বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৮০):  শিক্ষার শিখা জ্বলে উঠুক

-বিজন সাহা

সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার পর এদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যেটা আমার খুব একটা ভাল লাগত না তা হল কন্ট্রোল সিস্টেম মানে পরীক্ষা। এখানে পরীক্ষা হত পাঁচে, দুই পেলে ফেল, তিন পাশ মার্ক, চার ধরা যায় সেকেন্ড ডিভিশন। তবে আমাদের দেশের মত ফার্স্ট, সেকেন্ড এসবের বালাই ছিল না। কেন? কে জানে? যেহেতু আমরা পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে অভ্যস্ত আর দেশে সব সময় ক্লাসের প্রথম ছিলাম এই মার্কিং-এ কেমন যেন উৎসাহ পেতাম না। তবে এটা আরেক ধরণের মনোভাব গড়ে তোলে। যদি নম্বরের কারণে আমাদের দেশ বিশেষ করে ভালো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সহযোগিতার চেয়ে প্রতিযোগিতার মনোভাব প্রবল, এখানে তেমন ছিল না। আমরা সবাই তাই নির্দ্বিধায় পরস্পরকে সাহায্য করতাম, সবাই মিলেমিশে পড়াশুনা করতাম। জানি না আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা হোস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে এরকম সহযোগিতার মনোভাব ছিল কি না। শিক্ষকগণ ছিলেন প্রচণ্ড হেল্পফুল, যেকোনো সময় যেকোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেত। দেশের মত প্রাইভেট পড়ানোর ব্যাপার ছিল না। এক কথায় যদি কেউ সত্যিকার অর্থেই শিখতে চাইত তার জন্য ছিল অঢেল সুযোগ আবার পক্ষান্তরে কেউ চাইলে ফাঁকিও দিতে পারত।

আমি ১৯৯৩ সালে পিএইচডি থিসিস ডিফেন্ড করে দুবনার জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চে যোগ দিই। মাঝে দু সেমিস্টার পড়ালেও আমার কাজ ছিল রিসার্চের সাথে জড়িত। তবে ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত পড়াতে গিয়ে দেখলাম শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে আর সেটা অন্তত আমার চোখে নেগেটিভ। অনেক দিন থেকেই দেখেছি এখানে এখন আর ন্যাচারাল সাইন্সে খুব একটা ভাল ছাত্ররা আসে না। যদি সোভিয়েত আমলে সবচেয়ে ভাল ভাল ছেলেমেয়েরা ফিজিক্স, ম্যাথেম্যাটিক্স, কেমিস্ট্রি এসব সাবজেক্টে পড়তে আসত, আজ ওরা যায় ইকনমিক্স, ফাইন্যান্স, ল এসব পড়তে। প্রায়োরিটি বদলে গেছে সেটা বোঝাই যায়। তবে এর কারণ সেই অর্থ। সোভিয়েত আমলে ন্যাচারাল সাইন্সে পড়াশুনা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের থেকে বেশি বেতন পাওয়া যেত। হয়তো এটাই ভাল ছাত্রদের এসব সাবজেক্টে আসার মূল কারণ। তবে বদলে গেছে পড়াশুনার সিস্টেম। প্রচুর ব্যুরোক্রাসি। আগে শিক্ষকরা আমাদের শুধু পড়াতেন, এখন অনেক বেশি কাগজপত্র মেইন্টেইন করতে হয়। যেমন আমাদের সময় লেকচার আর সেমিনার ক্লাস ছিল আর ছিল পরীক্ষা। এখনও এসব আছে, তবে মার্কিং ভিন্ন। আমাদের সময়  কেউ ক্লাসে না এলে সিনিয়র