মতামত

একটি নদীর কান্না!… মুনাফাখোরদের খপ্পরে ঐতিহ্যবাহী সুতাং নদী!!

-মহিবুল ইসলাম ফারুক

‘সুতাং নদী’— সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক। শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত -সারা বছরই আপন বেগে বহমান। বাংলাদেশ-ভারতের এই আন্তঃসীমান্ত নদীটির অববাহিকার আয়তন ৪০০ বর্গকিলোমিটার। জোয়ারভাটার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এই নদীটি বহু যুগ ধরে সমগ্র অববাহিকার আপামর জনগনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের নীরব সাক্ষী। মাছ ধরা, সেচ, বাঁশের চালি ভাসিয়ে দূর-দূরান্তে নেয়াসহ এলাকাবাসীর জীবন-জীবিকার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্থ সুহৃদ-সাথি এই সুতাং নদী। সুতাং নদী নিয়ে কিংবদন্তি আছে যে, শায়েস্তা খান বহু দেশ বিজয়ের উদ্দেশে বারবার সেনা পাঠিয়েছিলেন সুতাং নদী দিয়ে। সেনা সৈন্যরা সুতাংয়ে এসে কখনো রাত যাপন করত বলেও জনশ্রুতি আছে।
.
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এর উৎপত্তি; হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে উপজেলা শহরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে হবিগঞ্জ জেলা সদরের সুতাং এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লাখাই উপজেলার কালনী নদীতে গিয়ে মিশেছে।
.
এক সময় কতই না উচ্ছ্বল ছিল কলকল রবে বয়ে চলা এই নদী। এর কলকল ধ্বনির সাবলীল প্রবাহ দেখে বিমুগ্ধ হত পথিকের হৃদয়-মন। যার চারিদিকে একসময় ছিল পাখির কলকাকলী। নদীর বুকে জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরার অপূর্ব দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যেত, ছিল মানুষের অবাধ বিহার কিন্তু আজ দূর্গন্ধে নাকে রুমাল চাপতে হয় সুতাং পাড়ে গেলে! কালো পানিতে ঘনবর্জের আস্তরণ; মাছের বংশ অনেক আগেই শেষ; পাশের জমিতে ফসলও হয়না আজ! মুনাফাখোরদের নির্মম ধর্ষণে আজ ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত সুতাং নদী; কান্নাই যার নিত্যদিনর নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে! সুতাং নদীর ভাটি অববাহিকায় কান পাতলেই এর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। দুই তীরের মানুষ ও পশু-পাখির করুণ আর্তনাদ মনকে বিষিয়ে তুলে। কিন্তু মন গলে না পাষাণ মুনাফাখোরদের! কান্নার আওয়াজ ওদের কানে পৌঁছায় না! কেননা এই মুনাফাখোররা থাকে সুরক্ষিত মহলে কিংবা অন্য কোন নগরে।
.
শিল্পায়ন মোটেও দুষনীয় নয় বরং এলাকার নানামুখী উন্নয়নের সোপান। নদীর অনতিদূরে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার হাজার লোকের। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। নদীর সাথে শিল্প-কারখানার কোন বৈরীতা নেই। শিল্প হওয়ায় কেউ অখুশি নই কিন্তু দূর্ভাগযজনক হল শিল্পমালিকদের অতি মুনাফার লোভের বলি হয়েছে আমাদের সুতাং নদী! অতিরিক্ত মুনাফার লোভে খরচ বাঁচাতে বর্জ্য শোধনের আবশ্যকীয় ব্যবস্থা না রেখেই (প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট ছাড়াই) শিল্পবর্জ্য নদীতে ছেড়ে দিয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ও সাধারণ মানুষকে সীমাহীন ভোগান্তির অকুল পাথারে ঠেলে দিয়েছে কিছু লোভাতুর শিল্পোদ্যোক্তা! অতিরিক্ত মুনাফাই যেন তাদের শেষ কথা! উদ্যোক্তাদের অতিমুনাফা লিপ্সার কারণে দিনে দিনে শিল্পায়ন এই এলাকার জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে! ক্ষমার অযোগ্য এ অপরাধ তারা চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত তাদেরকে ম্যানেজ করেই!
.
যদ্দূর জানি শিল্প-কারখানা স্থাপনের অনুমোদনে পুর্বশর্তের মধ্যে এটিও একটি যে,- শোধন করেই বর্জ নিষ্কাশন করতে হবে। কাজেই ট্রিটমেন্ট ব্যতিরেকে তরল শিল্প-বর্জ্য কারখানার বাহিরে চালান করার কথা নয়। (সরকারি চাকুরীতে যোগ দেবার আগ পর্যন্ত DEPZ-এর একটি বিদেশী কোম্পানীতে কাজ করার সুবাদে দেখেছি: কোম্পানীটিতে তরল বর্জ্য শোধনের জন্য একটি আলাদা ‘ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ ছিল। যেখানে বিভিন্ন ধাপে বর্জ্য শোধন করে সর্বশেষ স্বচ্ছ পানি হিসাবেই কারখানার তরল-বর্জ্য বাহিরে চালান হত এবং যে আধারটি হতে তরল বাইরে চালান হত তাতে কিছু মাছ জিইয়ে রাখা হত। উপর থেকে মাছগুলোর গতিবিধি দেখা যেত। পানিতে কোন দুর্গন্ধ বা রং অবশিষ্ট থাকত না!)
.
অথচ হবিগঞ্জ জেলার অলিপুরে গড়ে ওঠা কলকারখানাগুলোর দূষিত বর্জ্য সুতাং নদীতে ছাড়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট বা পরিশোধন ছাড়াই! শিল্প-বর্জ্যের দুর্গন্ধে সুতাং এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছে, জনজীবনে দুর্বিঃসহ যন্ত্রনা নেমে এসেছে! নদী তীরবর্তী বুল্লা, করাব, লুকড়া, নূরপুর, রাজিউড়াসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক বিপর্যয়ের পাশাপাশি উদ্বেগজনক মানবিক সংকট তৈরী হয়েছে। দূষিত বর্জ্যে নদীর পানি কালো হয়ে ব্যাপক দুর্গন্ধ চারিদিকে ছড়াচ্ছে। এই নদীতে এক সময়ে মাছ ছিল—এমনটা মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এই নদী থেকে জেলেদের আয়ের অন্যতম একটি উৎসও বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষি কাজে চাষাবাদে নদীর পানির অবাধ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না বরং দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানির প্রভাবে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি নদীর বর্জ খেয়ে হাঁস- মুরগিও মারা যাচ্ছে। ফলে গ্রামগুলোতে হাঁস-মুরগি পালনও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চর্মরোগসহ ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে এলাকাবাসী। বলা যায় একই সাথে পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়!
.
পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এমনটা অকল্পনীয় কিন্তু সোনার বাংলা আজ সব সম্ভবের দেশ! নদী রক্ষা কমিশন, পরিবেশ দপ্তরসহ যাদের এসব দেখার কথা তাদেরকে ম্যানেজ করেই হয়ত এসব হচ্ছে! নচেৎ তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে কেন! শিল্প-কারখানার মালিক মানেইতো হোমড়াচোমড়া। এই দেশতো কেবল এদেরই; আমজনতা অপাংক্তেয়! তাদের কথা কে শুনে!
.
শুনেছি ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’ (বাপা)সহ অনেকেই আন্দোলন করছে এ অনাচারের বিরোদ্ধে কিন্তু বন্ধ হচ্ছেনা দূষণ। থামছে না সুতাং নদীর কান্না! কলকারখানার মালিকদের খুটির জোড়ের কাছে এসব আন্দোলন নস্যি!

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি