বিজ্ঞান প্রযুক্তি

ভয়েজার,এক বিস্ময়কর স্পেসক্রাফটের আশ্চর্য যাত্রা!

-অপর্ণা চক্রবর্তী

ফাইল ছবি অপর্ণা চক্রবর্তী

মানুষ সূচনা থেকেই প্রচন্ড কৌতূহলী। আর সেই কৌতূহল থেকেই আজ আমরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষতায় বসবাস করছি। সীমাহীন এক কৌতূহলের নাম -ভয়েজার। আজ লিখব ভয়েজার নিয়ে জানা না জানা কিছু তথ্য। ১৯৬৪ সালের দিকে গ্যারি আরনল্ড ফ্ল্যান্ড্রো ক্যালকুলেশন এর মাধ্যমে দেখেন যে, ১৯৭৭ সালে আমাদের সৌরজগতের চারটি গ্যাসীয় গ্রহ সূর্যের একপাশে অবস্থান করবে। এই ঘটনা ঘটে প্রতি ১৭৬ বছর পর পর। আর তখন ই এক মহাজাগতিক গ্র্যান্ড ট্যুরের পরিকল্পনা করা হয়। প্রশ্ন হলো এই চারটি গ্যাসীয় গ্রহ সূর্যের একদিকে অবস্থান নিলে কি সুবিধা হবে এই গ্র্যান্ড ট্যুরের। আসলে স্পেসে যাত্রাকালে স্পেসক্রাফটের জন্য যা অতি জরুরি তাহলো ভেলোসিটি এবং ফুয়েল। স্পেসক্রাফটেকে যদি গ্রহের দিক বরাবর বেশ গতিতে এসে গ্রহটিকে ক্রস করে তবে স্পেসক্রাফটের গতি দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আর এই কারণেই গ্র্যান্ড ট্যুরের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কারণ স্পেসক্রাফটি চারটি গ্রহ থেকে গতি অর্জন করতে পারবে। আর একেই বলে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট।

১৯৭৭ সালের ২০ অগাস্ট লঞ্চ করা হয় ভয়েজার ২ এর ১৬দিন পর ৫ ই সেপ্টেম্বর লঞ্চ করা হয় ভয়েজার ১! ভয়েজার স্পেসক্রাফটে ১০ ধরণের সাইন্টিফিক ইন্সট্রুমেন্ট ছিল। যা দিয়ে ম্যাগনেটিক ফিল্ড, হাই এনার্জি পার্টিক্যাল, লো এনার্জি পার্টিক্যাল,কসমিক রে এসব নানা বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়। আর ছিল সাদাকালো ক্যামেরা। আর এই পুরো কাঠামো কে সক্রিয় রাখতে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের জন্য ছিল রেডিও এক্টিভ প্রোটোনিয়াম। যার তাপশক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে ভয়েজারকে সচল রাখে। ভয়েজার ১ কে লঞ্চ করার ১৮ মাস পরে সে পৌঁছয় বৃহস্পতির কক্ষপথে। তার চারমাস পর পৌঁছায় ভয়েজার ২।

ভয়েজার ১ গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের আগে বৃহস্পতির ১৯ হাজার ছবি পাঠায় পৃথিবীকে। যা ছিল মানব ইতিহাসে বৃহস্পতির সেই সময়ে সবচেয়ে পরিষ্কার ও কাছের ছবি। এরপর ভয়েজার ১, ১৯৮০ সালের নভেম্বরে শনিতে পৌঁছায় এবং সৌরজগতের সাথে ৩৫ ডিগ্রি কোণ করে ঘন্টায় ৩৯০০০ মাইল গতিতে মহাশূন্যের পথে যাত্রা শুরু করে। এরপর ২০১২ তে সৌরজগতের সীমা ছাড়িয়ে অন্য সৌরজগতে প্রবেশ করে। অন্যদিকে ভয়েজার ২ বৃহস্পতি থেকে শনি তারপর ইউরেনাস, তারপর নেপচুন হয়ে সৌরজগতের সাথে ৪৮ ডিগ্রি কোণে ঘন্টায় ৩৫০০০ মাইল গতিতে ভয়েজার ১ এর বিপরীতে মহাশূন্যের পথে যাত্রা শুরু করে। এর আগে ভয়েজার ২ এইসব গ্রহের এবং উপগ্রহের প্রচুর ছবি পৃথিবীতে পাঠায়। ২০১৮ তে ভয়েজার ২ সৌরজগতের সীমা পেরিয়ে অন্য সৌরজগতে প্রবেশ করে। আর এই সময় তার পাওয়ার কন্ট্রোল দীর্ঘস্থায়ী করতে ক্যামেরা ডিএক্টিভ করে দেয়া হয়। তবে ক্যামেরা অফ করার আগে সবচে দূর থেকে পৃথিবীর ছবি তোলে ভয়েজার, যা অতি অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দুর মত দেখতে, প্লে ব্লু ডট নামে খ্যাত আমাদের বাসস্থান।

ভয়েজার ১ হলো মানুষের তৈরি যান যা সবচে দূরে অবস্থান করছে, আর ভয়েজার ২ হলো সেই যান, যা সবচে বেশি গ্রহে যাত্রা করেছে। এখন আসি কীভাবে ভয়েজার দের জ্বালানীহীন গতি দেয়া সম্ভব হয়েছে। নিউটনের সূত্রানুযায়ী কোনো স্থির বস্তুকে বাহ্যিক বল প্রয়োগ না করলে তা চিরকাল স্থির থাকবে, আর কোনো গতিশীল বস্তু বাহ্যিক বল ব্যাতিত সমবেগে গতিশীল থাকবে। ভয়েজারকে রকেটে করে লঞ্চ করার সময় রকেটের গতিবেগ ছিল সেকেন্ডে ১০ কিলোমিটার। পৃথিবী সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার গতিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। আর তাই সেকেন্ডে ৪০ কিলোমিটার গতি ছিল বয়েজারের জন্য সূর্যের গ্র্যাভিটি এড়াতে সঠিক গতি। এরপর আসে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট। ভয়েজার যখন বৃহস্পতির কক্ষপথে পৌঁছুবে তখন যেন বৃহস্পতি ঠিক ওই জায়গাতেই থাকে, আর কত দূর থেকে ভয়েজার বৃহস্পতিকে ক্রস করবে যাতে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট ঠিকমতো সম্পন্ন হয়।

পড়ুন:  সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল নিয়ে কিছু কথা -অপর্ণা চক্রবর্তী

নইলে ভয়েজার বৃহস্পতি র উপরে পতিত হবে অথবা আর বৃহস্পতির কাছেই আসতে পারবে না। বুঝতে পারছো এখানে কত রকম জটিল ক্যালকুলেশান করতে হয়েছে? ভয়েজারের গতি ঠিক আছে কিনা, তা বোঝা যেত ভয়েজারের সিগন্যাল আদান প্রদানের মাধ্যমে। এই সিগ্ন্যাল আদান প্রদানের কাজ করে রেডিও ওয়েভ, আর এই রেডিও ওয়েভ ক্যাপচার করে বিশাল রেডিও এন্টেনা। এখন আসি ভয়েজারে আছে গোল্ডেন রেকর্ড, সেই গোল্ডেন রেকর্ডে কী কী রয়েছে? এবং কীভাবে তার নির্দেশনা দেয়া আছে। এখনো ভয়েজারের সাথে পৃথিবীর যোগাযোগ রয়েছে, কিন্তু তার পাওয়ার ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই ধারণা করা হয় যে ২০৩০ পর্যন্ত ভয়েজারের সাথে আমাদের যোগাযোগ থাকবে। এরপর ভয়েজার হারিয়ে যাবে অনন্ত নক্ষত্রবীথি র কোনো একখানে। যদি সেখানে কোনো মানব সভ্যতা থেকে থাকে তবে তারা যদি খুঁজে পায় ভয়েজারকে তাই অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে তৈরি হয়েছে এই গোল্ডেন রেকর্ড। গোল্ডের রেকর্ডের দুই পিঠ। প্রথমেই এখানে আছে কিছু চিহ্ন। যা দিয়ে হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেক্ট্রনের স্পিন দেখানো হয়েছে। এই স্পিনের পরিবর্তন কালের সময় কে বাইনারি সিস্টেমে বোঝানো হয়েছে, রেকর্ড টি কত সেকেন্ডে ঘুরবে, বা কীভাবে প্লে করলে শব্দগুলো শোনা যাবে। ৫৫ ভাষায় অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে, আছে বৃষ্টির শব্দ,বাজের শব্দ, হাঁটার শব্দ, পাখির ডাক,আরো নানা শব্দ আর সবশেষে সেতারের ঝংকার। অন্য পৃষ্ঠে রয়েছে শব্দ থেকে ইমেজ তৈরির খুঁটিনাটি। ইমেজে আছে শিশুর জন্মের ছবি, নর নারী, গাছপালা আরো নানারকম ইমেজ।

রেকর্ডের কভার করা হয়েছে অ্যালুমিনিয়ামের আস্তরণ আর তার উপর ইউরেনিয়াম ২৩৮ র প্রলেপ। আসলে এই পুরো রেকর্ড তৈরি হয়েছে বাইনারি সিস্টেমে। কারণ আমরা তো জানিনা অন্য কোনো সভ্যতা আছে কি নেই! যদি থেকে থাকে তবে তাদের কমিউনিকেশন আর আমাদের কমিউনিকেশন এক হবে না। আমরা যে সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করি তারা সেই পদ্ধতি ব্যবহার না করলেও যেহেতু ইউনিভার্সের ভাষা ই হলো গণিত তাই গাণিতিক ভাষায় তারা এই রেকর্ড প্লে করার উপায় পেতে পারবে। এতদূরে পাঠানোর জন্য যে দুর্দান্ত মেধা আর পরিশ্রম কাজ করেছে সেখানে আমরা আমাদের মেসেজ পাঠাবো ই না কেন? কভারের ইউরেণিয়াম ২৩৮ থেকে তারা জানতে পারবে রেকর্ড টির বয়স কত? কতদূর থেকে পাঠানো হয়েছে এই রেকর্ড। আসলে মানুষের অদম্য কৌতূহলের এক বিস্ময়কর ভাবনার নাম ভয়েজার। ভয়েজার ১, পৃথিবী থেকে ২৪ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে । আলোর গতিতে তার সিগ্ন্যাল আসতে সময় নেয় ২১ ঘন্টা। সেকেন্ডে ১৭ কিলোমিটার গতিতে সে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন অবস্থান করছে ইন্টারস্টলার স্পেসে। একটাই পরম আশা, অন্য কোনো সভ্যতা যেন খুঁজে পায় ভয়েজারকে। আমরা যেন জানতে পারি, আমরা একা নই, আছে আরো আরো সভ্যতা।

লেখক পরিচিতি  – অপর্ণা চক্রবর্তী ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কিশিনেভ স্টেট ইউনিভার্সিটি যান। পিওর কেমিস্ট্রিতে ১৯৯১ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন। পরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কেমিস্ট হিসেবে তিনবছর কাজ করেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত একটি বেসরকারি স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেঁচে থাকার জন্য বহু কিছু ভালবাসেন। তার মধ্যে বাগান করা, গান শোনা, বেড়ানো, ছবি তোলা, রান্না করা অপর্ণার বিশেষ শখ।