চলমান সংবাদ

বিপিসির বিশাল দেনা, সংকটের আশঙ্কায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ডলার সংকটের কারণে বিদেশের জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের পাওনা শোধ করতে পারছে না৷ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে৷

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল এই তথ্য দিয়ে জানিয়েছে যে, জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন বাংলাদেশের তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসির কাছে পাওনা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার৷ ডলার সংকটেরকারণে তারা এই পাওনা পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে৷ পাওনা না পেলে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান৷ বিপিসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) খালিদ আহম্মেদ জানিয়েছেন, ‘‘কিছু সরবরাহকারী তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে দ্রুত বকেয়া পরিশোধ না করলে তারা সরবরাহ বন্ধ করে দেবে৷’’ তবে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করেননি৷

তবে জানা গেছে, বিপিসিকে বর্তমানে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে ৬টি প্রতিষ্ঠান৷ বকেয়া পরিশোধ না করায় এর মধ্যে দুইটি প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে৷ ডলার সংকটের কারণে বিপিসি সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনিপেককে মোট প্রায় ২৮২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে পারেনি৷

১৬ মে পর্যন্ত জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপিসির কাছে বকেয়ার পরিমাণ ২৯৭.৪৯ মিলিয়ন ডলার৷ এর প্রায় পুরোটাই ওই দুইটি প্রতিষ্ঠানের পাওয়না বকেয়া৷

গত কয়েক মাস ধরে বিপিসি কিছু প্রতিষ্ঠানকে মোট বকেয়ার এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পরিশোধ করে আসছে৷ কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠানকে তারা কোনো বকেয়াই পরিশোধ করতে পারেনি৷ রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ডলার সংকটের কারণে বিপিসি এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে৷

খালিদ আহম্মেদ বলেন, ‘‘বিপিসি আগে কখনো এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি৷ আমরা আগে সব সময়ই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করতাম৷’’

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিপিসি জ্বালানি তেল জাহাজে লোড করার ৮-১০ দিনের মধ্যেই মূল্য পরিশোধ করতো৷ যদিও পরিশোধের সর্বোচ্চ সময় ৩০ দিন৷ কিন্তু মার্চ থেকে আর পুরো পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না৷ বিপিসি তার আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম ডলারে পরিশোধ করলেও স্থানীয় বাজারে বাংলাদেশি টাকায় বিক্রি করে৷ ব্যাংক থেকে ডলার না পেলে তাই আমদানির মূল্য পরিশোধের ডলার তাদের হাতে থাকে না৷

এ নিয়ে বিপিসি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কথা বলেছে৷ কিন্তু তাতেও ডলার সংকটের কোনো সমাধান হয়নি বলে জানিয়েছে৷ তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক মেসবাউল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত নই৷ আজ (শুক্রবার) ছুটির দিন৷ অফিস খোলার দিন হয়তো কাগজপত্র দেখে বলতে পারবো৷ তবে সার্বিকভাবে ডলার সংকট তো আছেই৷ রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে৷’’

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে বা দরপত্রের মাধ্যমে বিপিসি বছরে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি আমদানি করে৷

জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসিকে বছরে দুইবার দরপত্র আহ্বান করতে হয়৷ জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বরে৷ নির্ধারিত সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাম ঠিক করা হয়৷ বিপিসি আশঙ্কা করছে যদি দ্রুত বকেয়া শোধ করা না হয় তাহলে সরবরাহকারীরা দাম বাড়িয়ে দিতে পারে৷ পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করার জন্য বিপিসিকে প্রতি মাসে প্রায় ৫৬০-৬৯৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১৬ থেকে ১৭টি এলসি খুলতে হয়৷

এদিকে বেরসকাারি পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিকরাও জ্বালানি তেল আমদানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফয়সাল খান৷ বাংলাদেশের ক্রুড অয়েল আমদানি মার্চের তুলনায় এপ্রিলে ১২.৫ ভাগ কমে গেছে৷

পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘আমরা জানি, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তেল সরবরাহ করবে না বলে জানিয়েছে৷ আবার নতুন করে তেল আনার জন্য বিপিসি এলসিও খুলতে পারছে না৷ এটা একটা সংকট৷ ডলার সংকট তো অনেক দিন ধরেই চলছে ফলে আমাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল৷ আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে না৷ তবে এর বাইরেও সংকট মোকাবেলায় আরো অনেক পদক্ষেপ নেয়া যেতো৷ হয়তো জ্বালানি তেলের এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে৷ সৌদি আরব ও কাতারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে৷ কিন্তু ডলার সংকটে কয়লাও তো আমদানি করা যাচ্ছে না৷ তেল-চালিত পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো বন্ধ আছে৷ কয়লারগুলোও বন্ধ হচ্ছে৷ তাহলে বিদ্যুতের অবস্থা কী হবে?’’

এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানিয়েছেন এখন থেকে এক মাস পর পর আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে মিল রেখে দেশের বাজারে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে৷ আর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নয়, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার এ মূল্য নির্ধারণ করবে৷ তিনি শুক্রবার তার বাসভনে সাংবাদিকদের জানান, ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷

বাংলাদেশে এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৩০.৩৬ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেসবাউল হক৷ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৫০৭ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার পর পরিস্থিতির এই সামান্য উন্নতি৷ এর আগে রিজার্ভ ছিল ২৯.৭৮ বিলিয়ন ডলার৷ অন্যদিকে ডলারের সঙ্গে টাকার অরো অবমূল্যায়ন হয়েছে৷ আমাদানি ও আন্তঃব্যাংক ডলারের দাম বেড়েছে৷ আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে ডলারের দাম গড়ে প্রায় এক টাকা বেড়েছে৷ এ খাতে ডলার ১০৮ থেকে ১০৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে৷ বৃদ্ধির হার প্রায় এক শতাংশ৷ একই সঙ্গে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দামও বেড়েছে গড়ে এক টাকা৷ প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা৷ আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে ডলারের দাম বাড়ায় পণ্য আমদানির খরচ বাড়বে৷

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘সরকার এখন নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করছে৷ তারা নির্বাচন নিয়েই ভাবছে৷ কিন্তু এই সংকটগুলো মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দরকার৷ সারা বিশ্বই এটা মোকাবেলা করছে৷ আমাদেরও এটা মোকাবেলা করেই এগোতে হবে৷ আমরা যা দেখছি তা ফ্লোটিং৷ কোনো অ্যাংকরিং দেখছি না৷’’

#হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে, ঢাকা