শিল্প সাহিত্য

কমরেড  লেনিন

-নাজিমুদ্দীন শ্যামল

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল রাশিয়ার সিমবির্স্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আসল নাম ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ । পরবর্তী সময়ে তিনি লেনিন নামে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন রাশিয়ান বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক।  লেনিন ছিলেন কমিউনিস্ট ও মার্ক্সবাদী । তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর লেনিনিজম নামে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচলন করেন, যার দ্বারা তিনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক উপস্থাপনা করেছিলেন।

লেনিনের পিতার নাম ল্যা নিকোলয়েভিচ্ উলিয়ানভ এবংমায়ের নাম মারিয়া আলেক্সান্ড্রাভনা উলিয়ানভ । লেনিনের পিতা একজন বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলেন এবং গণতন্ত্রবাদকে তীব্র সমর্থন করতেন ।  লেনিনের মা সেকালের এক প্রথিতযশা চিকিৎসকের  কন্যা এবং পেশায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা। লেনিনের একজন বড়ভাই ও বোন ছিল । সকলেই ছিল বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন । দাদা আলেক্সান্ডারকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল জার হত্যার ষড়যন্ত্র করার অপরাধে । জার ছিলেন সেকালের রাশিয়ার শাসক। লেনিন-এর বোন অ্যানা ইলিচনিনাও ছিলেন  বিপ্লবীযোদ্ধা।

১৮৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে পিতা নিকোলয়েভিচ্ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান । তখন লেনিন মাত্র ১৫ বছর বয়সী ছিলেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লেনিন কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এই সময় তিনি ছাত্রদের নিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিবাদ সভায় উপস্থিতির কারণে মাত্র তিন মাসের মাথায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। জার সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তাঁর বড় ভাইয়ের ভূমিকার কথা বিবেচনা করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চান নি বলেই, তাঁকে সামান্য কারণে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সামারা যান। এই সময় কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (Karl Heinrich Marx, ৫ই মে, ১৮১৮ – ১৪ই মার্চ, ১৮৮৩) এর  ডাস ক্যাপিট্যাল পরে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। পরে তিনি ব্যাপক জনসংযোগ এবং মার্ক্সবাদী দর্শন প্রচারের মাধ্যমে  রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠেন। এই সময় তিনি স্থানীয় অন্যান্য মার্ক্সবাদীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এরপর সামারা থেকে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে আসেন এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটস নামক মার্কসবাদী দলের সাথে যুক্ত হন। তাঁর মূল কাজ ছিল দলের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের ভিতরে বিপ্লবী গ্রন্থাদি বিতরণ করা।তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে হয়ে ওঠেন একজন পেশাদার বিপ্লবী । অন্যান্য সমসাময়িক বিপ্লবীদের সাথে সাথে তাকেও একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে দেওয়া হয়।

সেখানে থাকাকালীন তিনি বিয়ে করেন। লেনিনের  স্ত্রীর নাম ছিল নাদেজদা ক্রুপস্কায়া। ১৯০১ সালে, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন শেষ হলে তিনি ‘ লেনিন ‘ ছদ্মনাম ব্যবহার শুরু করেন এবং এরপরের প্রায় দেড়দশকের মতো সময় ইউরোপে কাটিয়ে দেন। তিনি রাশিয়ার লেনা নদীর নামানুসারে নিজের ছদ্মনাম রাখেন ‘লেনিন’।

১৯০০ সালের জানুয়ারিতে সাইবেরিয়ান নির্বাসনের মেয়াদ শেষ করার পর, লেনিন দেশ ছেড়ে চলে যান এবং পরে মিউনিখে ক্রুপস্কায়া যোগ দেন।  বিদেশে তার প্রথম প্রধান কাজ ছিল প্লেখানভ, মার্টোভ এবং অন্য তিনজন সম্পাদকের সাথে ইস্ক্রা (“দ্য স্পার্ক”) পত্রিকা বের করার জন্য যোগদান করা। তারা আশা করেছিলেন যে পত্রিকাটি  রাশিয়ান মার্কসবাদী গোষ্ঠীগুলির কাছে রাশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে দিলে তাদের একটি সমন্বিত সমাজে একীভূত করা সম্ভব হবে।

১৮৮০-এর দশকের শেষের দিকে প্লেখানভের লেখা পড়ার পর লেনিন প্লেখানভের নীতিগুলি মেনে চলেছিলেন।  কিন্তু, লেনিন এক ধাপ এগিয়ে গেলেন, বিশেষ করে কৃষকদের ক্ষেত্রে।  পরে লেনিন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মার্কসবাদের বাইরে কোনো সমাজতন্ত্র থাকতে পারে না; যার লক্ষ্য ছিল শেষ পর্যন্ত বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি উৎপাদনের উপায়ের ব্যক্তিগত মালিকানা বাতিল করা।

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ -নামক গ্রন্থটি। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি মাসে তাঁর নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হয়। মুক্তির পর তিনি পস্কোভ শহরে বসবাস করা শুরু করেন। এরপর তিনি বিপ্লবী প্রচারে জন্য একটি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্য তিনি ইউরোপের বিভিন্ন শহরের ঘুরে বেড়ান। তিনি ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানীর লিপজিগ শহরে যান। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দর ১লা ডিসেম্বর জার্মানির লিপজিগ শহর থেকে তাঁর উদ্যোগে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ইস্ক্রা’ নামক পত্রিকা। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মানির মিউনিখ শহরে কাটান। এই সময়ে ‘ইস্ক্রা’ মিউনিখ থেকে প্রকাশিত হতো। ১৯০২-০৩ খ্রিষ্টাব্দে লণ্ডন, ১৯০৩-০৫ খ্রিষ্টাব্দে জেনেভাতে কাটান।

লণ্ডনে থাকার সময় তিনি রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হয়। অচিরেই তিনি এই দলের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স পার্টি -এর দ্বিতীয় অধিবেশনে অধিকাংশ সদস্য লেনিনের মতকে সমর্থন করেন। ফলে দলটি দুই ভাগে বিভাজিত হয়ে যায়। লেলিনপন্থী বড় দলটি বলশেভিক নামে পরিচিতি লাভ করে। অন্য দিকে ছোট দলটির নাম হয় মেনশেভিক।

লেনিন এবং মেনশেভিকদের মধ্যে পার্থক্য ১৯০৫ সালের বিপ্লব এবং তার পরবর্তী সময়ে তীব্রতর হয়ে ওঠে, যখন লেনিন দুটি বিষয়ে একটি স্বতন্ত্রভাবে মূল দৃষ্টিভঙ্গিতে চলে আসেন: বিপ্লবে শ্রেণী বিন্যাস এবং বিপ্লবোত্তর শাসনের চরিত্র।  প্রথমদিকে তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীর “আধিপত্য” জয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও  পরে তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে সর্বহারা শ্রেণীই ছিল বিপ্লবের চালিকাশক্তি এবং তার একমাত্র নির্ভরযোগ্য মিত্র হল কৃষক। এইভাবে, মেনশেভিকদের বিপরীতে, লেনিন  এমন একটি জোটের উপর ভিত্তি করেছিলেন যা “সর্বহারা এবং কৃষকদের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব” প্রতিষ্ঠা করবে। পরবর্তী সময়ে বলশেভিকরা একটি নতুন সরকার, কাউন্সিল অফ পিপলস কমিসারস বা সোভনারকোম গঠনের ঘোষণা দেয় ।   কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেনিন সেখান থেকে সরে আসেন। কিছু সময় পর লেনিন এবং অন্যান্য বলশেভিকরা সোভিয়েতদের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

মার্কসবাদী দর্শনে, লেনিনবাদ হচ্ছে একটি বিপ্লবী অগ্রবর্তী দলের গণতান্ত্রিক সংগঠনের জন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রধান অংশ। এটি সমাজতন্ত্র এবং প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক পূর্বসূচক। লেনিনবাদী পার্টির কাজ হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীকে রাজনৈতিক চেতনা (শিক্ষা এবং সংগঠন) এবং রুশ সাম্রাজ্যের পুঁজিবাদকে অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিপ্লবী নেতৃত্ব প্রদান করা ।

লেনিনবাদ হচ্ছে, সাধারণভাবে শ্রমিক-বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এটি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের মতবাদ ও রণকৌশল। বৈপ্লবিক তত্ত্বে লেনিনের অবদান এতোই বিপুল যে উত্তরকালে তার নাম হয়েছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হলও সারা বিশ্বের প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিক মতবাদ।[ স্তালিনের মতে,  সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে লেনিনবাদই হল মার্কসবাদ’।

১৯১৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের আগে, তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে জাতিগত এবং জাতীয় সংখ্যালঘুরা তাদের স্বাধীনতার আহ্বানের মাধ্যমে সোভিয়েত রাষ্ট্রকে অশাসনযোগ্য করে তুলবে।  সংখ্যালঘু জাতিগত গোষ্ঠীগুলি আন্তর্জাতিকতার চেতনায় অবিলম্বে পুনরায় একত্রিত হবে বলে আশা করেছিল।  তিনি এই ঐক্য নিশ্চিত করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক ছিলেন। ফলে ইউক্রেন, জর্জিয়া, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং বাল্টিক রাজ্যে গঠিত স্বাধীন রাজ্যগুলিতে সশস্ত্র অনুপ্রবেশ ঘটে।  শুধুমাত্র ফিনল্যান্ড, বাল্টিক রাজ্য এবং পোল্যান্ডের সাথে এর দ্বন্দ্ব ব্যর্থ প্রমাণিত হলেই লেনিনের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়।

মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের পিছনের প্রধান  আদর্শবাদী ব্যক্তি হওয়ার ফলে তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটি লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছিলেন। লেনিন ছিলেন আন্তর্জাতিক সাম্যবাদ আন্দোলনের এক অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনক হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত।  তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়ার এবং ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

লেনিন একটি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান১৯১৮ সালে। কিন্তু গুরুতরভাবে আহত হন। ফলে তাঁর স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ফলে তিনি দৈনন্দিন সরকারি কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ক্রুপস্কায়ার মস্কোর কাছে গোর্কিতে একটি অবসর জীবন কাটাতে থাকেন। শেষের দিকে তাঁর কথা বলার শক্তিই ছিল না।১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ২১ জানুয়ারি শেষবারের মতো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃতদেহকে মস্কোর রেড স্কোয়ারে একটি সমাধিতে রাখা হয়।

# নাজিমুদ্দীন শ্যামলঃ কবি, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র ও নাট্যকর্মী
সভাপতি, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র,
সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন,
চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান, দি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, রয়টার্স