মতামত

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি সুবর্ণ জয়ন্তীতে কেমন দিন কাটাচ্ছেন?

-অধ্যাপক এম এম আকাশ

অধ্যাপক এম এম আকাশ (ফাইল ছবি)

-৬ষ্ঠ পর্ব-

ক্রমবর্ধ্মান বৈষম্যের মধ্যেও এই দুই পর্বে দারিদ্র্য হ্রাস তাহলে হলো কিভাবে? সেই ধাঁধাটির দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া না হলে এই লেখাটি শুধুই নেতিবাচক লেখায় পরিণত হবে। এই দুই পর্বে ইতিবাচক যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা নিস্নরুপ-  ক)শ্রমিকরা কৃষি-অকৃষি বহুমুখী কার্যক্রমে জড়িয়ে পরেছেন। খ)গ্রামে অকৃষি কাজের প্রচুর প্রসার ঘটেছে। গ)ফসলের বৈচিত্র্য ও কৃষি কাজেরও বৈচিত্র্য বেড়েছে। ঘ)রাস্তা-ঘাট ও শহরায়ণের শ্রমের চলিষ্ণুতা বেড়েছে। গ্রাম থেকে শহর এবং শহর থেকে বিদেশে কর্ম প্রত্যাশী শ্রমিকরা ছড়িয়ে পড়েছেন। ঙ) গ্রামে শ্রমের বাজার টাইট হওয়ায় মজুরিও কিছুটা বেড়েছে। চ)গ্রামিণ ক্ষেতমজুরদের কোন কোন পরিবারের বহু উৎস থেকে বহু ধরণের আয়ের সংস্থানও হচ্ছে।

এরশাদ আমল, খালেদা জিয়ার আমল, আওয়ামী আমল, ইত্যাদি শাসনামলের মধ্যে ঠিক কখন এই ইতিবাচক দিকগুলো বেশি উদ্ভাসিত হয়েছে, তুলনামূলক আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে এসব কারণেই শ্রমিকরা বিশেষত গ্রামিন মজুররা হয়তো আগের মতো আর হত-দরিদ্র নেই। মংগার কথাও তাই এখন শোনা যায় কম।

কিন্তু এই অগ্রগতিতে প্রচণু ধস নামে করোনাকালে। বহুদিন পর সর্বত্র আমাদের দারিদ্র্যের হার আবার হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করে। কেউ কেউ দাবি করেন আমরা এখন সম্ভবত আবার ঐ ১৯৯১ এর ৪০ শতাংশ জাতীয় দারিদ্রের হারে পৌছে গেছি। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি প্রকৃত পারিবারিক আয় কমেছে কারণ সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ২০ শতাংশ পুরানো দরিদ্রদের সংগে আরো নতুন ২০ শতাংশ নতুন দরিদ্র লোকেরা যুক্ত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। এখন তাই করোনা পরবর্তীতে আপেক্ষিক শোষণের প্রশ্ন শুরু নয়, সংসার চালানো কীভাবে, বেঁচে থাকবো কীভাবে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন শ্রমিকশ্রেণি। ১৯৭৫ থেকে উল্টো যাত্রা শুরু ২০২০ পর্যন্ত দারিদ্র্যতা কিছুটা কমলেও বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েছিল। ২০২০ এর পর আমরা এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দারিদ্র্যতাও বাড়ছে, বৈষম্যও বাড়ছে।

তৃতীয় পর্ব-২০২০ এর পর

তৃতীয় পর্বের অর্থাৎ সাম্প্রাতিক সময়ে শ্রমিকশ্রেণির সামনে চ্যালেঞ্জ?গুলি কি?

