মতামত

হিংসার বাজারে ভালবাসার দোকান 

— রবীন গুহ

রবীন গুহ (ফাইল ছবি)

কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছে কংগ্রেস। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কর্ণাটকে ক্ষমতায়  কংগ্রেস। ২২৪টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস একাই জয় পেল ১৩৫টা আসনে। অর্থাৎ ম্যাজিক ফিগারের চেয়ে ২৩টি বেশি। ক্ষমতাসীন বিজেপি নেমে গেল ৬৬টি আসন।

নয় বছর আগে ২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই কংগ্রেসমুক্ত ভারতের ডাক দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!  কর্ণাটকের এবারের নির্বাচনে হেরে গোটা দক্ষিণ ভারত হয়ে গেল বিজেপিমুক্ত। দক্ষিণের পাঁচ রাজ্যের একটিতেও আর ক্ষমতায় নেই তারা। উল্লেখ্য, দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাড়ু এবং তেলেঙ্গনার মধ্যে শুধু কর্ণাটকে ক্ষমতায় ছিল বিজেপি।

এবার দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কর্ণাটকে কাজ করল না ‘মোদি-ম্যাজিক’। ব্যর্থ হল হিন্দুত্ববাদী দলটি। কর্নাটক নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের পিছনে কয়েকটি  কারণের কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেখানে রাজ্যে নেতাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনও বড় মুখ নির্বাচনী প্রচারণার সময় সামনে আনা হয়নি। তার পরিবর্তে কর্নাটকের ভোট প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনেক  সময় দিলেও তার বিশেষ কোন ফায়দা  বিজেপি তুলতে পারেনি। স্হানীয়ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকেই সে ভাবে গুরুত্ব না দেয়াতে নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ছিল অসন্তোষ। কর্নাটকে বিজেপির প্রচারে বিভিন্ন গোষ্ঠী ভোট ঝুলিতে আনার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। লিঙ্গায়েত তো বটেই সেই সঙ্গে দলিত, আদিবাসী-সহ অন্যান্য পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের ভোট টানার চেষ্টা হয়েছে। গোটা দেশেই এই ভোট অতীতে বিজেপিকে সুবিধা দিয়েছে। বাংলাতেও মতুয়া, রাজবংশী, দলিত, আদিবাসী ভোটকে বিজেপি নিজেদের বড় সম্পদ বলে মনে করে। কিন্তু এবার কর্ণাটকের সেই ভোটও তাদের পক্ষে যায়নি। ভোটের প্রচারে বিজেপি হালাল, হিজাব, আজান-সহ এমন বেশ কিছু বিষয় সামনে আনার চেস্টা করেছে,  যার ফলে ধর্মীয় উস্কানির অভিযোগ উঠেছে। কর্ণাটকের বড় অংশের ভোটার এই রাজনীতিকে গ্রহণ করেনি। ফলশ্রুতিতে বিগত দশকে প্রচন্ড প্রতাপের সাথে ভারতের কেন্দ্র ও বেশিরভাগ রাজ্যসরকারে ক্ষমতায় থাকা দলটি দক্ষিন ভারতের রাজনীতিতে বিপর্যয়ে সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। আগামীবছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে  বিজেপির জন্য এটা একটা বড় রকমের  ধাক্কা বলা যায়। এবং এই বিজয়ের পর বিরোধী দল হিসেবে বেশ কিছুদিন ধরে অনেকটা দুর্বল অবস্হানে থাকা কংগ্রেস দলটি এখন নতুন করে উজ্জ্বীবিত।

নির্বাচনে আশাতীত ভাল ফলাফলের খবরে আবেগ আপ্লুত কংগ্রেস দলীয় নেতা  রাহুল গান্ধী বলেন, ‘কর্ণাটকে হিংসার বাজার বন্ধ হয়েছে, ভালোবাসার দোকান খুলেছে।’ অন্যদিকে কর্ণাটকে বিপুল জয়ের পর কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ মাথা পেতে মানলেন ফলাফল। টুইট বার্তায় প্রধানমন্ত্রী লিখলেন, ‘কর্ণাটক নির্বাচনে যাঁরা আমাদের সমর্থন করেছেন আমি তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি বিজেপি কর্মীদের কঠোর পরিশ্রমেরও প্রশংসা করতে চাই। আমরা আগামী দিনে আরও জোরালোভাবে কর্ণাটকের সেবা করব।’ এরপর কংগ্রেসের উদ্দেশে তিনি লিখলেন, ‘কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের জন্য কংগ্রেসকে অভিনন্দন। জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে তাদের প্রতি আমার শুভকামনা।’

উপমহাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অসহনশীলতা, পেশীশক্তির ব্যবহার, প্রতিপক্ষের  উপর দমন-নিপীড়ন এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভারতেও রাহুল গান্ধী একটি মামলায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে পার্লামেন্ট সদস্যপদ হারিয়েছেন, যা কংগ্রেসের মতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এমন একটা সময়ে বিপর্যয়ের মুখে দাড়িয়েও দুর্দন্ড প্রতাপশালী মোদী-অমিতশাহদের নির্বাচন ব্যবস্হার উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ না করা এবং ভোটের ফলাফল মেনে নিয়ে বিরোধী পক্ষকে অভিনন্দন জানানো সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্হার প্রতি বিজেপির আস্হাশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। এমন ইতিবাচক রাজনীতি ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্হাকে আরো শক্তিশালী করবে।

বাংলাদেশ,পাকিস্তানসহ গোটা উপমহাদেশেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দলগুলোর মধ্যে নিজেদের মধ্যকার চরম বিরোধ-হানাহানির বদলে সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে  গণতন্ত্র তথা মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, তা জনগণের জন্য মঙ্গলই বয়ে আনবে।

নিশ্চয়ই সকল বাঁধা ছিন্ন করে হিংসার বাজারে একদিন ভালবাসার দোকান খুলবে।

লেখকঃ সম্পাদক মন্ডলির সদস্য, প্রগতির যাত্রী ডট কম