বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৯৭): নস্টালজিয়া

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

এক সময় আমার ধারণা ছিল যে যদি না ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হত তাহলে হয়তোবা মানুষকে এতটা দুর্গতি ভোগ করতে হত না। এখন মনে হয় যেকোন বিভাজনই দুর্ভোগ ডেকে আনে। তবে একথাও ঠিক প্রায় প্রতিটি ঘটনাই একদলের জন্য যেমন সুখবর বয়ে আনে অন্য দলের জন্য তেমনি বয়ে আনে দুঃখ। এভাবেই মনে হয় প্রকৃতি ভালো মন্দের ব্যালেন্স ঠিক রাখে। মানুষ যখন দীর্ঘ দিন কোন অর্থনৈতিক জোনে বাস করে তখন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক, নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে।

ভারত বিভাগ নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। মুসলিম লীগের ধ্যান জ্ঞান ছিল ভারত বিভাগ, এটা ছিল সেই দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু যখন বাংলা বিভাগের প্রশ্ন আসে তখন এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন মতামত সামনে চলে আসে। কেউ দোষ দেয় সহরোওয়ার্দি, জিন্নাহকে, কেউ শ্যামাপ্রসাদ আর নেহেরুকে। এই তো সেদিন একজন লিখল মুসলিম প্রধান বাংলায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কখনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন না আর মুসলিম নেতারা বোঝাতে পারেন নাই যে বাংলা ভাগ না হলে তারা পাকিস্তানে যোগ দেবেন না। কথাটা আংশিক সত্য। কেননা কংগ্রেস তো বটেই, এর বাইরে অধিকাংশ হিন্দু নেতা অবিভক্ত ভারতের কথা বলেছেন। বাংলার প্রথম সারির হিন্দু নেতারা নিজেদের সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে দেখেছেন। তা সে চিত্তরঞ্জন দাশ হোক, সুভাষ বোস বা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হোক। বাংলার মুসলিম নেতারা যেহেতু অবিভক্ত ভারতের ধারণা প্রথম থেকেই খারিজ করে দিয়েছিলেন তাই তারা নিজেদের কখনোই সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে দেখেন নি। সেদিক থেকে দুই পক্ষের নেতাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল দুই রকম। দ্বিতীয়ত ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় হিন্দু মুসলমানের যে ঐক্য গড়ে ওঠে সেটা আর ছিল না। এমনকি যদি পাকিস্তান সম্পর্কিত লাহোর প্রস্তাবের আগেও অবিভক্ত বাংলার প্রশ্ন আসত সেটা হবার যে সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু ১৯৪৬ সালের ক্যালকাটা কিলিংএর পরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকে। আর এসব কারণেই বাংলা ভাগের পক্ষে যারা ছিল তারা নিজেদের পক্ষে সমর্থন গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু এসব ভাগবাটোয়ারা হয় নেতাদের মধ্যে, এর ফল ভোগ করে নেতারাই। সাধারণ মানুষ, যাদের স্বার্থ আদায়ের কথা বলে এসব ঘটে তারা বরাবরই রিসিভিং এন্ডে থাকে। তাদের মালিক বা রাজা পরিবর্তন হয়, কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। তাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে না।

আসলে ভাগ শব্দটা সব সময়ই ঋণাত্মক ধারণা বহন করে। যদি যোগ বা গুন ধনাত্মক হয়, তবে এমনকি পাটীগণিতেও বিয়োগ আর ভাগ ঋণাত্মক। শুধু তাই নয় যদি দুটো প্রাকৃতিক সংখ্যা যোগ বা গুন করে আমরা আবারও প্রাকৃতিক সংখ্যা পাই আর এক্ষেত্রে আমরা “ক” এর সাথে “খ” যোগ বা গুণ করছি, নাকি “খ” এর সাথে “ক” তাতে কিছু এসে যায় না, বিয়োগ বা ভাগের ক্ষেত্রে সেটা ঠিক নয়। ছোট সংখ্যা থেকে বড় সংখ্যা বিয়োগ করলে আমরা পাব ঋণাত্মক সংখ্যা যা প্রাকৃতিক সংখ্যা নয় কারণ ঋণাত্মক সংখ্যার ধারণা আছে, কিন্তু বাস্তব রূপ নেই, একই ভাবে একটা সংখ্যা নিয়ে আরেকটি সংখ্যা ভাগ করলে আমরা প্রাকৃতিক সংখ্যা না পেয়ে ভগ্নাংশ পেতে পারি যা প্রাকৃতিক নয়। অর্থাৎ ভাগ একেবারে ভিন্ন গুন সম্পন্ন নতুন কিছু দিতে পারে।

এর আগে কোথায় যেন লিখেছিলাম দেশ ভাগ হয় ভৌগলিক সীমা রেখা নির্ধারণ করে, কিন্তু সীমান্ত রেখা প্রায় সব সময়ই মানুষের হৃদয় ভেদ করে যায়। সারা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন কারণে দেশের ভেতরে বা ভিন দেশে মাইগ্রেট করে। কেউ যায় বাধ্য হয়ে, কেউ যায় নিরাপত্তা অথবা উন্নত জীবনের সন্ধানে। কিন্তু যেটা সত্য তা হল প্রায় সবাই যায় বর্তমান বাসস্থানে সে নিজেকে পুরোপুরি বিকাশ করতে পারছে না বলে। গিয়ে সবাই যে সুখী হয় তা নয়। আবার যারা যায় তাদের একদল যায় সাময়িক ভাবে। ভিন দেশে বা অন্য এলাকায় কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জন করে দেশে ফিরে আসবে বলে। আবার অনেকেই যায় চিরতরে। বিশেষ করে দ্বিতীয় দলের লোকজন নতুন দেশকে নিজের দেশের মত আপন করে নেয়, সেই দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, সে দেশকে নিজের দেশ মনে করে ভালবাসে। কিন্তু এসব করে সরকারের অনুমতিক্রমে। আমি ধরে নিচ্ছি যে সবাই সেখানে লিগ্যালি আছে। এর মানে কিন্তু এই নয় নতুন দেশের জনগণ তাদের গ্রহণ করে নেবে। এখন কোন এক সময়ে সরকার যদি মত পরিবর্তন করে, বা সরকার তার নীতি বদলায় তাহলে দেখা যাবে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লোকজন বেআইনি না হলেও অনভিপ্রেত হবে। তখন? এই যে এরা এত দিন ধরে সেই দেশের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলল, সেখানে ঘর বাঁধল – জীবনের এক পর্যায়ে এসে দেখল তারা কেউ না। এটা যে কারো সাথেই ঘটতে পারে। বর্তমানে সেটা ঘটছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে মূলত রুশদের সাথে যারা বিপ্লবের পর বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে গিয়েছিল সেসব দেশ গড়ে তুলতে; সেই দেশ, সেই মাটিকে নিজের করে নিয়েছিল যারা তারা কিন্তু আজ অনাহূত।  এরকম একটা অবস্থা কল্পনা করুন। পাশের দেশ ভারতে বিভিন্ন জাতির মানুষ বাস করে। কোলকাতায় মারোয়ারিদের ব্যবসা বানিজ্য, মুম্বাইয়ে অন্যেরা। সারা ভারতেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালির ভিড়। এবং এরা এসব করছে নিজের দেশ মনে করেই, যেটা আসলেই তাই। এখন যদি কোন এক সময় দেশ জাতীয়তার ভিত্তিতে ভেঙ্গে যায় এই লাখ লাখ সফল মানুষের কি হবে? সেজন্যেই বললাম – ভাঙা সহজ, কিন্তু ভাঙ্গনের ফল গলাধঃকরণ করা কঠিন।

সোভিয়েত ইউনিয়নে সব প্রজাতন্ত্রেই ছিল কাজকর্মের সুযোগ। এমনকি মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া এলাকায়ও বেকারত্ব ছিল না। আজ তারা কাজের খোঁজে আসে রাশিয়ায়। ইউক্রেন, বাল্টিকের মানুষ কাজের খোঁজে যায় রাশিয়া আর ইউরোপ।
ছোটবেলায় বাড়িতে বিভিন্ন ধরণের পত্রপত্রিকা আসত। আসত দেশ আর আনন্দমেলা। ওখানেই এক গল্প ছিল এমন

এক চতুর প্রজা এসেছে রাজদরবারে।
মহারাজ আপনি তো আমাদের প্রজাদের ভাই বলেন। আপনি কি সত্যিই সেটা মনে করেন?
হ্যাঁ।
তার মানে আমিও আপনার ভাই।
অবশ্যই।
তাহলে আমাকে আমার হিস্যা বুঝিয়ে দিন।
মহারাজ খাজাঞ্চিকে বললেন ভাইয়ের পাওনার হিসেব বের করতে।
আধা পয়সা মহারাজ।
ওকে ওর প্রাপ্য আধা পয়সা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দাও।

আসলে যেকোন ভাগাভাগি মানেই সুযোগ ও সম্ভাবনার সীমাবদ্ধতা। এতে অল্প কিছু মানুষ লাভবান হলেও অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর একটা কারণ এরা ভাগের বা নতুন পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি করে না। আর যারা ভাগের হোতা তারা প্রায়ই এটা করে জনতার কথা ভেবে নয়, নিজেদের ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে। ফলে ভাগবাটোয়ারা হয় উপরের দিকে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে অনেককে এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে হয়েছে। এরকম অনেকের সাথেই আমার পরিচয় আছে। তাদের গল্প ভারত ভাগের ফলে স্থানান্তরিত মানুষদের গল্পের চেয়ে ভিন্ন নয়। আবার এমন অনেকের সাথেই দেখা হয়েছে যারা এই বিভক্তির ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে সে কথা বলে। এটা অনেকটা আগ্নেয়গিরির মত। বিশাল বিস্ফোরণের ফলে দেশ ভেঙ্গেছে কিন্তু রয়ে গেছে পটেনশিয়ালি আরও অনেক অনেক বিস্ফোরণের সম্ভাবনা। সেটাকেই শত্রুরা ব্যবহার করছে। আজ যে ইউক্রেনের সমস্যা – সেটা সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ফল। যেকোনো ভাঙ্গনের মূলে আছে ভুল বোঝাবুঝি।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (৯৬): নস্টালজিয়া -বিজন সাহা

কোন এক অজ্ঞাত কারণে দেশ ভাগের সুফল বরাবর অধরাই থেকে যায়। ভারত বিভাগের সময় জিন্নাহ বলেছিলেন দেশ ভাগ হলে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান হবে দুই সহোদরের মত। সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে আর দু’টো দেশ দুই ভাইয়ের মত একে অন্যের পাশে দাঁড়াবে।‌ তবে দারা সিকো আর ঔরঙ্গজেব এরাও দুই সহোদর ছিলেন। জিন্নাহ মনে মনে এই দুই ভাইয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা ভেবেছিলেন কিন সেটাই বা কে জানে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পূর্বে ইউক্রেনের গণভোটে একই কথা বলা হয়। রাশিয়া আর ইউক্রেনের সম্পর্ক আগের মতই থাকবে, স্বাধীন ইউক্রেনের মানুষ আর্থিকভাবে আরও বেশি উন্নতি করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কেন? আমার মনে হয় নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নেতারা এসব বন্ধুত্ব ও উন্নয়নের স্লোগান তুলেন। সাধারণ মানুষ তাতে শুধু উন্নতির স্বপ্ন দেখে, বিপদের গন্ধ পায় না। ফলে তারা দুই হাত তুলে সমর্থন জানায়। কিন্তু কাজ হাসিলের পরে নেতারা যখন মানুষের ভাগ্য বদলে ব্যর্থ হয় তখন তারা শত্রু খোঁজে। কে এই শত্রু? যার কাছ থেকে সে মুক্ত হয়েছে। অন্ততঃ এটাই আমরা দেখি ভারত, যুগোস্লাভিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যাদের কমন বর্ডার আছে বা যেসব দেশ পুরানো কেন্দ্রের উপর বেশি রকম নির্ভরশীল।

ভারত ভাগের সব চেয়ে খারাপ দিক হল এমনকি দেশ ভাগের পঁচাত্তর বছর পরেও এই সহজ সত্যটা অনেকেই মেনে নিতে পারেনি যে এটা অতীত ঘটনা, যারা যাওয়ার বা আসার তারা সেই সময়েই সেটা করেছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের জের ধরে আজও মানুষকে তার পৈতৃক ভিটা ত্যাগ করতে বাধ্য করা দেশভাগের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে ইউরোপ আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে জীবন কাটালে তুমি হিরো আর এমনকি খালি হাতে ভারত বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে আস্তানা গড়লে তুমি শত্রু। ইউরোপ আমেরিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলে তুমি জ্ঞানী আর নিজেকে অবিভক্ত ভারতের অংশ ভাবলেই দেশদ্রোহী। শত্রুতা কমানোর জন্যে ভিন্ন হলাম, অথচ আজীবন সেই শত্রুতা বহন করে যাচ্ছি। এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি হতে পারে? অথচ ১৯৪৭ পূর্ববর্তী ভারতবর্ষে এদেশের মানুষকে শোষণ করেছে ইংরেজরা। আমরা সেই ইংরেজদের ক্ষমা করতে পারি অথচ যারা ঠিক আমাদের মতই এই ইংরেজদের দ্বারা শোষিত ও শাসিত হয়েছে তাদের প্রতি ঘৃণা বয়েই চলছি। আর সেটা করছে শিক্ষত, অশিক্ষিত, বিশ্বাসী, যুক্তিবাদী প্রায় সবাই। এটাই মনে হয় দেশভাগের সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স।

 

মাটির মুক্তি মানেই মানুষের মুক্তি নয়।‌ সাধারণ মানুষ বরাবরই পরাধীন। তার মালিক বদলায়। বিদেশী মালিকের জায়গা নেয় দেশী মালিক। এতে হয়তো তার জীবনযাত্রার মানে হেরফের হয় কিন্তু মানুষের ভাগ্যের কোনই পরিবর্তন হয় না। তাকে কিছু মানুষের খামখেয়ালির শিকার হয়ে জীবন কাটাতে হয়। অন্তত ইতিহাস সেকথাই বলে।

হয়তো বা বর্তমান বিশ্বে যেখানে তথ্য ও প্রযুক্তির কল্যাণে সীমারেখা প্রায় মুছে গেছে মানব মানসিকতায় সেটা ঘটেনি। বিজ্ঞানের সাথে সাথে মানুষ নিজেকে, নিজের মনমানসিকতা বদলাতে পারেনি। তাই সে এখনও সুযোগ পেলেই পাশবিক রূপ দেখায়। প্রায় তিরিশ বছর আগে দ্বিজেন কাকু একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন। সেখানে এক ভারতীয় ভদ্রলোকের গল্প ছিল যিনি আমেরিকার এক নামকরা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। কিন্তু ভারতীয় বলে তিনি অর্থনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হতেন। অবশ্য সময় বদলে গেছে। হয়তো আমেরিকায় সেই বৈষম্য আর নেই। অথবা এমনও হতে পারে, যেহেতু তৃতীয় বিশ্ব থেকে যাওয়া যেকোনো লোকই আমেরিকায় তুলনামূলক ভাবে উন্নত জীবন যাপন করার সুযোগ পায় তাই তারা এসব বৈষম্য দেখেও না দেখার ভান করে। অথবা যে সমাজ ব্যবস্থার মূলে আছে বৈষম্য সেখানে এ নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। তবে অধিকাংশ মানুষ, যারা নিরাপত্তা বা অন্যান্য কারণে প্রথম বিশ্বে পাড়ি জমায়, তারা অনেকেই দিনের শেষে নতুন দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। ছোট দলের বড় নেতা অথবা বড় দলের পাতি নেতা – কোনটা কার জন্য ভালো সেটা মানুষ নিজে নিজে বেছে নেয়।

অনেক সময় মনে প্রশ্ন জাগে এই যে যারা দেশত্যাগ করছে তাদের সবারই কি দেশের জন্য মন পোড়ে? কারণ সবাই তো আর প্রাণের দায়ে দেশ ছাড়ে না, অনেকেই যায় উন্নত জীবনের সন্ধানে। বিশেষ করে যারা চিরতরে চলে যায়, যারা নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নতুন দেশের সাথেই জড়িয়ে ফেলে  – তারা কিভাবে দেখে তাদের অতীত আর কিভাবে মেলায় ভবিষ্যৎ স্বপ্ন? অধিকাংশ মানুষের মনের খবর আমরা জানতে পারি না। তবে যারা বাইরে বসেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করে, লেখালেখি হোক, গান বাজনা হোক অথবা বিভিন্ন জাতীয় দিবস হোক – এসবের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আবেগ ও ভালবাসা প্রকাশ করে তারা নিঃসন্দেহে জন্মভুমিকে খুবই মিস করে। তাই সামান্য সুযোগ পেলেই তারা ছুটে যায় প্রাণের টানে। আমি অনেককেই জানি বাবা মা দু’ জন বাঙালি বা একই ভাষাভাষী বলে যাদের ছেলেমেয়েরা বাংলায় বা বাবা মার মাতৃভাষায় কথা বলে, কিন্তু এরা অধিকাংশই সে ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। আর আমাদের মত যাদের মিশ্র পরিবার তাদের ছেলেমেয়েরা যে দেশে থাকে সেই ভাষাতেই কথা বলে। আমার ছেলেমেয়েরা অন্তত বাংলা বলতে বা পড়তে পারে না। তাই নিজে যেহেতু লিখি আর লিখি সবটুকু আবেগ দিয়েই অনেক সময় মনে হয় কী হবে এসব লিখে যদি সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলো এসব লেখা পড়তে না পারে। ভাষা জানলেই যে পড়ত তার কোন গ্যারান্টি নেই, তবে এখন যে পারছে না সেটা কিছুটা হলেও ব্যথিত করে। হয়তো সবাই নিজের নিজের মত করে ভিন দেশেও নিজের একটা দেশ তৈরি করে নেয়। আমি যখন ভোলগার তীর দিয়ে হাঁটি মনে হয় যেন কালীগঙ্গার তীর ধরেই হাঁটছি। বরফের কচ কচ শব্দ মনে করিয়ে দেশে কালীগঙ্গা নদীর চৈত্র মাসের উত্তপ্ত বালির শব্দ। আর বনে বাতাসের শো শো শব্দ বাঁশঝাড়ের হাওয়া হয়ে কানে প্রবেশ করে। বলা হয়ে থাকে মানুষ তার জীবনের একটা বড় অংশ পায় শৈশবে। শৈশব যেখানে কাটে সেই জায়গা বার বার ফিরে ফিরে আসে তার কল্পনায়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া