বিশ্ব নারী দিবস ও একজন মালতি নকরেক-উৎপল দত্ত
পথ চলতে চলতে আমাদের অনেকের সাথে দেখা হয়, পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু ক’জনের কথা আমরা মনে রাখি বা রাখতে পারি?
পথের পরিচয় নতুন পথে চলতে গিয়ে হারিয়ে যায়। আবার নতুন নতুন মানুষের সাথে আলাপ হয়, পরিচয় হয়, তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে পারি। এটাই তো জীবন। ঠিক চলন্ত ট্রেনের মত। অনেকেই একসাথে যাত্রা শুরু করে। যাত্রা পথের স্টেশনে স্টশনে কেউ কেউ নেমে যায়। নতুন কেউ কেউ উঠে। যাত্রারম্ভের সময়কার এক বা দু’জন হয়তো শেষ স্টেশন পর্যন্ত যায়।আবার কেউ কেউ মনের গভীরে স্থান করে নেয়। ভোলা যায় না।
আজ বিশ্ব নারী দিবসের প্রাক্কালে এমন একজন নারীর কথা মনে পড়ছে যার সাথে দেখা হয়েছে মাত্র তিন চারবার। কথা হয়েছে সব মিলিয়ে পাঁচ-ছয় ঘন্টা। এত অল্প সময়ের সাক্ষাতেই আমার মনের গভীরে দাগ কেটে গেছে তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাঁর নাম মালতি নকরেক। মধুপুরের স্কুল শিক্ষিকা ।
মধুপুর গড় নামটা শুনলেই কানে বাজে শাল বনের ঝড়া পাতার মর্মর শব্দ। প্রাচীন এই বনের ব্যাপ্তি ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলায়। কালের পরিক্রমায় শাল বন আর আগের মত নাই। টুকরো টুকরো হয়ে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে। মধুপুর এখন টাঙ্গাইলের একটি উপজেলার নাম। এই উপজেলায় শাল বন দেখা যায়। কিছু লোভী মানুষের হিংস্র থাবায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে কোন ভাবে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে।
জেগে আছে নদীর বুকে জেগে উঠা চরের মত।

মধুপুর বনে শুধু শাল বৃক্ষ ও পশু-পাখী নয়- আছে কোচ ও গারো জনগোষ্ঠীর বাস। অনেকগুলো ছোট ছোট গ্রামে এরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাস করে থাকে। বনের সাথে জীবন ও জীবিকার সম্পর্ক এই জনগোষ্ঠীর। গারোদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় মান্দি।
মধুপুর শাল বন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ২০০৮-০৯ সালের দিকে আমাকে দাপ্তরিক কাজে অসংখ্যবার যেতে হয়েছিলো। প্রতি মাসে দুই-তিনবার করেই যাওয়া হত। কোন কোন সময় খুব ভোরে রওনা দিয়ে, রাত অবধি লোকজনের সাথে কথা বলে পরদিন সকালে অফিসে ফিরে আসতাম। সময়টা ছিল উত্তাল। মধুপুর শালবনে ইকো পার্ক গড়ার একটা উদ্যোগ সরকারের ছিল। এর জন্য দেয়াল তোলার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। সামরিক শাসন বিদ্যমান। এই রকম সময়ে বনের অধিবাসীদের ইকো পার্ক বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ২০০৭ সালের মার্চে সামরিক বাহিনীর নির্যাতনে মৃত্যু হয় চলেশ রিছিলের। এর আগে ২০০৪ সালে পীরেণ স্নান নিহত হয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। সব মিলিয়ে গারো আদিবাসীদের সাথে কথা বলা খুবই কঠিন।
আমি প্রতিদিন যাই । মানুষের সাথে কথা বলি। তাদের কথা শোনার এবং বুঝার চেষ্টা করি। একদিন আমার সহকর্মী সবপ্না চিসিম আমাকে বললো – দাদা, চলুন মালতি দি’র বাড়ি যাই। মালতি দি মানে মালতি নকরেক। তাঁর বাড়ি বেদুরিয়া গ্রামে। বেদুরিয়া প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক।
একহারা ছোট-খাট মধ্যবয়সী গারো মহিলা। দৃপ্ত পদক্ষেপ, চোখে-মুখে এক আশ্চর্য দৃঢ়তা। কথা বলার সময় মনে হয়, প্রতিটি শব্দ যেন কঠিন পাথরের মূর্তির মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। সেই প্রথম মালতি নকরেক এর সাথে আলাপ। প্রথম আলাপেই বললাম তোমাকে আমার দিদি ডাকতে ইচ্ছে করছে। তুমি কি বল? সে বলে, হ্যাঁ ইচ্ছে হলে দিদি ডাক। আমার ভাল লাগবে। সেই আমার মালতি দি’র সাথে প্রথম আলাপ।
যতদুর মনে পড়ে মালতি দি’র এক ছেলে ও এক মেয়ে। দু’জনেই ময়মনসিং থেকে লেখা-পড়া করে। স্বামী- স্ত্রী শুধু গ্রামে থাকেন। বনের সাথে জীবন। নিজের শিক্ষকতা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। অনেকের কাছেই শুনেছি চলেশ রিছিলের মৃত্যুর পর সব মিছিলেই সামনের সারিতে ছিলেন মালতি দি। ভয়ে কখনো পিছিয়ে যান নি। বাংলাদেশে অনেকেই যখন সামরিক বাহিনীর কাছে মাথা নত করেছিলেন। সেই সময়ে বেদুরিয়া গ্রামের একজন আদিবাসী মহিলা শৌর্যের সাথে জীবন বিপন্ন জেনেও লড়াই করেছেন । ভাবতেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।
আমি একদিন জিজ্ঞেস করলাম দিদি সবাই যে বলে তুমি মিছিল- মিটিং এ নেতৃত্ব দিয়েছ, এটা কি ঠিক। মালতি দি লজ্জা পেয়ে বললেন – গ্রামের লোক একটু বাড়িয়ে বলে। সব কথা শোনার দরকার নেই। আমি তাঁকে বলি-তুমি আমাদের কাজের সাথে থাক। তোমার মত মহিলারাই সবার মঙ্গল করতে পারে। তিনি উত্তর দেন – তোমাদের কাজটা হয় তো ভাল। কিন্তু আমি স্কুল নিয়েই ভাল আছি । অন্য কোন কাজের সাথে যুক্ত হতে চাই না। কেন জানি আমার মনে হয়- বেশি না বলা ভাল। কেউ কেউ তাঁর নিজের মত থাকাই ভাল।
স্বাধীন । নিজের মতে অবিচল।
একদিন কাজ শেষ করতে রাত হয়ে যায়। যে অতিথি শালায় থাকবো ঠিক করেছি- তা বনের ভিতরে,বেদুরিয়া গ্রামের কাছে। রাত দশটা হবে। অন্ধকার-শীতের রাত। শালবন এর মধ্য দিয়ে পথ। কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গ্রামের মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। এক্টু ভয়ে ভয়েই যাচ্ছি। এই পথে প্রায়ই ডাকাতি হয়। যাওয়ার পথেই মালতি দি’র বাড়ি।
বাড়ির কাছে এসেই মনে হল দেখা করে যাই। গাড়ি চলাচলের পথ থেকে একটু ভেতরের দিকে উনার বাড়ি। আমি বাড়ির কাছে এসে দেখলাম দু’জন মানুষ উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে পাশে বসে আছে।কাছে এসে দেখলাম মালতি দি আর তাঁর স্বামী বসে গল্প করছে। আমাকে দেখেই উনি আঁতকে উঠে বললেন- এতো রাতে তুমি? এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম মনে হল তোমার সাথে দেখা করেই যাই। উনি বললেন ভাল করনি। গতকাল রাতেই একটা বড় ডাকাতি হয়েছে। পথ টা ভাল না। এরপর মোড়া এনে বসালেন। কফি বানালেন মাটির চুলাতে। কফি খাওয়ার পর উনার ভাইকে ডেকে বললেন, তুমি সাইকেল নিয়ে উনাদের সাথে যাও। ঠিকমত পৌছে দাও। উনার ভাই আমাদের পৌছে দিয়ে তারপর ফিরে গেল বাড়ি।
এই অসাধারণ নারীর সাথে এরপর মাঝে মাঝে দেখা হত। আমার কাজ ও শেষ হয়ে যায় একসময়। আবার বের হই কাজের জন্য নতুন জায়গায়। মালতি দি’ আছেন তাঁর গ্রামের বাড়িতে । হয়তো এখনো ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। আর আমরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শহরে নারী দিবস পালন করছি। মহিলাদের কিভাবে ক্ষমতায়ন করা যায় তাই ভাবছি।