মানুষ (৭.৩৩ কোটি বিসিএস জরিপ অনুযায়ী) বৈষম্য ও বঞ্চনা শিকার হচ্ছে। দেশের অর্ধেকের কাছাকাছি মানুষ যখন বৈষম্য এবং অধিকার বঞ্চিত হয় তখন স্বাভাবিকভাবে মানবাধিকারের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেনের একটি উদ্ধৃতি দিতে চাই। তিনি বি আই ডি এস এর মহাপরিচালক। গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছেন, ‘দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে। এটি উদ্দেশ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে এক দেশে দুই সমাজ গড়ে উঠেছে, এই বৈষম্য কমাতে হলে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। আর অর্থ পাচার দাপ্তরিকভাবেও স্বীকৃত। তিনি আয় ব্যয় জরিপের সূত্রে বলেন দেশে এখন গিনি সহগ মান ০.৫০ শতাংশ ২০২২ সালে যা ছিল ০.৩৩৪ শতাংশ। প্রসঙ্গত গিনি সহগ মান শূন্য হওয়ার অর্থ হলো সমাজে চূড়ান্ত সমতা আছে .১(এক) হলে বুঝাবে চূড়ান্ত অসমতা রয়েছে। ০.৫০ শতাংশ হলে বুঝায় উচ্চ অক্ষমতা চলছে।’ তিনি আরও বলেন বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরী করছে ২টি সমাজ। তিনি বলেন চিকিৎসা নিতে গিয়েও মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে চলে যাচ্ছে। দেশের ২০% দরিদ্র সীমার আশে পাশে অবস্থান করে।

দেশের উপরোক্ত বিদ্যমান পরিস্থিতি মানবাধিকারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আর্ন্তজাতিকভাবে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই মাৎস্য ন্যায় অবলম্বন করে যারা বিশ্বব্যাপী ৩য় বিশ্ব যুদ্ধের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, অস্ত্র উৎপাদন ও অস্ত্র রপ্তানী করে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করার প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টাও সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মিয়ানমারের মত একটি প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ একটি দেশ বিশ্ব মোড়লদের আসকারায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী নির্মমভাবে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। কারেন, সান, চীন সহ অসংখ্য উপজাতির মানবাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করেছে।

তাই বিশ্ব্বে মানবাধিকার রক্ষা তেমনি স্বদেশেও মানবাধিকার তথা বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সংঘবদ্ধ চেষ্টা বিশেষত: মেহনতি মানুষের যৌথ কন্ঠই উচ্চারিত হওয়া সময়ের দাবী।

শেষ করতে চাই আরেকজন পন্ডিতজনের একটি সময়োচিত উদ্বৃতি দিয়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক লেখক ও শিক্ষাব্রতী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন,‘আমাদের একটা মূল সমস্যা হচ্ছে, সংঘাত সংঘর্ষের ভেতর থেকে আমরা প্রকৃত শত্রুকে ভুলে গেছি। আমাদের শত্রু দরিদ্র, সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য এবং যারা তা সৃষ্টি করে তারা। বৃহৎ পুঁজির ও বাজারের শাসন আমাদের শত্রু, ভূ–রাজনীতির নানা কুটচাল আমাদের শত্রু, সাম্প্রদায়িকতা আমাদের শত্রুগুলো মোকাবেলায় আমাদের কোন উদ্যোগ নেই। আমরা শত্রু ভাবি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, তত শত্রু শত্রু হুংকার প্রবল হচ্ছে। অথচ প্রকৃত শত্রুগুলো আরও প্রবল হচ্ছে।’ (৫ ডিসেম্বর, প্রথম আলো)। সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও জাতিসংঘের এই বছরের প্রতিপাদ্য হলো, ‘সবার জন্য স্বাধীনতা, সমতা, ন্যায়বিচার’। কিন্তু উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে আমরা কি জাতিসংঘের এই আহ্বানের কোন যথার্থতা লক্ষ্য করছি।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলা।