মতামত

ধার্মিক কারা ?

-ডা. গৌতম দত্ত

ডা. গৌতম দত্ত (ফাইল ছবি)

[আইনস্টাইন যেভাবে দেখেছেন … এবং কিছু প্রসঙ্গ কথা]
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আলোচিত হবার মতো কোন বিজ্ঞানী আমাদের দেশে নেই। বোধগম্য কারণেই নেই। কাজেই বিজ্ঞান, দর্শনের মিথোজীবিতায় পুষ্ট জ্ঞানালোকের আশা এখানে দুরাশায় পর্যবসিত। যুক্তি—বুদ্ধি—নৈতিকতা এই কেন্দ্রিক সমস্যা মূলের সন্ধান দেবার মতো কিংবা দিয়ে বিশ্বাস করানোর মতো ব্যক্তিত্ব এখানে অনুপস্থিত । তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে যুক্তি—বুদ্ধি—বোধের ম্যাজিক লড়াই এখানে প্রতিস্থাপিত হয় বিদ্বেষ—সহিংসতার শারীরিক লড়াই দিয়ে। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় অনুভূতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তি কুযুক্তি, বিশ্বাস—অবিশ্বাস এসবকে একাকার করে এক ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্ভবতঃ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারই বিভিন্ন পক্ষের মূল উদ্দেশ্য। এ অবস্থায় বিজ্ঞান, ধর্ম, ধার্মিকতা, ঈশ্বরবিশ্বাস এসব বিষয়কে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যেভাবে দেখেছেন তার পুনর্বিবেচনা কিছুটা হলেও আমাদের দৃষ্টিকে স্বচ্ছ করবে এ বিশ্বাস থেকেই এই লেখা। একটি সামাজিক সমস্যার প্রশ্ন, কেন বিজ্ঞানপক্ষ থেকে এই নির্বাচন—অনেকেই জিজ্ঞাসা করবেন হয়তো। এক্ষেত্রে এটুকুই বলা যায় যে, সমসাময়িক বিজ্ঞান এমন এক স্তরে উন্নীত হয়েছে যেখানে জনবোধ্য ভাষায় তাকে আর প্রকাশ করা যাচ্ছে না। গণিতই এখন তার একমাত্র ভাষা; এই ভাষাজনিত অপ্রবেশ্যতার কারণে একজন বিজ্ঞানীর পক্ষে যতটা সহজে দর্শন কিংবা সমাজচিন্তার বলয়ে প্রবেশ করা সম্ভব ততটা সহজ নয় একজন দার্শনিক কিংবা সমাজচিন্তকের বিজ্ঞানের বলয়ে প্রবেশ করা। চিন্তার মিথোজীবিতা তাত্ত্বিক নয় বরং বোধের মিথোজীবিতা এবং তত্ত্বজ্ঞানের বিমূর্তায়ন ঘটে বোধে (সমক্ষেত্রে নয়)—এই নিরিখেই বোনা হয়েছে এই নির্বাচিত—প্রস্তাবনার আন্তঃশায়ী যুক্তি(Inherent : Logic) !

বোধের আওতায় চলে আসা প্রক্রিয়াগুলোকে সুসংবদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত করবার যে প্রয়াস মানুষ শত বছর ধরে চালিয়ে আসছে, আইনস্টাইন বিজ্ঞান বলতে তাকেই বোঝেন; তিনি মনে করেন বস্তু ও ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারক কিছু সাধারণ নিয়মের প্রতিষ্ঠাই বিজ্ঞানের লক্ষ্য। এই নিয়মগুলোর ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই ঘটনার গতি—প্রকৃতির পুর্বনির্ধারণ সম্ভব হয়। এই সাফল্য আধুনিক মানবমনে গভীর আস্থাবোধ জাগায়, যদিও ঐ নিয়মগুলো সম্ভন্ধে তার ধারণা থাকে সামান্যই, সে শুধু এটুকুই মনে রাখে গ্রহ—নক্ষত্রগুলোর গতি, অবস্থান কিছু নিয়মের সাহায্যে নির্ভুল ভাবে হিসেব করা যায়, তার চারপাশেরও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আর হিসেব মেনেই কাজ করে যাচ্ছে… ইত্যাদি। কিন্তু একটি ঘটনার অংশগ্রহণকারী উপাদানের সংখ্যা যতো বেশি হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করাও হবে ততো কঠিন। আবহাওয়ার কথাই ধরা যাক, মাত্র কিছুদিনের জন্যও এ সম্পর্কে নিশ্চিত নির্ভুল পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। প্রভাবকারী উপাদানের সংখ্যা বেশি বলেই এক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই, কার্যকারণ সম্পর্ক অস্বীকার করে আবহাওয়ার পরিবর্তনকে নিয়ম—না—মানা ঘটনা বলা চলে না।

মানুষ প্রকৃতির ঘটনাবলীর নিয়মবদ্ধতা সম্বন্ধে যতো বেশি জানে ততোই তার এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে এইসব ঘটনাবলীর ভিন্নচরিত্রের কোন নিয়ন্ত্রকের প্রয়োজন নেই। সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে স্বাধীন কোন মানবিক বা ঐশ্বরি নীতির অস্তিত্ব সে অস্বীকার করতে চায়। কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার আলো যেখানে অপর্যাপ্ত বা অনুপস্থিত সেখানকার অন্ধকার থেকে পুষ্টি নিয়েই বেঁচে থাকে প্রকৃতির ঘটনাবলীতে হস্তক্ষেপকারী ব্যক্তিঈশ্বরের ধারণা। আইনস্টাইন ব্যক্তি—ঈশ্বর—এর ধারণার বিরোধী। ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিরোধের মূল কারণ হিসেবে তিনি ব্যক্তি—ঈশ্বরের ধারণাকে দায়ী করেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ তার ক্রিয়াকলাপের নির্ধারক (বা নিয়ন্ত্রক) দেবতাদের কল্পনা করেছে নিজেদের প্রতিরূপে এবং কল্পিত দেবতাদের মেজাজ— মর্জিকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে যাদুচর্চা, প্রার্থনা এসবের মধ্য দিয়ে। [এলিয়াটিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা দার্শনিক জেনোফিনিস (খ্রীঃ পুঃ ৫৭০—৪০৯) বলতেন, প্রকৃতপক্ষে গরু কিংবা ঘোড়ার যদি মানুষের মতো হাত থাকতো এবং তারাও যদি মানুষের মতো চিত্র আঁকতে পারতো, তাহলে ঘোড়া তাদের ঈশ্বরকে ঘোড়ার মতো এবং গরুরা তাদের ঈশ্বরকে গরুর মতো করে আঁকতো।] বর্তমান ধর্মগ্রন্থগুলোতে ঈশ্বরকে যেভাবে বর্ণনা করা হয় তা মূলতঃ উল্লেখিত প্রাথমিক চিন্তারই বিবর্তিত রূপ। দেবতাদেরকে নরগুণসম্পন্ন মনে করার ধারণা (Anthropomorphism) ঈশ্বরে এসেও বলবৎ থেকেছে। এই নরত্বারোপমূলক চরিত্রের প্রমাণ মেলে ঈচ্ছাপূরণের জন্য ঈশ্বরের কাছে দোয়া প্রার্থনা, ঈশ্বরকে তুষ্ট করবার জন্য পূজা নামাজ এসবের মধ্যে এটা সবাই স্বীকার করবে যে, সর্বশক্তিমান, সর্বমঙ্গলময়, ঈশ্বরের ধারণা মানুষকে সান্ত্বনা, পথনির্দেশনা দিতে পারে, তাছাড়া অনুন্নত অবিকশিত মনে সহজেই ধারণাটা স্থান করে নিতে পারে। কিন্তু একটা ঈশ্বর কল্পনা করে নেবার কেজো এই দিকগুলো সত্ত্বেও কিছু দুর্বলতা থেকে যায়, ইতিহাসের গোড়া থেকেই এটি অনুভব করা গেছে। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন তাহলে মানুষের ক্রিয়াকলাপ চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি আকাঙ্খা থেকে শুরু করে জগতের তাবৎ ঘটনা মূলত ঈশ্বরেরই কাজ । এরকম একজন শক্তিমানের অস্তিত্ব থাকলেও মানুষকে কি করে তার চিন্তা বা কর্মের জন্য দায়ী করা যায় ? মানুষকে শাস্তি দেয়া বা পুরষ্কৃত করার মধ্য দিয়েতো ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধান্তকেই শাস্তি দেবে বা পুরষ্কৃত করবে। ঈশ্বরের সদাশয়তা, ন্যায়পরায়ণতা এসব নিজের কি সেক্ষেত্রে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না ? তাই কারণিকতা (Causuality)—র সূত্রের জাগতিক দিক্টা যার উপলব্ধিতে রয়েছে সে কোনভাবেই ঘটনা—ঘটনের ক্ষেত্রে কারো হস্তক্ষেপের কথা মেনে নিতে পারে না—অবশ্য কারণিকতার প্রকল্পটাকে সে যদি প্রকৃত অর্থেই গভীরভাবে উপলব্ধি করে থাকে তাহলেই। মানুষকে পুরষ্কৃত করে, শাস্তি দেয় এরকম ঈশ্বরের ধারণা সে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারে না, কেননা অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক প্রয়োজনই মানুষের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই, ঈশ্বর একটা প্রাণীহীন বস্তুকে যেমন তার গতিপ্রকৃতির জন্য দায়ী করতে পারে না, একজন মানুষকেও তেমনি তার কাজের জন্য দায়ী করতে পারে না। কার্যকারণসূত্রের চর্চার মধ্য দিয়ে এসব জিজ্ঞাসা অবিশ্বাসের জন্ম। তাই কার্যকারণ চর্চা অর্থাৎ বিজ্ঞানকে দায়ী করা হয় নীতিবোধের ধ্বংসকারী হিসেবে, যদিও এটা করার বাস্তবানুগ, কল্যাণমুখী যুক্তি নেই। একজন মানুষের নৈতিক আচার আচরণের ভিত্তিতে হওয়া উচিত শিক্ষা সহমর্মিতা ও সামাজিক প্রয়োজন। ধর্মীয় কোন ভিত্তি (প্রচলিত অর্থে) এখানে অপ্রয়োজনীয়। আসলে মৃত্যু—পরবর্তী শাস্তির ভয় আর পুরস্কারের আশাই যদি মানুষের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে তা কখনো তার জন্য ভালো হবে না। বিজ্ঞান আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে এবং এদের আন্তঃসম্পর্কের সাথে। বিজ্ঞান আমাদের বলে দিচ্ছে অনেকগুলো কী এর সমাধান, কিন্তু এর দ্বারা কী হওয়া উচিত তার সমাধান সরাসরি হয় না, বিজ্ঞানের অবদানকে কিছুমাত্র খাটো না করেও একথা বলা যায়। কোন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছুতে হলে বস্তুগত জ্ঞান—নির্ভর হয়েই তা করতে হয়। এতদসত্ত্বেও ঐ নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণের এবং তা অর্জনের প্রেরণার উৎস কিন্তু অন্যত্র এটা সকলেই স্বীকার করবেন যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং সেইজনিত মূল্য বোধ ছাড়া আমাদের ক্রিয়াকলাপ নিতান্তই অর্থহীন। সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান সুন্দর সন্দেহ নেই, তবে সুন্দরের পেছনে ছোটার যুক্তি বা মূল্য যে কী সেটার ধারণা ঐ সত্যজ্ঞান স্বয়ং দিতে পারে সামান্যই। বিশুদ্ধ যৌক্তিক চিন্তার সীমাবদ্ধতা এখানেই। কিন্তু এ থেকে এরকম ধারণা মোটেও করা চলে না যে, লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যৌক্তিক চিন্তার কোন ভূমিকা নেই ।

যৌক্তিক চিন্তা লক্ষ্য এবং লক্ষ্যার্জনের উপায়ের আন্তঃসম্পর্ককে স্পষ্ট করে। তবে, মৌল লক্ষ্যগুলোর নির্ধারণ, মূল্যায়ণ এবং মানুষের সামাজিক জীবনে এসবের প্রতিষ্ঠার অন্য একটি স্বতন্ত্র প্রয়াস প্রয়োজন । এই প্রয়োজন মেটানোর কাজটা করতে পারে ধর্ম ধর্ম এবং বিজ্ঞানের আন্তঃনির্ভরতাকে আইনস্টাইন প্রকাশ করেছেন এভাবে; ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। কিন্তু ধর্ম বলতে আইনস্টাইন গ্রন্থনির্ভর প্রচলিত ধর্মকে বোঝেন না। তিনি ধর্মবোধ প্রাপ্ত বলছেন তাদেরকেই যারা সংকীর্ণ স্বার্থবোধের উর্দ্ধে উঠতে পেরেছে, যাদের চিন্তা, অনুভূতি, উদ্যোগের মূলে রয়েছে কোন অতিব্যক্তিত্ব বোধ (ঝঁঢ়বৎ ঢ়বৎংড়হধষ াধষঁব)। এই বোধের প্রাবল্যটাই বড় কথা, কোন স্বৰ্গীয় বা অতিপ্রাকৃতিক অস্তিত্ব (যেমন : ঈশ্বর) এর সাথে এই বোধকে জড়িত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। কেননা, সেক্ষেত্রে বুদ্ধ, স্পিনোজা এদেরকে ধর্মবোধহীন বলতে হবে। সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও কিছু লক্ষ্য ও অভিমুখের প্রতি অবিচল আস্থা রাখাই ধার্মিকতা। ধর্মকে এভাবে দেখলে বিজ্ঞানের সাথে এর বিরোধটাও আর থাকে না। কোন ধর্মপক্ষ যখন নির্দিষ্ট কোন গ্রন্থের সব কথাই পরম সত্য বলে দাবি করে, তখনই সংঘাত আসে, কেননা এতে করে ধর্ম বিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে প্রতিস্থাপকের ভূমিকায় চলে আসে। গ্যালিলিও, ডারউইন, এদের মতবাদের বিরুদ্ধে গীর্জায় যে সংগ্রাম তার কারণটা এখানেই। ধর্মের প্রবক্তাদের পক্ষ থেকে এধরনের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে আইনস্টাইন বলেছেন, যে মতবাদ কেবল অন্ধকারে ঠাঁই খুজতে চায়, আলোয় আসতে পারেনা, মানুষের ওপর তার প্রভাব ক্রমশঃ কমে আসতে বাধ্য এবং এর ফলাফল হবে মানবপ্রগতির অন্তরায়। নব মানুষের আত্মিক চিন্তার বিকাশ বা (ঝঢ়রৎরঃঁধষ বাড়ষঁঃরড়হ) যত এগুচ্ছে ততই এই সত্যটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, জীবন মৃত্যু নিয়ে ভয়ভীতি, অন্ধবিশ্বাস এসবে প্রকৃত ধার্মিক নেই। যৌক্তিক জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টাই প্রকৃত ধার্মিকতা। এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলা যায়, বস্তুতান্ত্রিক এই যুগে আন্তরিক বিজ্ঞান কর্মীরাই সবচাইতে বেশী ধার্মিক।
এই কথাগুলো থেকে এই সত্যটা স্পষ্ট হয় যে আইনস্টাইন যেরকম ধার্মিকতার প্রয়োজনের কথা বলেছেন তা মোটেও প্রচলিত অর্থে ধার্মিকতা নয়। কাজেই ঐশ্বরিক গ্রন্থ, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বেহেশত দোজখ জাতীয় বিষয়বস্তুনির্ভর ধর্মের প্রবক্তাদের আইনস্টাইনকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করবার কোন যুক্তি নেই। আইনস্টাইনের দৃষ্টিতে দেখলে নাস্তিক অধার্মিক বলে চিহ্নিত ইতিহাস চরিত্রগুলোর অনেকেই প্রকৃত ধার্মিক এবং অনেক মহাধার্মিক মূলত ঃ অধার্মিক বা বকধার্মিক এই বাস্তবতাই প্রতিভাত হবে। ঈশ্বরবিশ্বাস এবং ধর্মবিশ্বাস শব্দদুটোকে প্রায় সমার্থক মনে হলেও এদুটোকে স্পষ্ট পৃথক করে দার্শনিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছে অনেক আগেই। এরকম একটা দার্শনিক ধারা অনেক আগে থেকেই প্রবলভাবে বিদ্যমান, যাতে ঈশ্বরকে কল্পনা করা হয় বিশ্বসৃষ্টির একটি নৈর্ব্যক্তিক পরম কারণ হিসেবে, সৃষ্টি পর থেকে যার আর কোন ভূমিকা নেই, অর্থাৎ সৃষ্টির পর থেকে বিশ্ব চলছে আপন নিয়মে সৃষ্টিকর্তার কোন প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই। এই দার্শনিক ধারার সুসংহত রূপ হল ঊরংস। অন্যদিকে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি হল ঞযবরংস এতে মানুষ তথা বিশ্বের প্রতিটি ঘটনার ওপর ঈশ্বরের সক্রিয় প্রভাবের কথা বলা হয়। এর প্রাবল্যের বিপরীতে দেইজম ছিলো মূলতঃ নাস্তিকতা বা অ্যাথেইজমের বহিঃপ্রকাশ—সামন্ত ধর্মীয় অনুশাসনের যুগে যা হয়ে দাঁড়ায় বস্তুবাদীদের চিত্তাপ্রকাশের একটি কৌশলী মাধ্যম। ফ্রান্সের রুশো ভলতেয়ার থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের লক্, নিউটন, টল্যান্ড, রাশিয়ার রাদিচেভ—এরা সবাই দেইজমের প্রবক্তা। বর্তমান সময়ে অবশ্য ধর্মকে যুক্তিসম্মত প্রমাণ করার জন্য দেইজমের সাহায্য নেয়া নয়, ধর্মবিশ্বাসকে সমর্থন করতে গিয়ে বলা হয় দেইষ্টদের ঈশ্বরবিশ্বাসের কথা। এক্ষেত্রে সচেতনভাবেই ভুলে যাওয়া হয় অথবা ভোলানোর চেষ্টা করা হয় ঈশ্বরবিশ্বাস আর ধর্মবিশ্বাসের গুণগত পার্থেক্যের কথা। আধুনিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান ওয়াভিকল (ডধারপষব) থিওরী থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম রিলেটিভিটি তত্ত্ব এরকম কিছু প্যারাডক্স নির্ভর হয়ে পড়েছে যা হয়তো দেইষ্টিক ভাবনাকে উৎসাহিত করবে, কিন্তু দেইষ্টদের সমর্থন খুজবার কোন যৌক্তিকতা নেই। ঈশ্বরবিশ্বাসের রকমফেরের মতো ধর্মবোধেরও রকমফেরের রয়েছে। নির্দিষ্ট কোন ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য না থাকলেই যে একজন মানুষ অধার্মিক বা ধর্মবোধহীন হবেন এমন ভাবা আজ অন্ধভাবনারই সামিল। নিঃসীম সমুদ্রের কিংবা উঁচু পাহাড়ের মুখোমুখি হলে প্রকৃতির ঘটনাবলীর আশ্চর্য শৃঙ্খলা দেখে আমরা একরকম বিশেষ বোধে আচ্ছন্ন হই; এই বোধই প্রকৃত ধর্মবোধ, আর সত্যসুন্দরের সন্ধানে মানুষের যে সংগ্রাম সেটাই প্রকৃত ধর্মপালন। পাঠক স্মরণ করুন জন লেননের ইম্যাজিন গানটির কথা ……..

Imagine ! there’s no heaven

It’s easy if you try

No hell below us

Above us only sky

Imagine ! all the people

Living today.

Imagine ! there’s no country

It isn’t hard to do.

Nothing to kill and die for

And no religion too

Imagine! all the people

Linking life is peace ……. …..  বেহেশত দোজখ আর প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে এড়িয়ে গিয়েও এই গানটির কথা একরকম ধর্মবোধকেই কি প্রকাশ করে না!

# ডা. গৌতম দত্ত, চিকিৎসক