বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৯৬): নস্টালজিয়া

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর একটা প্রদর্শনী হল রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় লাইব্রেরির (লেনিন লাইব্রেরি) ওরিয়েন্টাল স্টাডি সেন্টারে। সেখানে আমার ছবির প্রদর্শনী হল এই উপলক্ষ্যে। বাংলাদেশে তোলা ছবি – “বাংলাদেশঃ নস্টালজিয়া” তার নাম। আমার ইচ্ছে ছিল নামটা হোক – “হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ” কারণ সে অর্থে আমার বাংলাদেশ আমি হারিয়ে ফেলেছি। তবে এটা আমি একা নই, যেভাবে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে তাতে কিছুদিন পরে সবার জন্যই অতীতের স্মৃতি মেশানো জায়গা খুঁজে পাওয়া কষ্ট হবে। সেখানে আমাকে কথা বলতে বলা হল। মনে পড়ল দীর্ঘ ১৪ বছর পরে ২০১১ সালে দেশে ফেরার কথা। আমি প্রায় পুরো সময় কাটালাম নিজ গ্রাম তরায় আর খুঁজে বেড়ালাম নিজের ছোটবেলা। বললাম সে কথা। বললাম সেই সময়কে না পেয়ে নিজের হতাশার কথা। মনে পড়ে গেল দুই বছর আগের এক লেখার কথা। পুরানো হলেও এখনও প্রাসঙ্গিক। আশা করি প্রগতির যাত্রীর পাঠকদের হতাশ করবে না।

কয়েক বছর আগে এক ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ হল। আমাদের পরিচয় স্মিতার মাধ্যমে। স্মিতা পশ্চিম বঙ্গ থেকে। সে কারণেই না কি আমার নামের কারণে, উনি জিজ্ঞেস করলেন আমি ইন্ডিয়া থেকে কিনা।

– না, আমি বাংলাদেশ থেকে।

– বাংলাদেশের কোন জেলায়?

– মানিকগঞ্জ।

– আমার জন্ম ঢাকায়। তবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বশিরহাট আর বারাসাত থেকে। যদিও জন্ম বাংলাদেশে, আমি নিজেকে ভারতীয় বলেই মনে করি।

দুটো জায়গাই আমার চেনা। বশিরহাট থেকে এসেছিল আমার ভার্সিটির ক্লাসমেট পার্থ ভাদুরী। সে কারণেই ওদিকটায় গেছিলাম। আর বারাসাত তো মাসি বা দিদিদের ওখানে যেতে হলে রাস্তায় পড়ত।

পশ্চিম বঙ্গে বেড়াতে গেলে কেউ যখন শোনে আমি বাংলাদেশ থেকে, অনেক অপরিচিত মানুষও চলে আসে দেশের কথা জানতে। ওদের পূর্বপুরুষেরা বাড়িঘর ছেড়ে ওদিকটায় চলে গেছে। আমার বন্ধুদের অনেকের বাবা মা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা পূর্ব বঙ্গের মানুষ। ওরাও বড় হয়েছে তাঁদের মুখে বাংলার মাঠ ঘাট নদী নালার গল্প শুনে। এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানা। তাছাড়া অনেক বইপত্রেও পূর্ব বাংলা থেকে চলে যাওয়া মানুষের কান্নার শব্দ আমরা পাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “অর্ধেক জীবন”এ পড়লাম তাঁর বাবার গ্রামে ফেরার জন্য সে কী আকুতি! শুধু কী তাই? বেলাল চৌধুরীর সাথে এক সাক্ষাতকারে সুনীল বললেন বাংলাদেশে এলে তার অন্য রকম এক অনুভূতি হয়, এখানকার সব কিছু তাঁর খুব চেনা লাগে। সে তুলনায় ওদিক থেকে বাংলাদেশ চলে আসা মানুষের সুখ দুঃখের কাহিনী নেই বললেই চলে। যদিও ছাত্র জীবনে অপু, ইভানসহ বেশ কিছু বন্ধু ছিল যাদের আদি বাড়ি পশ্চিম বঙ্গে, তবুও খুব একটা আগ্রহ জাগেনি ওদের সব বাড়িতে এ নিয়ে কেউ নস্টালজিয়ায় ভোগে কিনা সেটা জানতে। হয়তো বয়সের দোষ। তবে সেদিন হাতের কাছে এমন একজন মানুষ পেয়ে খুব জানতে ইচ্ছে করল।

– যদি কিছু মনে না করেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে পূর্ব বাংলা থেকে দেশত্যাগী মানুষ যেভাবে এ দেশের জন্য নস্টালজিক হয়, ওখান থেকে আসা মানুষও কি সেরকম অনুভব করে? করা তো স্বাভাবিক, কিন্তু শুনি না।

– আমাদের পূর্বপুরুষেরা হতেন। এমনকি নানী পোটলা বেঁধে বসে থাকতেন বশিরহাট ফিরে যাবেন বলে। আসলে হিন্দুদের নিয়ে যেমন লেখা হয়, আমাদের নিয়ে তেমন লেখা হয় না।

– আমার মনে হয় হিন্দুরা দেশ ভাগ চায়নি (আমি বলছিলাম পূর্ব বাংলার হিন্দুদের কথা), তারা দেশ ছেড়েছে বাধ্য হয়ে। মুসলমানদের অনেকেই পাকিস্তান চেয়েছে। পাকিস্তানে তারা এসেছে নতুন দেশ গড়ার, নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে। হিন্দুরা ভগ্ন হৃদয়ে চলে গেছে বলেই এত দীর্ঘ শ্বাস, এত লেখালেখি।

– কিন্তু দেশভাগে হিন্দুরাও কম দায়ী ছিল না। জিন্নাহর পাশাপাশি নেহেরু, গান্ধীও দায় এড়াতে পারবেন না।

– সেটা ঠিক, তবে ভাগ হয়েছে পাঞ্জাব আর বাংলা। পাঞ্জাবের লোকেরা যেভাবে পুনর্বাসিত হয়েছে, বাংলার মানুষ তেমন হয়নি। তারা পশ্চিম বঙ্গেও তেমন ভাবে সুযোগ সুবিধা পায়নি, অনেকেই দণ্ডকারণ্য, আন্দামান এসব জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। দেশভাগের ৭০ বছর পরে, এখনও অনেকেই ঠিক শেকড় গাঁড়তে পারেনি।

– তাছাড়া পাকিস্তান সরকার পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসা লোকজনদের তিন কাঠা করে প্লট দিয়েছে। আমার নানা পেয়েছেন তিনটে প্লট যদিও নেননি।

– তথ্যটা জানা ছিল না। হয়তো এ কারণেই পূর্ব বাংলা থেকে চলে যাওয়া হিন্দুরা তাদের অতীতের জন্য নস্টালজিক হয়। মানুষ তো দুঃখের কথা বেশি বলে। সুখের কথা কে শোনে।

– তারপরেও পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসা মুসলমানদের কষ্টের কাহিনী নিয়ে সাহিত্য রচনা হওয়া দরকার।

– কিন্তু সেটা তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তপন রায়চৌধুরী এরা করতে পারবেন না, করবেন না। এটা করতে হবে সেই সব মুসলমানদের যারা নিজেরা বা যাদের পূর্বসূরিরা দেশত্যাগ করে এদেশে এসেছে। তবে এটাও ঠিক, পাকিস্তানের স্লোগানই ছিল নতুন দেশ ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে। তাই তাদের যেকোনো নস্টালজিক লেখা সেই স্বপ্ন বিরোধী। হয়তো এ কারণেই কেউ লেখেনি। মীজানুর রহমানের কোলকাতার উপর লেখা আছে, তবে সেটা ভিন্ন ধরণের। কেউ যদি লিখত আমি সাগ্রহে পড়তাম। দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছায় ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়েও যদি মানুষ দেশের জন্য নস্টালজিক হয়, কেন পশ্চিম বঙ্গ থেকে সব ছেড়ে চলে আসা মানুষ তার জন্মভুমির কথা ভাববে না।

– জানেন বশিরহাটে আমাদের অনেক জমিজমা ছিল। সেগুলো অবশ্য বেদখল হয়ে গেছে। না না, অন্যেরা নেয়নি, আমাদের আত্মীয়স্বজনেরাই দখল করেছে। তারপরেও নানা অনেকদিন পর্যন্ত ওখানে যেতেন, কিছু কিছু জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসতেন।

– আমাদের এখানে তেমনটি ঘটেনি। ৬৫ র যুদ্ধের পর সব শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এমনকি এখনও সেই অভিশাপ থেকে আমরা পুরোপুরি মুক্তি পাইনি। যদি খেয়াল করেন, সে সময় কী হিন্দু, কী মুসলমান – যাদের অবস্থাই একটু ভালো ছিল, তারাই কোলকাতায় কিছু একটা করার চেষ্টা করত, ছেলেদের লেখাপড়া করতে কোলকাতায় পাঠাত ঠিক যেমনটি এখন আমরা ছেলেমেয়েদের ঢাকা পাঠাই। পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সে আমলের নেতাদের অধিকাংশই তো কোলকাতায় থাকতেন। তাছাড়া অবস্থাপন্ন মানুষ তখন জমিদারি বাদ দিয়ে শহুরে হয়েছে। শহরের বড়লোকদের বাড়িঘর বদল করা যত সহজ হয়েছিল, গ্রাম এলাকায় সেটা ঘটেনি। তাই গ্রামের জমিদার বা অবস্থাপন্ন মানুষ বলতে গেলে সব ফেলেই দেশত্যাগ করেছে। তা সে পূর্ব বাংলার হিন্দুই হোক আর পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানই হোক। আমার অনেক আত্মীয়স্বজন এভাবে সব ফেলে চলে গেছে, যেমনটা এসছে আপনার নানা। আমি জানি না পশ্চিম বঙ্গ থেকে গরীব মানুষ কতটা এখানে এসেছে, তবে পূর্ব বাংলা থেকে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষও প্রচুর পরিমাণে ওদেশে গেছে আর ওরাই সব চেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। ওই সময়ে কোলকাতার শিক্ষিত মুসলমানদের অধিকাংশই ছিলেন উর্দু ভাষাভাষী। এমনকি শহীদ সোহরাওয়ার্দি নিজে বাংলার চেয়ে উর্দু বা ইংরেজি অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে বলতেন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের নামকরা কবি সাহিত্যিকের অধিকাংশই জন্ম সূত্রে পূর্ব বাংলার। হয়তো এ কারণেও আমাদের সাহিত্যে পশ্চিম বাংলা ত্যাগের সুখ বা দুঃখের কাহিনী প্রকাশ পায়নি। ইদানীং তানভীর মোকাম্মেল সীমান্ত রেখা নামে এক ডকুমেন্টারি করেছেন, সেখানেও কিন্তু শুধু ওপারে চলে যাওয়া মানুষের কথা। হতে পারে ১৯৪৭ এর পর সবাই ব্যস্ত ছিল পাকিস্তানের নাগ পাশ থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনে। হতে পারে সে সময় পশ্চিম বাংলা নিয়ে নস্টালজিক কিছু লিখলে তাকে ভারতের দালাল বলে সনাক্ত করা হবে বিধায় কেউ সাহস করে লেখেনি। আর দেশ স্বাধীন হবার পর সেটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরে অনেকেই ভেবেছিল শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল হবে, দুই দেশের মানুষের মধ্যে যাতায়াত সহজ হবে। অনেকেই আশায় বুক বেঁধেছিল পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে পাবে বলে। তবে সেটা হয়নি। একবার সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেলে ফেরত আসে না, এমনকি ফেরত না চেয়ে শুধু দেখতে চাইলেও নতুন মালিকেরা এ ধরণের আগ্রহকে সন্দেহের চোখে দেখে। যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, অমর্ত্য সেনের মত কিছু কিছু স্বানামধন্য মানুষ তাঁদের বাড়ি ফেরার, বাড়ি দেখার সুযোগ পান, এদের অনেকের বাড়িঘরই আজ বেহাত, এমনকি সেটা সংরক্ষণের কোন চেষ্টা পর্যন্ত নেই। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কথা কেই বা ভাববে! তবে যে কারণেই হোক না কেন এটা ঠিক যে ১৯৪৭ সালে পশ্চিম বঙ্গে বাড়িঘর ফেলে আসা মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যেই তাদের জন্মভূমির নস্টালজিয়া আছে। সেটা আছে প্রথম প্রজন্মের অনেক উত্তরসূরির মাঝে যারা পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির গল্প শুনে বড় হয়েছে। এখনও তাদের অনেকেই জীবিত। কেউ যদি দেশে এ বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে গল্প, উপন্যাস বা গবেষণামূলক কিছু লেখে সেটা ভারত বিভাগের ইতিহাসের গ্যাপ কিছুটা হলেও পূরণ করবে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (৯৭): নস্টালজিয়া -বিজন সাহা

– কিন্তু লিখবে কে? কে জানতে চায় সাধারণ মানুষের দুঃখের ইতিহাস?

– সেটাই প্রশ্ন। একাত্তরের সত্যিকারের ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বাইরেও যে কোটি মানুষের ছোট ছোট দুঃখ কষ্টের ইতিহাস আছে সেটা আমরা কখনই মনে করিনি। এখন তো স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক কে সেটা প্রতিষ্ঠিত করা নিয়েই কোন্দল। বাহান্নর ইতিহাস এখনও শুধুই রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার আর কিছু কবি, সাহিত্যিক আর রাজনৈতিক নেতার বীরত্বের কাহিনী। লাখ লাখ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথা আজ অনুচ্চারিত। এমতাবস্থায় লাখ লাখ গৃহহারা মানুষের দুঃখের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা – সে তো রীতিমত বাতুলতা। এখানে মানুষ কখনই মানুষ ছিল না, তারা শুধুই সংখ্যা। কখনও গরিষ্ঠ, কখনও লঘিষ্ঠ – যাদের প্রায় সব সরকারই নিজেদের প্রয়োজনে পরস্পরের মুখমুখি দাড় করিয়ে ফায়দা লুটে। দেশভাগের সময় মানুষের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয় যে পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য, ভারত শুধু হিন্দুদের জন্য। হয়তো এ কারণেই দেশভাগের ওই মুহূর্তে দু দল পলায়নপর জনতার ঢল আমরা দেখি। সেটা যেমন ছিল বাংলায়, তেমনি পাঞ্জাবেও। দুঃখজনক ব্যপার হোল এরা একে অন্যের কাছ থেকে পালালেও ওই মুহূর্তে পরস্পরের দিকে ধেয়ে আসছিল আর অনেক সময় দেশ হারানোর শেষ আক্রোশটুকু ঢালছিল তাদের মতই অসহায় মানুষের উপর, যারা ছিল তাদের মতই অন্যদের রাজনীতির শিকার, যারা তাদের মতই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছিল এবং যাদের অনেকেই তাদের মতই পথেই হারাচ্ছিল প্রাণ। কিন্তু এর দায়িত্ব কেউ নেয়নি। যেসব দল বা নেতা প্রায় এক কোটি মানুষের জীবনে এত দুর্ভোগ বয়ে আনল, যা কিনা হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমানবিক বোমার মতই এখনও অনেককেই কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে, যাদের ভুল রাজনীতির কারণে উপমাহাদেশ আজ সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্য তারা কিন্তু এখনও পূজিত, সম্মানিত।

অবশ্য এ দেশের কেউ যে তাদের পশ্চিম বঙ্গের জীবন নিয়ে লিখেননি সেটা ঠিক নয়। হাসান আজিজুল হকের  “আগুন পাখি” আমাদের সেই সময়ের মুসলিম মানসিকতার কথা বলে, যেমন বলে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে”।

সবার কথা বলতে পারব না তবে দেশভাগের ফলে স্থানান্তরিত যেসব মানুষের সাথে আমার দেখা হয়েছে তাদের মধ্যে আমি দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। তবে সংখ্যাটা যেহেতু বড় নয়, এটাকে স্ট্যাটিসটিক্যাল সত্য বলে মনে করার কোন কারণ নেই। ‌যেসব হিন্দু পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে তাদের অধিকাংশের মধ্যে দেখেছি এ দেশের প্রতি ভালোবাসা। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে তারা আবেগের সাথে নিজেদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর পাড়া-প্রতিবেশীর গল্প শুনিয়েছে, জানতে চেয়েছে সেখানকার বর্তমান অবস্থার কথা। অন্যদিকে যেসব মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে এসেছে তাদের বেশির ভাগ জানিয়েছে তাদের ঘৃণার কথা। শুধুমাত্র অধিকাংশ লেখক যারা এ বিষয়ে লিখেছেন তারা ভালোবাসাকে সামনে এনেছেন। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো, কেননা ওপারের মুসলিম পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে নিজেরা সেখানে নতুন জীবন গড়বে বলে আর এই সৃষ্টির ফলে ভারত ভাঙলে এপারের হিন্দু নিরুপায় হয়ে ওখানে গেছে।

দেশ ত্যাগ বা জন্মভূমি ছেড়ে ভাগ্যের অন্বেষণে অন্য কোথাও যাওয়া এটা নতুন কিছু নয়। মানুষ দেশের ভেতরে এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় যায় অথবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে। কেউ যায় বাধ্য হয়ে, কেউ স্বেচ্ছায়। যারা স্বেচ্ছায় যায় তারা উদ্যোগী মানুষ, রিস্ক নিতে ভয় পায় না। কিন্তু যাদের চাহিদা খুব বেশি না, যারা নিজেদের বর্তমান অবস্থায় খুশি তারা সহজে পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে কোথাও তেমন একটা যায় না।

শুরুতে বলেছিলাম যে ওপার বাংলা থেকে যারা বাংলাদেশে এসেছে তাদের হয়তো ও দেশ নিয়ে সে রকম নস্টালজিয়া নেই। কথাটা ঠিক নয়। এটা ঠিক যে এ নিয়ে খুব বেশি গল্প বা উপন্যাস লেখা হয়নি। কিন্তু আমার ধারণা আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে এদিক থেকে যাওয়া মানুষ যেমন তাদের ফেলে আসা ঘরবাড়ি, ফেলে আসা দেশের কথা শোনায়, যদি কেউ পশ্চিম বঙ্গ থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসে তাহলে ওপার থেকে আসা মানুষেরা নিশ্চয়ই একই ভাবে নস্টালজিক হয়, হারানো দিনের গল্প করে। দেশ যখন ভাগ হয় তখন নেতাদের কেউ কেউ এটাকে তখনকার সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখেছিলেন। নিঃসন্দেহে তারা ক্ষমতার মোহে অন্ধ ছিলেন আর নিজেদের ইচ্ছাটাকে সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন যারা বিশ্বাস করত দেশ ভাগ হলেই ভাগ্য খুলে যাবে। কিন্তু তারা ভাবেনি এর ফলে তাদের বাপদাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আগে সমস্যা ছিল, ঝগড়া বিবাদ হত, কিন্তু সেটা মিটেও যেত। কেউ ভাবত না প্রতিবেশীকে ভিটে ছাড়া করার কথা। কিন্তু এই বিভাগের ফলে দেখা গেল দেশ আর তার দেশ নয়, চাইলেই তাকে দেশ ছাড়া করা যায়। এটাই হয়তো ভারত ভাগের সবচেয়ে ট্র্যাজিক দিক। কোন সমস্যার সমাধান হয়নি, বরং সাম্প্রদায়িক সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। এই বিভাগের জের প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ ভোগ করবে। দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা স্থায়ী আসন গ্রহণ করেছে। যে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য এত ত্যাগ, এত মৃত্যু, এত দেশান্তর – সেই সাম্প্রদায়িকতাই এখন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। এটাই মনে হয় দেশ ভাগের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ব্রিটিশ রাজ আগে সরাসরি আমাদের উপর শাসন করত, দেশ ভাগের পঁচাত্তর বছর পরেও তারা ডিভাইড অ্যান্ড রুলের ডিভিডেন্ড গুনেই যাচ্ছে। রাজনীতিবিদ দেশ ভাগ করে মাটির উপর রেখা টেনে। প্রচুর সাধারণ মানুষের জন্য এই রেখা চলে যায় তাদের বুক ভেদ করে। আজ ইউক্রেনের সমস্যা এই মানুষের বুকের ভেতর দিয়ে সীমানা টানার ফল।

রাশিয়ায় মালায়া রোদিনা বলে একটা শব্দ আছে যার আক্ষরিক অর্থ ক্ষুদ্র জন্মভূমি। দেশ যাই হোক মানুষের কাছে তার শৈশবের সেই গ্রাম বা শহর বা শহরের কোন রাস্তা বার বার ফিরে আসে। আমি যেমন দেশের কথা মনে হলে কালীগঙ্গা, দক্ষিণ চক, বাঁশ ঝাড় এসবের কথা ভেবে নস্টালজিক হই, কেউ নস্টালজিক হয় গৌরীপুর, রাজশাহীর ভার্সিটি ক্যাম্পাস, ঢাকার জিকাতলা, অমরাবতী ক্লাব এসবের কথা ভেবে। আমার স্ত্রীকে দেখি মনকে চাঙ্গা করার জন্য মস্কোর লেনিনস্কি প্রসপেক্ট ধরে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হেঁটে বেড়াতে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া