প্রথম চ্যালে? হচ্ছে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ। ধরা যাক শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা পোশাক শিল্পের একটি শ্রমিক পরিবারের দিকে তাকাই। দেখাব চেষ্টা করি বেঁচে থাকার জন্য তার কি কি দরকার হয়। সভ্য পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক প্রস্তাব হচ্ছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের শ্রমশক্তি উৎপাদন ও পুনঃউৎপাদনের খরচটাই হচ্ছে তার বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খরচ। সেটি নির্ণয় করবো কিভাবে।

প্রথমতঃএকজন প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিককে শ্রমশক্তি উৎপাদনের জন্য দরকার WHO এর পুষ্টিবিদদের মতে প্রতিদিন ২১৮৮ কিল্যেকালরি শক্তি। আন্তর্জাতিক মানদণে ২০১২ সালে ধরা হয় একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক খাবারের খরচ হওয়া উচিৎ অন্ততঃ১ ডলার। (বর্তমানে অবশ্য ১. ৯০ ডলারের কথা বলছে বিশ্বব্যাংক ।) বাংলাদেশে শ্রমিক পরিবারের সদস্য সংখ্যা হচ্ছে গড়ে ৪ জন । হিসেবে পরিবারটির মোট দৈনিক খাবার খরচে দাঁড়াবে ৪৪০.০০ টাকা। (১ ডলার সমান  ১১০ টাকা হিসাবে-৪+১১০=৪৪০) মাসিক খরচ ৪৪০+৩০=১৩২০০ টাকা।

পড়ুন:  বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি সুবর্ণ জয়ন্তীতে কেমন দিন কাটাচ্ছেন? -অধ্যাপক এম এম আকাশ

কিন্তু চারজনের এই পরিবারটিকে যদি কোন ঘরভারা করে থাকতে হয় যেখানে রান্নার জন্য একটি গ্যাস বার্ণার আছে, বিদ্যুৎ , পানি  ও পয়ঃপ্রণালির ব্যবস্থা আছেতাহলে এই খরচের সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ও পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের খরচটাও যোগ করতে হবে। একটি হিসেবে দেখা যায় চট্টগ্রামে ২৬০ বর্গফুট (২ কক্ষ বা ১ কক্ষ) থাকার জায় ২৬ বর্গফুটের টয়লেট ৪২ বর্গফুটের রান্নাঘরসহ ন্যুনতম ৩২৭ বর্গফুটের একটি বাসার ভাড়া হচ্ছে মাসিক ৬০০০ টাকা। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের জন্য ধরা হয় ২০০০ টাকা। সুতরাং শুধু থাকা ও খাওয়ার জন্য চার জনের ঐ শ্রমিক পরিবারটির লাগবে ২১ হাজার ২ শত  টাকা। (১৩২০০+৬০০০+২০০০)

আমরা যদি ধরে নেই যে, শ্রমিকদের পুত্র-কণ্যাদের শ্রমিকই হতে হবে এবং তাদের কোনো লেখাপড়ার দরকার নে। যদি ধরে নেই পরিবারটির বস্ত্র ও অন্যান্য খাদ্য বহির্ভূত খরচ, বিপদ, আপদ, অসুখ-বিসুখ-ডাক্তারের খরচ, বনোদনের খরচ ইত্যাদি সবই এই এক ডলারের মাঝেই অন্তর্ভূক্ত তাহলেও ন্যুনতম মজুরি লাগছে একুশ হাজার দুই শত টাকা।

তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে বর্তমানে একজন অপারেটর  ন্যুনতম দশ হাজার টাকা  বেতন নিয়ে বেঁচে আছেন কীভাবে? আসলে তিনি বেঁচে আছেন তিন পদ্ধতিতে –

ক) তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা কম খাচ্ছেন। (Under Consumption)

খ) তিনি একা নন, তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও (এক্ষেত্রে স্ত্রী ও শিশু সন্তান) বাইরে কাজ করছেন।

গ) তিনি নিজে ওভারটাইম খাটছেন। (আসলে Over Work)

সুতরাং মোদ্দা কথা দাঁড়াচ্ছে এই যে করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে সাধারণ শ্রমিকেরা কমবেশি অতিরিক্ত কাজ এবং আরো কম ভোগের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করছেন। আর শ্রম বাজারে পরিবার থেকে প্রেরণ করছেন অন্য সদস্যদের আরো কাজ করে আরো রোজগার করার জন্য।

চলবে  . . .

(প্রবন্ধটি বিগত ১৮ নভেমবর ‘২২ তারিখে টিইউসি চট্টগ্রাম জেলা কমিটি কর্তৃক আয়োজিত জননেতা চৌধুরী হারুনর রশীদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে পঠিত হয়েছে)

লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিভাগ