চলমান সংবাদ

জিও ব্যারেন্টস থেকে অভিবাসী আবদুল্লাহ: “পরিবারের শূন্যতা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি”

ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার হয়ে ব এমএসএফ এর উদ্ধার জাহাজে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসী আবদুল্লাহ।

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ)-এর উদ্ধারকারী জাহাজ থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টসের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশি অভিবাসী আব্দুল্লাহ। লিবিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধারের কয়েক ঘন্টা পরেও আব্দুল্লাহর উদ্বেগ কাটেনি। লিবিয়ার আটককেন্দ্রে বন্দিদশার কথা মনে পড়লে এখনো ঘুমাতে পারেন না এই অভিবাসী।

জিও ব্যারেন্টস জাহাজ থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টসের বিশেষ প্রতিনিধি মার্লেন প্যানারা। 

শুক্রবার (৩ নভেম্বর) রাতে ৩০ বাংলাদেশির সঙ্গে উদ্ধার হয়ে জিও ব্যারেন্টস জাহাজে আশ্রয় পেয়েছেন আবদুল্লাহ। কিন্তু সমুদ্রের মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বেঁচে গেলেও নিজের ভবিষ্যত ও পরিবার নিয়ে চিন্তা কাটেনি তার।

ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “দেশে রেখে আসা স্ত্রী ও সন্তানের চিন্তায়, উৎকন্ঠায় দীর্ঘ রাত পর্যন্ত আমি ঘুমাতে পারিনা।”

আরো কয়েকজনের সঙ্গে লিবিয়ার ত্রিপোলির কাছের একটি সমুদ্র সৈকত থেকে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। এমএসএফ এর সহায়তায় উদ্ধার হয়ে এখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত অভিবাসী আবদুল্লাহ। উদ্ধারের উচ্ছ্বাস এই ২৯ বছর বয়সি বংলাদেশিকে সমুদ্রের অনিশ্চিত যাত্রা ও বিপদের অনেক স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে।

দুই হাজার ডলারে লিবিয়া থেকে সমুদ্র যাত্রা

শনিবার সকালে ঘুম ভাঙার পর জাহাজের ডেকে তার সঙ্গে কথা হয় ইনফোমাইগ্রেন্টসের। তিনি বলেন, “আজ সকালটা আমার জন্য বেশ কঠিন। আমি রাতে ভাল ঘুমাতে পারিনি। অভিবাসী নৌকা থেকে আমি উদ্ধার হলেও ওই সময়কাল এখনো আমার মাথায় ঘুরছে। সারা রাত মাথায় এটি কাজ করেছে। আমি সত্যিই নৌকায় ভয় পেয়েছিলাম। আপনি হয়ত জানেন উদ্ধার না হলে আমরা মারাও যেতে পারতাম।”

আবদুল্লাহ যোগ করেন, এই যাত্রার জন্য আমি অনেক টাকা দিয়েছিলাম। মোট দুই হাজার ডলার [প্রায় এক হাজার ৮০০ ইউরো] যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়েছিল। আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। আমার শ্বশুর এবং আমার ভাই আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

দুই মাস আগে নিজ দেশ ছেড়ে আসেন এই বাংলাদেশি। প্রথমে ভারতে, তারপর সেখান থেকে দুবাই। দুবাই থেকে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে পৌছান তিনি।

আবদুল্লাহ বলেন, “বেনগাজি থেকে আমাকে অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে একটি গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। লিবিয়ানরা আমাদের তাদের গাড়ির পিছনে বসতে নির্দেশ দিয়েছিল। নিজেদেরকে যতটা সম্ভব ছোট করার জন্য তারা আমাদের পিঠে লাথি মেরেছিল। মূলত আমাদের যেন গাড়িতে দেখা না যায় সেটি তারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। কারণ ত্রিপোলির রাস্তায় মিলিশিয়াদের টহল রয়েছে। এই যাত্রার জন্য আমরা ছয়টি ভিন্ন গাড়ি ব্যবহার করেছিলাম।”

জাহাজের এক কোনায় বসে তিনি বলতে থাকেন, আমি লিবিয়ায় দুই মাস ছিলাম। আমি ঠিক কোথায় ছিলাম নিজেও জানি না। আমরা অন্যান্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে ছোট ছোট বিল্ডিংয়ে ছিলাম। এটা খুব কঠিন এবং বেদনাদায়ক সময় ছিল। আমরা প্রথম যখন এলাকাটিতে পৌঁছাই, চারজন লিবিয়ান তাদের অস্ত্র দিয়ে আমাদের হুমকি দেয়। তাদের একজন আমার মাথায় বন্দুক রেখে বলল, ‘তোমার যা আছে সব আমাকে দাও।’ তারা আমার কাছে থাকা টাকা, কাগজপত্র, ফোন রেখে দেয়।

ব্যথাতুর কণ্ঠে তিনি বলেন, “এই ঘটনা মনে পড়লে আমার খুব খারাপ লাগে। কারণ তারা ফোন নিয়ে ফেলার পর থেকে আমার পরিবারের কাছে আর কোনো খবর পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আমার ফোনে পরিবারের ছবি ছিল।”

