মতামত

আমার একুশ

– উৎপল দত্ত।

১। আমি তখন স্কুলের ছাত্র।  সদ্য স্বাধীন দেশ। ৭১ এর দুঃসহ স্মৃতি আমার ছোট মনেও জ্বলজ্বল করছে। মার্চের ২৫ তারিখ রাতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সেল, মৃত্যু ভয়ে শহর থেকে গ্রামে ছুটে যাওয়া, পাকিস্তানি সৈন্যের হামলার ভয়ে প্রতিদিন সকালে পাহাড়ের মধ্যে শুধু মিষ্টি আলু খেয়ে  লুকিয়ে থাকা, একদিন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ, সবকিছুই স্মৃতিতে ।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমার কাছে শীতের সময় দুটো দিন খুব আনন্দের ছিল। এই দু’ই দিন  খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কুয়াশা ভেজা উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতাম। উঠোন সাদা হয়ে যেত ঝরে পড়া শিউলি ফুলে। একটা অন্য রকম ভাল লাগা কাজ করত মনে।

আনন্দের একদিন ছিল সরস্বতী পূজার দিন।

সরস্বতী পূজা আমাদের বাড়িতেই হত। রাত জেগে পূজা মন্ডপে রঙ্গিন কাগজে সাজিয়ে স্কুলের বই খাতা দিতাম যাতে বিদ্যাদেবী আমাদের বিদ্যা দান করেন। সকালে পূজার পর লুচি-পায়েস আর দুপুরে আল ভাজা,, বেগুন ভাজা, ডালের বড়া, নিরামিস তরকারির সাথে খিচুরি ছিল একটা বিশেষ আকর্ষণ। আমরা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে  সব বন্ধুরা মিলে পুজা দেখতে যেতাম। পুজার প্রসাদ নিতাম। আমাদের স্কুলেও পুজা হত। সব ছাত্ররাই সরস্বতী পুজায় অংশ নিত।এটা ছিল সার্বজনীন উৎসব ।

আনন্দের আর একটি দিন ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারী- শহীদ দিবস।

ভোরের আলো ফুটবার আগে ঘুম থেকে উঠে সাদা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে  দিদির হাত ধরে বের হতাম। দিদির বান্ধবীদের অনেকেই সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে বাড়ি থেকে বের হতেন। মাথায় ফোটা ফোটা কুয়াশা ঝরছে, উঠোন শিউলি ফুলে সাদা আর আমরা খালি পায়ে বের হতাম সেই সকালে। চট্টগ্রাম নিউ মার্কেটের সামনে দারুল ফজল মার্কেটের নিচে ধীরে ধীরে অনেকেই এসে জড়ো হতেন। ছেলেরা সবাই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী, মেয়েরা সাদা শাড়ি পড়েই আসতেন। সেই কুসুম কুসুম ভোরে শুরু হত প্রভাত ফেরী সাথে “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি”। পুরো শহর জুড়ে শুধুই এই কলি গুলোর প্রতিধ্বনি হত।ঐ ছোট বয়সে আমাদের বুকেও। একটা ঘোরের মধ্যে লাইন ধরে প্রভাত ফেরী করে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম।

এই দু’টো দিন ছিল আমার কাছে উৎসবের দিন। সার্বজনীন উৎসব ।

২। আমার বয়স যখন একুশ, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দেশে সামরিক শাসন চলছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা, চার জাতীয় নেতাকে জেলখানার অভ্যন্তরে গুলি করে হত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যু এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সদস্যকে হত্যা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ। রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির অবাধ বিচরণ শুরু হয়ে গেছে দেশে। সংবিধান ক্ষত বিক্ষত করে ইসলামীকরণ করা  হয়েছে । মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় পদে আসীন। দেশে লুটপাটের অর্থনীতি চালু হয়েছে। গুন্ডা- মাস্তান- কালবাজারী-লুটেরা ধনীক গোষ্ঠির হাতে রাজনীতি শৃঙ্খলিত । নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ধংস। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে প্রসিডেন্ট জিয়ার ঘোষনা- ‘আই উইল মেক দা পলিটিক্স ডিফিকাল্ট’ বাস্তবায়নের চেষ্টায়রত শাসকগোষ্ঠী। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে মানুষের জীবন অতিষ্ট। সভা সমাবেশ সহ সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ।

আমাদের মত অসংখ্য তরুণের কাছে সরস্বতী পুজার আকর্ষণ সেই ছোটবেলার মত নেই।

প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড, মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল বের করে। শিক্ষানীতি বাতিল, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী সম্বলিত এই মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র -ছাত্রী অংশগ্রহণ করে। সামরিক শাসক এই মিছিলে গুলি বর্ষণ করলে জাফর জয়নাল দীপালী সাহা সহ অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। তারপরদিন ১৫ই ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গুলি বর্ষণ করে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সামরিক শাসনের বিধি নিষেধ ভেঙ্গে মিছিল এবং সমাবেশ হয় ।  চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকায় আবার পুলিশের গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। শহীদের মৃত্যু বরণ করেন বেশ কিছু ছাত্র। সরকারী প্রশাসন যন্ত্র গ্রেফতার, হুলিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন নস্যাত করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তরুণ ছাত্র সমাজের বুকের মধ্যে  আগুনের যে মশাল প্রজ্জলিত হয়েছিল তা সহজেই কি নিভিয়ে ফেলা সম্ভব ছিল ? নিশ্চয় না, এবং তার প্রতিফলন ঘটে ‘৮৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী।

বিশে ফেব্রুয়ারী গভীর রাত থেকে ছাত্র সমাজ ঢাকা চট্টগ্রাম সহ  বিভিন্ন শহরের শহীদ মিনারের কাছাকাছি এসে ফুল নিয়ে অবস্থান নেয়। আমরা যারা চট্টগ্রাম ছিলাম তারাও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে রাইফেল ক্লাবের সামনে এসে দাঁড়াই । একুশের ভোরে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম শহীদ মিনারে পুষ্প স্তবক অর্পণ করা হবে, তাই রাইফেল ক্লাবের সামনে ও সিনেমা প্যালেস এর সামনে ব্যারিকেড দিয়ে সাধারণের প্রবেশ পথ বন্ধ করে রেখেছে। আগে থেকেই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সব সংগঠনের নেতা- কর্মীরা অবস্থান নেবে। সরকারী কর্মকর্তারা ফুল নিয়ে আসার সাথে সাথে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে শ্লোগানে শ্লোগানে শহীদ মিনার এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে ব্যারিকেড ভেঙ্গে শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে । ঐ সময় সাধারণ মানুষও ছাত্রদের সাথে যোগ দেয়। সে এক বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার। একুশে ফেব্রুয়ারী আমার কাছে শুধু মাত্র শোকের রইল না।

‘৮৩’র একুশ আমার জীবনে নতুন এক মাত্রা নিয়ে আসে আর তা হচ্ছে- প্রতিবাদের, প্রতিরোধের।

৩। একুশ আমার জীবনে যেমন ঠিক একই ভাবে প্রতিটি বাঙ্গালীর জীবনেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে বাংলা ভাষার দাবীতে যে আন্দোলনের সুচনা ঘটে তা পরবর্তীতে শুধুমাত্র ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে পরিনতি লাভ করে।

১৯৪৭ সালে ধর্মীয় দ্বি জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। যদিও বাংলার  সাধারণ মানুষ বিশেষ করে কৃষক -শ্রমিক মেহনতি মানুষ এই দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে তাদের নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছে। মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশও ধর্মভিত্তিক নতুন দেশে খুঁজে পেতে চেয়েছে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের পথ। সংখ্যায় ছোট হলেও মধ্যবিত্তের আর একটি  অংশ বুঝতে পেরেছিল, এই ভাবে পাওয়া নতুন দেশ বিশেষ করে ধর্মের ভিত্তিতে একটি দেশ কখনো মানুষের মুক্তি দিতে পারে না। এই অংশটি ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর গড়ে উঠা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার যে আন্দোলন তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

দেশভাগের আগে থেকে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও ১৯৪৭ সালেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কি হবে তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা সমস্যা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা কি হবে এই প্রসঙ্গে বাংলাকেই অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন (সূত্র পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, লেখক বদরুদ্দীন উমর) । এই প্রসঙ্গে তমদ্দুন মজলিশের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তমদ্দুন মজলিশ ‘ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ‘ নামে ১৯৪৭ সালের এক প্রকাশনায় পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা, আদালতের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পক্ষে তাদের মত ব্যক্ত করেন। এছাড়া তৎকালীন পূর্ব বাংলার মন্ত্রী হাবিবুল্লা বাহার ও আব্দুল হামিদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে পূর্বে অনুষ্ঠিত করাচীর শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত  সাংবাদিক সম্মেলনে জানালে, এর প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে প্রথম সমাবেশ হয়।

এইসব ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্থান রাষ্ট্রের প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর যে মোহ তৈরী হয়েছিল তা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে বামপন্থীদের উদ্যোগে গণতান্ত্রিক যুবলীগ এর জন্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল নিঃসন্দেহে । এই বছরের (১৯৪৭)  অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

পাকিস্তানের কোন প্রদেশেই উর্দু’র প্রচলন না থাকার পরও পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্টী উর্দু ও ইংরেজীকে গণ পরিষদের সমস্ত জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টা ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাত্র সমাজ বুঝতে পারে এবং বিরোধীতা করতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী শুরু হওয়া গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে একটি প্রস্তাব উত্তাপন করেন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যা ঐ অধিবেশনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে। যদিও শুধুমাত্র কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন তথাপি  পাকিস্তানের গণপরিষদে উত্থাপিত বাংলাভাষার পক্ষে এটি  প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবী। উর্দু কে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে লোকজন বিভিন্ন ভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং উর্দু ভাষা কে ইসলামি ভাষা হিসাবে রুপ দেয়ার চেষ্টা করেন। গণপরিষদের এই আলোচনা ছাত্র- শিক্ষক সহ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যে উত্তজনা তৈরী করে এবং মার্চ মাসেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামের চুড়ান্ত পরিণতি দেখতে পাই ‘৫২র একুশে ফেব্রুয়ারীতে ছাত্র-জনতার বাধভাঙ্গা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মধ্যে। বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার যে আন্দোলন তার বীজ তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের গভীরেই সুপ্ত ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। ধর্মের ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্র গঠন যে  সম্ভব নয় তা  ‘৫২’র ভাষা আন্দোলনে ছাত্র- জনতার বিদ্রোহ ও শহীদের মৃত্যু বরণের মধ্য দিয়েই প্রমানিত।

নিঃসন্দেহে ১৯৪৮ -১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত হাজং বিদ্রোহ, নাচোল বিদ্রোহ, সিলেট অঞ্চলের  কৃষক বিদ্রোহ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর কাছে ধীরে-ধীরে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী বাঙ্গালীর জন্য ছিল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের।

৪।   বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্টিত করার যে আন্দোলন তা শুধু মাত্র একটি  সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। অথবা এটা শুধু মাত্র ছাত্র সমাজ ও বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনে কৃষক – শ্রমিক সহ  বাংলার আপামর জনগণ যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী’র ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তীতে সংঘটিত রাজনইতিক ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,  এই আন্দোলনের মধ্যে এমন কতগুলি বিশেষ উপাদান ছিল যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংগ্রামকে  ১৯৭১ এর  স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে বলা যায় ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভাজনের মধ্য দিয়ে তথাকথিত ‘দুই জাতির জন্য দুই দেশ’ এর যে স্বপ্ন ছিল তা ভাষার সংগ্রামে এসে ভেংগে যায় এবং এটা  একটা অবাস্তব ধারণা তা প্রতিভাত হয়। এই আন্দোলন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের সেতু তৈরী করে এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলার স্বপ্ন-বীজ বপন করে। এছাড়াও ভাষা আন্দোলন  জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায় যা বাঙ্গালী জাতি হিসাবে নিজের মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আর যে বিষয়টি  সকলের দৃৃষ্টিতে আসে তা শাষক গোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য যে পরিমান মনযোগ দিয়েছে , পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের সেই পরিমান মনযোগ তো দেয়নি বরং   দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি করেছে। এই বোধগুলো বাঙ্গালী মানসে ‘ বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, আমরা সবাই বাংগালি’ এই চেতনায় উপনীত হতে সহায়তা করেছে। এই সব কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে পরিণত হয়েছিল শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রামে। যার মূল সুর ছিল ‘মুক্তি’। এই মুক্তি হচ্ছে পরাধীনতা থেকে মুক্তি, শোষণ থেকে মুক্তি, চিত্তের মুক্তি, ভাষার মুক্তি। আর এই মুক্তির আকাংখ্যা সুপ্ত ছিল ‘৫২’ র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ। আমারা সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছি। ভাষা আন্দোলনে যে ‘মুক্তির’ স্বপ্ন বাঙ্গালী জাতি দেখেছিল, ‘৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে যার চুড়ান্ত পরিণতি, এই পঞ্চাশ বছরে আমরা কি সেই ‘মুক্তি” অর্জন করতে পেরেছি? যে বজ্র নিনাদ আমাদের কানে এখনো বাজে- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম – সেই ‘মুক্তির’ স্বপ্ন কি ধুসর হতে চলেছে?

৫। প্রকৃত পক্ষে দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই দেশের অবকাঠামোগত অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এর ধনাত্মক প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়েছে। মানুষের জীবন মানের উন্নতি ঘটেছে।

কিন্তু, যে মুক্তির আকাংখ্যা একুশের চেতনায় তা আজো অধরা রয়ে গেছে।

ভাষা ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে, চিত্ত বিত্তের কাছে, শোষিত শোষকের কাছে এখনো  শৃঙ্খলিত।

একুশ আমাদের জীবনে বারবার ফিরে আসে।

সেই কুয়াশা ভেজা ভোরের একুশ, নগ্ন পায়ে প্রভাত ফেরির একুশ, প্রতিবাদের- প্রতিরোধের একুশ।

আগামী এক একুশে আমাদের আবার শহীদ মিনারে গিয়ে শপথ নিতে হবে ‘মুক্ত’ বাংলাদেশের। দীপ্ত কন্ঠে বলতে হবে -” এসো মুক্ত করো মুক্ত কর/ অন্ধকারের এই দ্বার/ এসো শিল্পী, এসো বিশ্বকর্মা, এসো স্রষ্টা/ রস রূপ মন্ত্র দ্রষ্টা/ ছিন্ন করো, ছিন্ন কর/ বন্ধনের এ অন্ধকার।

আমার একুশ  নিশ্চয় পথ দেখাবে।

লেখকঃ সম্পাদক, প্রগতির যাত্রী