চলমান সংবাদ

আইএলও কনভেনশন ১৯০ প্রসঙ্গে

-ফজলুল কবির মিন্টু

নিঃসন্দেহে আইএলও কনভেনশন ১৯০ একটি যুগান্তকারী চুক্তি। যা ২০১৯ সালের জুন মাসে  অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে আইএলও কর্তৃক গৃহীত হয়। এটি কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা এবং হয়রানি প্রতিরোধে একটি আন্তর্জাতিক মান। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের মর্যাদা ও উন্নত জীবনমান রক্ষা করা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এই কনভেশনটির অন্যতম লক্ষ ও উদ্দেশ্য। এই কনভেনশন কর্মক্ষেত্রের সকল ক্ষেত্র তথা, বেসরকারি বা সরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক এমনকি শহুরে বা গ্রামীণ সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

কনভেনশনের ৩য় অনুচ্ছেদে কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে জনসম্মুখে অথবা গোপনে, যেখানে প্রকাশ্যে বা গোপনে কর্মসম্পাদিত হয়;

যেখানে শ্রমিক তার মজুরি পান, বিশ্রাম অথবা খাবার গ্রহণ করেন অথবা শৌচাগার, পোষাক পরিবর্তনের স্থান বা ওয়াশরুম, কর্ম সংক্রান্ত ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ, সামাজিক কার্যক্রমসহ অন্যান্য আয়োজনে নিয়োজিত থাকাকালীন; কর্ম সংক্রান্ত যোগাযোগ এমনকি তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ এর ক্ষেত্র, কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত অবাসন স্থান, কর্মস্থলে আসা – যাওয়ার সময় প্রতিটি ক্ষেত্র কর্মক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সুনির্দিষ্টভাবে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানির বিষয়ে অতিত এবং সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় এই কনভেনশনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং  প্রাসঙ্গিক। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় -গার্মেন্টস সেক্টর ও বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবা সেক্টরে আইএলও কনভেনশন ১৯০ এর অনুসরনে নীতিমালা প্রণয়ন যেন সময়ের দাবিতে পরিনত হয়েছে কেননা এই দুইটি সেক্টরে নারী শ্রমিক বেশি হওয়ায় এখানে সহিংসতা ও হয়রানি অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় অনেক গুন বেশি। যদিও আইএলও কনভেশন ১৯০ কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষ উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে তথাপি নারী শ্রমিকেরা তুলনামূলকভাবে পুরুষের তুলনায় অনেক কম সুরক্ষিত হওয়ায় আইএলও কনভেনশন ১৯০  নিয়ে আলোচনাতেও স্বাভাবিকভাবেই নারীর সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধান এবং তাদেরকে আরো অধিকতর সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষে আইএলও কনভেনশন ১৯০ গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং মাইলফলকও বটে।

এই কনভেনশনটিতে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের উপর কী ধরণের আচরণ করা হলে তা সহিংসতা ও হয়রানি হিসাবে বিবেচিত হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন- এতে উল্লেখ করা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে মানসিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানিসহ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন সব আচরণ সহিংসতা বা হয়রানি হিসাবে বিবেচিত হবে। কনভেনশনটির  বাস্তবায়ন  ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্র, মালিক এবং ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক, নাগরিক সমাজ এবং শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠন সমূহ সবাইকে একযোগে সম্মিলিতভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে হবে।

এই পর্যন্ত বিশ্বের ২৫টি দেশ আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। দেশগুলো হচ্ছে –আলবেনিয়া, এন্টিগুয়া ও বারবুডা, আর্জেন্টিনা, বাহামাস, বার্বাডোস,কানাডা, সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক, ইকুয়েডর, এলসালভেদর, ফিজি, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, মরিসাস, মেক্সিকো, নামিবিয়া, নাইজেরিয়া, পানামা, পেরু, সান মেরিনো, সোমালিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, স্পেন, ইউনাইড কিংডম অফ গ্রেট ব্রিটেন ও নদার্ণ আয়ারল্যান্ড এবং উরুগুয়ে। এরমধ্যে আর্জেন্টিনা ইকুয়েডর, ফিজি, গ্রিস, ইতালি ও মরিসাসসহ ১১টি দেশে ইতিমধ্যে কার্যকারিতা শুরু হয়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ এখনো আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর করেনি।

আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সরকারী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ সমূহের বিশেষ করে সচেতনতার অভাব ও কনভেশনটির মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম না হওয়া একটি অন্যতম  প্রতিবন্ধকতা বলে আমার ধারণা।

আইএলও কনভেশন ১৯০ এর কার্যকর প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে নিম্নে উল্লেখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া খুবই জরুরিঃ

১) বাংলাদেশের প্রধান কিছু সেক্টর তথা গার্মেন্টস, বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবা সেক্টর সহ সকল কর্মক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষামূলক কর্মসূচীর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।

২) কর্মক্ষেত্রে কোন সহিংসতা বা হয়রানির মত কোন ঘটনা থাকলে তা সহজে রিপোর্ট করার মত ব্যবস্থা শ্রমিকদের জানিয়ে রাখতে হবে। শ্রমিকরা কীভাবে জানাতে পারবে তারজন্য প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। একই সাথে ভুক্তভোগী শ্রমিক বা অভিযোগকারী শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৩) শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র সহিংসতা বা হয়রানিমুক্ত রাখতে এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করতে লবি ও এডভোকেসির মাধ্যমে মালিক পক্ষকে উৎসাহিত করা।

৪) কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা বা হয়রানিমুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, শ্রম আইনের সংশোধন ও সংযোজনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে লবি, এডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারের প্রতি অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করা।

আইএলও কনভেনশন গ্রহণের মাধ্যমে জাতিসংঘ সহিংসতা বা হয়রানিমুক্ত কর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠায় এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। একথা আজ নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই কনভেনশনটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বিশ্বের উন্নত ও কল্যাণমূলক দেশগুলোর মত  বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপদ, সহিংসতা বা হয়রানিমুক্ত উন্নত পরিবেশে আত্ম সম্মান বজায় রেখে কাজ করার সুযোগ উম্মোচিত হবে। শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষ একসাথে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করলে আইএলও কনভেনশন ১৯০ কার্যকরভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সহজ হবে। এতে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত হবে এবং শ্রমিক সম্মানিতবোধ করবে যা উন্নত শিল্প সম্পর্ক তৈরি করবে এবং শিল্পের স্থায়িত্ব ও উৎপাদনশীলতা রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আইএলও কনভেনশন ১৯০ অদ্যাবধি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুস্বাক্ষর না করা দুঃখজনক। এরমাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই দ্রুত আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর করে এবং তা বাস্তবায়নে আইন প্রণয়ন করার জন্য জোরাল দাবি জানাচ্ছি।

লেখকঃ সংগঠক,বাংলাদেশ ট্রেডিউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি