সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল নিয়ে কিছু কথা -অপর্ণা চক্রবর্তী
১৯১৫ সালে আলবার্ট আইন্সটাইন তাঁর থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন। আর এর এক সপ্তাহের মধ্যেই কার্ল শোয়ার্ডশেড জেনারেল রিলেটিভিটি র সূত্রানুযায়ী গাণিতিক সমীকরণে ব্ল্যাকহোল এর মত কিছু একটার অস্তিত্ব দেখান। কোনো বিশাল ভরের নক্ষত্রকে যদি খুব ই ছোটস্থানে সংকুচিত করে আনা হয় তবে এই বিশাল ভরের কারণে স্পেস টাইমের বক্রতা হবে এক্সট্রিম। আর এই এক্সট্রিম পয়েন্টের নির্দিষ্ট সীমার মাঝে যেকোনো বস্তু পতিত হলে তা আর ফিরতে পারবে না, এমনকি আলো পর্যন্ত বের হতে পারবে না। একটি বিশাল ভরের নক্ষত্র কে যদি অতি ক্ষুদ্র স্থানে কম্প্রেস করা যায় তখন সেই এক্সট্রিম পয়েন্টে এমন কিছু তৈরি হবে যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এত প্রবল যে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র সেখানে কাজ করেনা, সময় স্থির হয়ে যায়। যে নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে সব এই মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যায়, তার নাম ইভেন্ট হরাইজন। আর ব্ল্যাকহোলের ভেতরে কি হয় বিজ্ঞানীদের তার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই।
ব্ল্যাকহোল এর ধারণা আসে ম্যাথমেটিকাল ইকোয়েশান থেকে , কিন্তু আসলে ব্ল্যাকহোল একজিস্ট করে কিনা তা প্রমাণ করতে পরবর্তী ৭৫ বছর লেগে যায়। ১৯৩১ সালের পর থেকে রেডিও ওয়েভ এবং এক্সরে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে জ্যোতির্বিদ্যায়। বিজ্ঞানীরা রেডিও টেলিস্কোপে কিছু হট স্পট দেখতে পান। এই হট স্পট গুলো দেখতে ছিল দূর থেকে আসা নক্ষত্রের মতো। কিন্তু বিজ্ঞানীদের বোধগম্য হচ্ছিল না, এই অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোগুলো আসলে কী?
তাঁরা ইলেক্ট্রো ম্যাগ্নেটিক স্পেক্ট্রাম পর্যবেক্ষণ করেন, কিন্তু তাতেও ফলাফল বিভ্রান্ত করছিল। শেষে তাঁরা দেখতে পান, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেক্ট্রাম হাইড্রোজেন নির্দেশ করছে। তার মানে এই অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোগুলো একটা থেকে আরেকটা প্রচন্ড গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন না এত দূর থেকে আসা আলো একলক্ষ কোটি বা তার থেকে বেশি সূর্যের শক্তি প্রদর্শন করছে। এই অত্যাধিক শক্তির উৎস কীভাবে সম্ভব? কেমিক্যাল এনার্জি বা নিউক্লিয়ার এনার্জি থেকে এত বিপুল শক্তি আসা সম্ভব না।
একটাই উত্তর, তা হলো গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ। এর ও প্রায় একযুগ পর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন এই বিশাল বিশাল আলোর উৎস হলো একেকটি বিশাল বিশাল ব্ল্যাকহোল।আর এই বিশাল বিশাল ব্ল্যাকহোলের চারপাশের ঘূর্ণায়মান অ্যাক্রিয়েশান ডিস্ক থেকেই এত বিপুল উজ্জ্বলতা তৈরি হচ্ছিল। যাদের আমরা এখন জানি কোয়েজার হিসেবে। রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে আবিষ্কার বলে তাদের নাম কোয়াইজি রেডিও স্টেলার অব্জেক্ট, সংক্ষেপে কোয়েজার। কোয়েজারসের কেন্দ্রে থাকা এই একেকটি ব্ল্যাকহোল কে বলে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। যাদের একেকটির ভর আমাদের সূর্যের ভরের লক্ষ ‘লক্ষ থেকে কোটি কোটি গুন।
আমরা আমাদের নিত্যকার জীবনে মাধ্যাকর্ষণ কে অত্যন্ত দুর্বল বলে জেনে এসছি। কিন্তু একটি বিশাল ভরের বস্তুকে যদি একটি অতি ক্ষুদ্র পয়েন্টে কম্প্রেস করা হয় তখন মাধ্যাকর্ষণের শক্তি হয় অকল্পনীয়।
প্রথম আবিষ্কৃত ব্ল্যাকহোল সিগ্ন্যাস এক্স ওয়ানের ভর আমাদের সূর্যের ভরের মাত্র ২১ গুন। কিন্তু কোয়েজারসের কেন্দ্রে থাকা এইসব সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের কোটি কোটি গুন ভরের চেয়েও বিশাল। আর এই বিশাল সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলেরা প্রত্যেক গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থান করে। তখন ই প্রশ্ন এলো আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে কি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল রয়েছে?