অর্থনৈতিক সমস্যা

“আমি রাজধানী ঢাকা থেকে বেশ দূরের জেলা থেকে এসেছি। আমি দেশে একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছি। আমার জন্য এটি কঠিন ছিল। আমি দৈনিক খুব অল্প টাকা মজুরি পেতাম। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এক কেজি চালের দাম প্রায় ৭০ থেকে ১০০ টাকা। এক বোতল পানির দাম ২০ টাকা। আমার সন্তান জন্মের পর খুব অসুস্থ ছিল। তিন মাস ধরে নিয়মিত হাসপাতালে চিকিৎসা করতে হয়েছে এবং ওষুধ কিনতে হয়েছে। এতে করে আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে আমার সন্তানের বয়স চার মাস”, বলেন আবদুল্লাহ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। তবে জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশে বেড়েছে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য এবং আয় বৈষম্য। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এই হার বেশি।

করোনা মহামারির পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশ কিছু খাতে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। সেই সঙ্গে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির মতো বিষয়। কয়েক বছর আগেও এক ইউরোর বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান ছিল ৮০ থেকে ৯৫ টাকা। এখন সেটি ১২০ টাকা অতিক্রম করেছে।

এনজিও অক্সফ্যাম জানিয়েছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য চরম আকার ধারণ করেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই প্রতিদিন এক ডলারেরও কম আয় করে।

রাজনৈতিক সংঘাত

আবদুল্লাহ জানান, “রাজনৈতিক সংঘাত বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিরোধী রাজনৈতিক সমর্থক ছিলাম। যার ফলে স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে একমত না হলে খুন হওয়ার ঘটনা খুব স্বাভাবিক।”

তিনি যোগ করেন, বিগত কয়েক বছরে আমি এলাকায় প্রকাশ্যে বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছি। কিন্তু কোন বিচার পাইনি। আমাকে বারবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশে আবারও বড়েছে সংঘাত। শেষ পর্যন্ত আমি দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগস্টের শুরুতে প্রকাশিত রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দূরদর্শী আইকন’ হিসেবে ক্ষমতার মেয়াদ শুরু করলেও ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা এই নারী প্রধানমন্ত্রী। র‍্যাবসহ দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অধিকার সংস্থাগুলো।

২০২৪ সালের সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ২৮ অক্টোবর বিরোধীদের ব্যাপক বিক্ষোভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। গত সপ্তাহে রাজনৈতিক সংঘাতে অন্তত দুই বিরোধী সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপি বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোর উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, “২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর দেশজুড়ে বিভিন্ন বিরোধী দলের অন্তত আট হাজার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।”

এই ঘটনায় ৫ নভেম্বর নিন্দা জানিয়েছেন ইইউ’র পররাষ্ট্র প্রধান ও ইইউ কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেল ফন্টেলেস। তিনি দুই পক্ষকে সহনশীল থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

“পরিবারের শূন্যতা”

আবদুল্লাহ বলেন, “রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে আমার জীবন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আর ঝুঁকি নিতে পারিনি। আমার অনেক বন্ধু ও কাছের লোক বর্তমানে জেলে আছেন। তাদের পরিবার অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করছে। অনেকেই তীব্র অর্থ কষ্টে ভুগছেন। আমার কাছে একমাত্র সমাধান ছিল বিদেশ চলে যাওয়া ও ইউরোপের পথে যাত্রা করা।”

“জিও ব্যারেন্টস আমাদের উদ্ধার করায় আমি খুব খুশি। আমি সত্যিই ভাগ্যবান, আমি কখনই ভাবিনি যে আমাদের এত দ্রুত উদ্ধার করা হবে। রাতে সমুদ্রের মাঝখানে যখন আমি এই বড় জাহাজটি দেখেছিলাম, তখনও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। এখন এখানে একটি ভাল পরিবেশ পেয়েছি। আমরা গান গেয়ে ও আড্ডা দিয়ে সময় পার করছি”, বলেন আবদুল্লাহ।

সবশেষ তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “উদ্ধার হওয়ার পর আমরা মজা করলেও আমি আসলে একই সঙ্গে সুখী এবং চিন্তিত। আমার মাথায় সবসময় আমার পরিবারের চিন্তা কাজ করে। আমার বাবা বর্তমানে ৮০ বছর বয়সি। আমার চার ভাই এবং এক বোন আছে। তারা নিশ্চয়ই ভাবছে আমি এখনো বেঁচে আছি কিনা। ইটালি উপকূলে নামলে একটি ফোন পেলে আমি তাদের জানাতে পারব। আমার স্ত্রীর কথা আমার অনেক পড়ছে। লিবিয়ায় ফোন না থাকায় অনেকদিন তাদের চেহারা দেখিনি। আমি তাদের শূন্যতা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি।”

এমএইউ/টিএম   (ফ্রান্স২৪/আরএফআই/ইনফোমাইগ্রেন্টস)