চলমান সংবাদ

জেসমিনের পরিবারের কোনো দাবি নেই, মামলাও করবে না

র‌্যাব হেফাজতে নওগাঁর একটি ইউনিয়নের ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনের (৪৫) মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। পরিবারের সদস্যরা মামলা করতে সাহস পাচ্ছেন না।

পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তরের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকধারী সদস্যদের উপস্থিতিতে দাফন করা হয়েছে।

এদিকে সোমবার হাইকোর্ট এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত র‌্যাব সদস্যদের নাম ও তালিকা জানাতে বলেছেন সংশ্লিষ্টদের। হাইকোর্ট পুরো ঘটনা জানানোরও নির্দেশ দিয়েছেন।

আর জেসমিনের বিরুদ্ধে নওগাঁ এলাকায় নয়, রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকার একটি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই মামলার বাদী একজন যুগ্ম সচিব।

ঘটনার পর পরিবারের সদস্য র‌্যাব হেফাজতে নির্যাতনে জেসমিনের মৃত্যুর অভিযোগ করলেও এখন আর তারা কোনো কথা বলছেন না। তাদের কথায় আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। জেসমিনের ভাই মো. সোহাগ মিয়া সোমবার দুপুরে ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা এখন আর এই বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আপনারা আমাদের চেয়েও অনেক বেশি শুনেছেন। কী ঘটেছে আমাদের চেয়ে আপনারা ( সাংবাদিক) ভালো জানেন। আমরা আর কোনো কথা বলবো না। আমরা কোনো মামলা করি নাই। আমাদের কোনো দাবি নাই। আমরা কোনো মামলা করবোও না।”

তিনি জানান, “শনিবার দুপুরের পর র‌্যাব তার লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করার পর আমরা রাতে শহরের সরকারি কবরস্থানে দাফন করেছি।”

জেসমিনের মামা নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু বলেন,”আমাদের পক্ষ থেকে কোনো মামলা এখনো করিনি। ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর চিন্তা করবো৷ জেসমিনকে দাফনের সময় সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির সদস্যরা ছিলেন।”

আপনারা তো র‌্যাব হেফাজতে জেসমিনকে নির্যাতনের অভিযোগ করেছিলেন; কিন্তু মামলা করলেন না কেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি কতক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনা, পরে ফোন করব।”

নওগাঁ সদর মডেল থানার ওসি মু ফয়সাল বিন আহসান জানান, “আমাদের থানায় জেসমিন মারা যাওয়ার ব্যাপারে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা বা অভিযোগ করা হয়নি। র‌্যাবের পক্ষ থেকেও কোনো মামলা বা অভিযোগ করা হয়নি।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “জেসমিনের বিরুদ্ধে আমাদের থানায় কোনো মামলা নেই। তবে শুনেছি রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় একটি মামলা আছে। সেই মামলায় র‌্যাব তাকে আটক করে।”

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে জেসমিনকে আটক করা হয়। শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

নাজমুল হক মন্টু রোববার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”বুধবার সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে জেসমিন বের হন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তির মোড় থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে র‌্যাবের লোকজন তাকে ধরে নিয়ে যায়। দুপুর ১২টার পর জানতে পারি, জেসমিন নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেখানে গিয়ে র‌্যাবের লোকজনকে দেখতে পাই। কিন্তু ভাগনি কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ পর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তার মৃত্যু হয়। যদিও লাশ হস্তান্তর করা হয় শনিবার দুপুরের পর।”

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এফ এম শামীম আহমেদ রোববার সাংবাদিকদের বলেন,”যতদূর শুনেছি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছেন। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও মাথায় আঘাতের লাল দাগ ছিল।”

জেসমিনের ছেলে সাহেদ হোসেন সৈকত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।  ওইদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমার মা চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। যার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।”

র‌্যাবের কোম্পানি কমান্ডার মেজর নাজমুস সাকিব রবিবার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আটকের পর ওই নারীকে র‌্যাবের কোনো ক্যাম্পে নেয়া হয়নি। আটকের পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পর থেকে মৃত্যুর  আগে পর্যন্ত তার পরিবারের লোকজন তার সঙ্গেই ছিলেন। নির্যাতনের অভিযোগ সঠিক নয়।”

তিনি দাবি করেন,”জেসমিনের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার একটি অভিযোগের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। তার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ ছিল।” তবে সোমবার অনেক চেষ্টা করেও এই র‌্যাব কর্মকর্তার বক্তব্য জানা যায়নি।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ এস এম সিদ্দিকুর রহমান জানান, “জেসমিনের বিরুদ্ধে আমাদের থানায় যুগ্ম সচিব এনামুল হক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি প্রতারণার মামলা করেন কয়েকদিন আগে। এনামুল হক রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। জেসমিনের বিরুদ্ধে তিনি ফেইক ফেসবুক আইডির মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন।” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তাকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে আমরা র‌্যাবের সহায়তা চাইনি।”

এদিকে সোমবার হাইকোর্ট র‌্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় তাকে আটক করা থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব র‌্যাব সদস্যদের তালিকা চেয়েছেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। ওই ঘটনায় কোনো মামলা না হওয়ায় আদালত প্রশ্ন করেন, “কেন ওনারা(পরিবারের সদস্য) মামলা করবেন? রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব নেই? দেশজুড়ে এই ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।”

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইসরাত হাসান বলেন, “ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে না। এটা যে থানায় মামলা হয়েছে সেই থানার পুলিশের দায়িত্ব। আর আদালতের অনুমতি ছাড়া, তদন্তের দায়িত্ব না পেয়ে র‌্যাব কীভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটক করল? এটা আইনের চরম লঙ্ঘন। যেভাবেই হোক র‌্যাব হেফাজতে তার মৃত্যু হয়েছে। তার পরিবার মামলা না করলেও জেলার এসপির দায়িত্ব হলো হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা করা। সেটা না করেও আইন অমান্য করা হয়েছে। র‌্যাবেরই এখন দায়িত্ব হলো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা। আইনের বিধান তাই।”

” র‌্যাব তো তাকে আটকের কথা স্বীকার করেছে। ফলে তারা দায়ের মধ্যে চলে এসেছে। ওই নারীর বয়স ৪৫। এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যুর বয়স নয়। লাশ তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়েছে। এসপির দায়িত্ব ছিলো আরো প্রাথমিক তদন্ত করার। তার পরিবারকে ধারণা করি মামলা যাতে না করে তার জন্য বাধ্য করা হয়েছে। এগুলোর তদন্ত হওয়া দরকার,” বলেন এই আইনজীবী।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনির হেফাজতে আমরা অনেক মৃত্যু দেখেছি। এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু এইসব ঘটনা তদন্ত ও বিচারের আওতায় না আনায় আমরা যতই বলি তারা কোনো শক্ত বার্তা পাচ্ছেনা। ফলে আবারো একই ঘটনা ঘটলো। রাস্তা থেকে একজন সুস্থ নারীকে র‌্যাব তুলে নিয়ে গেল। এরপর তিনি মারা গেলেন। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে!”

তার কথা, “তার পরিবার মামলা করবে কীভাবে? বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ মামলা করতে ভয় পায়।”

২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসে। ২০২২ সালে তিনজন ক্রসফায়ারে নিহত হন, যা আগের বছরের তুলনায় ৯৪ ভাগ কম। ২০২১ সালে নিহত হন ৫১জন। ক্রসফায়ারে মৃত্যু কমলেও হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে। ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১৮ জন।

# হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে, ঢাকা