১৯৯০ সালে এই তথ্য প্রমাণের জন্য বিজ্ঞানীরা একটি প্রজেক্ট হাতে নেন। কিন্তু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে থেকে তার কেন্দ্র কে পর্যবেক্ষণ করা খুব কঠিন। কারণ পৃথিবী থেকে মিল্কিওয়ে র কেন্দ্রের দূরত্ব ২৭০০০ আলোকবর্ষ। আর এই দূরত্বে প্রচুর নক্ষত্র, গ্যাস, ধুলিকণা। কেন্দ্রের সার্ফ ইমেজ পাওয়া খুব কঠিন। এত জটিলতায় ও নানারকম প্রযুক্তির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা মিল্কিওয়ে র কেন্দ্রের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের উপস্থিতি সর্বতো ভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। ২০২২ সালের ১২ ই মে এই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ছবি প্রকাশ করেন।
আমাদের এই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের নাম দেন সেজেটেরিয়াস এ স্টার। এই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের ভরের ৪৪ লক্ষ গুন। তার ইভেন্ট হরাইজনের ব্যাসার্ধ সূর্যের ব্যাসার্ধের ১৭ গুন। মিল্কিওয়ে র প্রতিবেশি গ্যালাক্সি এন্ড্রোমিডা র কেন্দ্রের সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের ভরের প্রায় আট থেকে দশ কোটি গুন। তার ইভেন্ট হরাইজন আমাদের বুধ,শুক্র,পৃথিবী, মঙ্গলের কক্ষপথ পেরিয়ে যাবে। এতই বিশাল।
এখন প্রশ্ন হলো এই এত বিশাল বিশাল সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল তৈরি হয় কীভাবে? কারণ আমাদের এই ইউনিভার্সে এত বিশাল ভরের নক্ষত্র নেই। আর অনেক ভরের নক্ষত্র তার মৃত্যুর পর ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়ে গ্যাস,ডাস্ট এসব গিলে খেয়ে খেয়েও এত বিশাল হতে বিগব্যাং এর চেয়েও বেশি সময় দরকার। কিন্তু তাতো সম্ভব না। তাহলে এত বিশাল হয় কীভাবে? আর ব্ল্যাকহোল খুব দ্রুত নক্ষত্র গিলে খেতে পারে না। কারণ অ্যাক্রিয়েশন ডিস্কে ঘূর্ণায়মান গ্যাস,ডাস্ট, রেডিয়েশানের তৈরি শক্তিশালী জেটস ব্ল্যাকহোলের আশেপাশের গ্যাস ডাস্ট বা পারটিক্যাল কে বহুদূরে সরিয়ে দেয়। আর এই জন্য একটি ব্ল্যাকহোল একটি নক্ষত্রকে হুড়মুড় করে খেতে পারে না। তার গিলে খেতেও একটি লিমিট আছে, যাকে বকে এডিংটন লিমিট। তাহলে এই বিশাল ভর আসে কোথথেকে? কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গুলো জন্ম থেকেই এত বিশাল হয়ে জন্মেছে। তাদের মাঝে নক্ষত্রের জন্মের পর্ব ঘটে নি।
এটা একটি ধারণা মাত্র।
আইন্সটাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি অনুসারে ইউনিভার্সে কোনো বিশাল ভরের বস্তুর মুভমেন্টের সময় স্পেসে ঢেউ এর সৃষ্টি হয়। তাকে বলে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। এটা প্রমাণ করতে পারলে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল সম্বন্ধে একটা ধারণা আসতে পারে।
এই লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা ইউ এস এ র লাইগো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে এই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ পরীক্ষার জন্য দুটি ভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় ইন্সট্রুমেন্ট স্থাপন করেন। এখানে তারা বেছে নেন আলোকে। একটি উৎস থেকে আলো দুটো ভাগ হয়ে প্রতিফলিত হয়ে মিলবে একস্থানে। এখানে অনেক শ্রম,ঘাম, মেধা খাটানো হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আশাতীত ভাবে পাওয়া গেল আশ্চর্য গলাফল। গ্রাফে যে পিকটি এসেছে, তা দুটি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ। যা সংঘটিত হয়েছিল ১৩০ কোটি বছর আগে।
বিজ্ঞানীরা এই আশ্চর্য ফলাফলে এটা বুঝলেন, ব্ল্যাকহোল শুধু পারটিক্যাল গ্রাস করে না। ব্ল্যাকহোল ব্ল্যাকহোল কেও গ্রাস করে। আর দুটো মিলে আরো বিশাল ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। এভাবে রিপিট হতে হতেই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের জন্ম হয়। আইন্সটাইনের গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ১০০ বছর পর প্রমাণিত হলো।
আজ এইটুক ই থাক।
লেখক পরিচিতি – অপর্ণা চক্রবর্তী ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কিশিনেভ স্টেট ইউনিভার্সিটি যান। পিওর কেমিস্ট্রিতে ১৯৯১ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন। পরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কেমিস্ট হিসেবে তিনবছর কাজ করেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত একটি বেসরকারি স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেঁচে থাকার জন্য বহু কিছু ভালবাসেন। তার মধ্যে বাগান করা, গান শোনা, বেড়ানো, ছবি তোলা, রান্না করা অপর্ণার বিশেষ শখ।