টিচার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেন আর ক্লাসে আসার জন্য কোন পুরস্কার দেওয়া হত না। এখন এসে দেখলাম ক্লাসে উপস্থিতির জন্য নম্বর বরাদ্দ করা আছে। প্রথম বার পরীক্ষা নিতে গিয়ে তো রীতিমত অবাক হবার পালা। তখন নিয়ম ছিল (এ নিয়ম অবশ্য শিক্ষকরা নিজেরাই করেন) উপস্থিতির জন্য ১০, ক্লাসে সক্রিয়তার জন্য ১০, দুটো ক্লাস টেস্টের জন্য পঁচিশে পঁচিশ করে ৫০ আর পরীক্ষার জন্য ৩০। আর পাশ মার্ক ৫১। ৫১ থেকে ৬০ নীচু মানের ৩, ৬১ থেকে ৬৮ উঁচু মানের ৩, ৬৯ থেকে ৮৫ পর্যন্ত ৪, ৮৬ থেকে ৯৪ নীচু মানের ৫ আর ৯৫ থেকে ১০০ – এটা উঁচু মানের ৫। হ্যাঁ, পরীক্ষা এখন ১০০ নম্বরে, ঠিক দেশের মত। ফলে মার্ক দেখে দুজনের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায়। যাহোক, প্রথম পরীক্ষা নিতে গেলে এক ছেলে বলল সে ক্লাসের কাজে ইতিমধ্যে ৫১ নম্বর পেয়েছে তাই আমি যেন ৩ দিয়ে তাকে ছেড়ে দিই। কিছুই করার ছিল না। তবে পরের বছর থেকে আমি নিজের ক্লাসে নিয়ম করলাম ক্লাসের সব কাজ হবে ৫০ আর পরীক্ষা ৫০। তাই ক্লাসের কাজ ঠিক মত করলেও সে পাশ করবে না পরীক্ষায় না বসে। উল্টোটাও সত্য। কেউ চাইলে ক্লাসে না এলেও পারে, তবে সে ক্ষেত্রে সে উঁচু মানের ৫ আশা করতে পারবে না। আগে যদি ছেলেমেয়েরা থিওরিতে বেশি আসত এখন বেশির ভাগ যায় প্রায়োগিক দিকে, বিশেষ করে প্লাজমায়। আর এরকম পরিবর্তন হচ্ছে সরকারি নীতির জন্য। সরকার চায় রেজাল্ট, প্র্যাক্টিক্যাল রেজাল্ট। থিওরি তো সেটা দেয় না। তাছাড়া আমাদের সময় ব্যাচেলর ডিগ্রি বলে কিছু ছিল না। পাঁচ বছর পড়াশুনা করে সরাসরি মাস্টার্স ডিগ্রি পেতাম। এখন ব্যাচেলর ডিগ্রি থাকায় বলতে গেলে ওদের এক বছর চলে যায় থিসিসের কাজে। তাছাড়া এখন অনেকেই ব্যাচেলর ডিগ্রি পেয়ে হয় পড়াশুনার ইতি টানে বা অন্য সাবজেক্টে চলে যায় বা চলে যায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য দেশে। এটা ছাত্রদের জন্য অনেক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিলেও শিক্ষকদের জন্য সুখকর নয়। কেননা একজন শিক্ষক তৃতীয় বর্ষের কোন ছাত্রের দায়িত্ব নিলে, বিশেষ করে সেই ছাত্র বা ছাত্রী যদি মেধাবী হয়, তাকে নিয়ে মাস্টার্স, এমনকি পরবর্তীতে পিএইচডির প্ল্যান করে। অথচ দেখা গেল ব্যাচেলর শেষ করে সে অন্য কোথাও চলে গেছে। তবে এটা ঠিক এখনও এখানে অনেক এক্সপেরিমেন্টের সুযোগ আছে। যেহেতু প্রশ্ন তৈরি করা বা পরীক্ষা নেওয়া পুরোটাই শিক্ষকের এক্তিয়ারভুক্ত তাই এটাও এঞ্জয় করা যায়। এই তো কিছুদিন আগে ওদের ক্লাস টেস্ট নেব। সবাই প্রশ্নের অপেক্ষায়। বললাম, তোমারা নিজেরা নিজেদের মত করে প্রশ্ন বেঁছে নাও। তবে জানই তো যখন উত্তর দিতে আসবে তখন কিন্তু সারা বছর যা পড়িয়েছি সব জিজ্ঞেস করব। এটা একটা ভাল এক্সপেরিমেন্ট ছিল। আমার ধারণা ছিল ওরা কঠিন কঠিন প্রশ্নগুলো রেডি করে আসবে, কিন্তু দেখা গেল অধিকাংশই সোজা প্রশ্ন বেঁছে নিয়েছে। আরও একটা জিনিস দেখলাম স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার খুব কম লোকই করতে পারে। আমার জন্য কি তখন, কি এখন শিক্ষকতা একটা বিশাল অভিজ্ঞতা, কেননা এর মধ্য দিয়ে সব সময়ই নতুন নতুন অনেক কিছু শিখছি। সত্যি বলতে কি শিক্ষকতা করতে এসে অনেক কিছুই নতুন করে শিখছি। ছাত্রজীবনে সব কিছুর পরেও পরীক্ষা একটা বড় ভূমিকা পালন করত। জ্ঞান অর্জনের কথা যতই বলি না কেন মূল কথা ছিল ভালো ভাবে পরীক্ষায় পাশ করা। এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ছে। মেকানিক্স পরীক্ষা দিতে বসেছি। প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি, দিচ্ছি ভালোই। ক্লাসে সব সময়ই সক্রিয় ছিলাম আর ছিলাম যাকে বলে টেস্ট স্টোন। যেহেতু পরীক্ষা হত মৌখিক তাই কাউকে না কাউকে প্রথমে পরীক্ষা দিতে হত। আমাকেই সে কাজটা করতে হত শিক্ষকের মুড বোঝার জন্য।  ফলে এমনকি অন্যেরা রেডি হলেও অপেক্ষা করত আমি কখন মৌখিক পরীক্ষা দেব। যাহোক প্রশ্ন পত্রের প্রশ্নের উত্তর দিলাম। পাঁচ পেতে হলে বেশ কিছু অতিরিক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেবার পর শিক্ষক বললেন – এবার শেষ প্রশ্ন, উত্তর  দিতে পারলে পাঁচ। আমাকে প্রশ্ন করলেন। উত্তর দিলাম বা বলা যায় দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভিস্কসিটি শব্দটা মনে পড়ছিল না, বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি শিওর তিনি বুঝলেন, তবুও বললেন – ঠিক এই মুহূর্তে চারের বেশি দিতে পারব না। ঠিক যে মুহূর্তে চার বসালেন, আমি বললাম ভিস্কসিটির কথা। – অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই ছিল শিক্ষকের উত্তর। যাহোক, পরে যখন হোস্টেলে ফিরে বন্ধুদের বললাম, আর বললাম, সবচেয়ে বড় কথা আমি ব্যাপারটা জানি, একজন উত্তর দিল, জানিসই যদি তবে পাঁচ পেতে অসুবিধা কোথায়? – হ্যাঁ, পরীক্ষায় নম্বর সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটা জানার চেয়ে মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে কথা বলছিলাম, যখন পরীক্ষা দিতাম তখন জানতাম শিক্ষক আমার চেয়ে ভালো জানেন, আমি একটু বললেই তিনি বুঝবেন। পরে যখন গবেষনার কাজ শুরু করলাম তখন মূল কাজ ছিল নিজে বোঝা। পড়াতে গিয়ে দেখলাম, আমার সামনে যারা বসে আছে তারা জানে না, আমি যেটা বলব সেটা বিশ্বাস করবে তাই এখানে ভুল করার অবকাশ নেই। ফলে আমার নিজেকে এমন ভাবে বুঝতে হবে আর ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে ছাত্ররা সেটা বুঝতে পারে। তাই সেদিক থেকে বলতে গেলে আমার মনে হয় প্রকৃত শিক্ষাটা হয় শিক্ষকতা করতে গিয়েই। তাছাড়া শিক্ষকতা করতে গেলে শিক্ষা ব্যবস্থাটা অনেক ভেতর থেকে দেখার সুযোগ থাকে, দেখা যায়। আর একারণেই এই লেখা। না, এটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নয়, বলা যেতে পারে ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলা আর এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার ভালো আর মন্দ দিকটা বলার চেষ্টা করা, যদিও সেটা হবে সাবজেক্টিভ।

আমরা শুরু করেছিলাম পরীক্ষা ব্যবস্থা বা কন্ট্রোল দিয়ে। আসলে দিনের শেষ কী বাবা-মা, কী ছাত্রছাত্রী আমরা সবাই মার্ক চাই। এটা অনেকটা পোশাকের মত। কথায় আছে আগে দর্শনধারী তারপর গুনবিচারী। কারণ কাজকর্ম, চাকরি বাকরি এসব পেতে মার্কশীট সামনে চলে আসে। তাই চাই বা না চাই মার্ক সিস্টেম আমাদের উপর প্রভাব ফেলে আর সে কারণে পড়াশুনা কে কেমন করবে সেটা পরীক্ষার উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে।

আমাদের ছোটবেলায় কুইজ বলে তেমন কিছু ছিল না। তবে আশির দশকে শুনেছি দেশে কুইজ সিস্টেম জোরেশোরে চালু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেটা ছিল না, স্কুলে তো নয়ই। তবে নতুন ব্যবস্থায় কুইজ চালু হয়। এই কুইজ সিস্টেমের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত যারা জিআরই বা টোয়েফল দেবার জন্য সে সময় প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রতিটি প্রশ্নের চারটে উত্তর থাকত যেখান থেকে সঠিক উত্তরটা বেছে নিতে হবে। এর ফলে ছাত্রকে টেক্সট  ভালো ভাবে জানতে হলেও বাইরের কোন চিন্তা করতে হয় না। যদিও কখনও কখনও ভাবার খোঁড়াক থাকত প্রশ্নে। এতে সে নিজ সাবজেক্ট ভালো জানলেও তার ক্রিয়েটিভিটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সোভিয়েত স্কুলে রচনা লিখতে হত আমাদের মতই, যখন শিক্ষার্থী তার সৃজনশীলতা দেখাতে পারত ঠিক যেমন করেছিলেন বনফুল গরুর রচনায়। কিন্তু বর্তমান শাসকদের সৃজনশীল মানুষের চেয়ে রোবট বেশি দরকার যারা শাসক শ্রেণির নির্ধারিত সঠিক উত্তরটা জানবে। আজ যে আমরা চারিদিকে জম্বি প্রায় মানুষ দেখি যারা কোন ঘটনার একটা নির্দিষ্ট ভার্সনে বিশ্বাস করে সেটা এই শিক্ষা ব্যবস্থার ফল। এমনকি গত  শতাব্দীর সত্তর আশির দশকে গণতন্ত্র ছিল কোন ভার্সন, কোন মতবাদ বেছে নেবার স্বাধীনতা ও অধিকার। আজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের অধিকার আছে সঠিক মতবাদ বেছে নেবার। তবে কোনটা সঠিক সেটা ঠিক করবে শাসক শ্রেণি। নিজের ইচ্ছামত বেছে নেবার স্বাধীনতা আমরা হারিয়েছি। এবং সেটা হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের উপর ভর করে – যখন প্রতিটি মানুষ দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে যে সরকার তাদের দ্বারা নির্বাচিত এবং সরকার যা কিছু করছে তা তার বা তাদের মঙ্গলের জন্যই করছে। এটাও বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ফল। হোমো স্যাপিয়েন্স – চিন্তাশীল মানুষ। কিন্তু চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে সে কি মানুষ থাকছে – সেটাই আজ প্রশ্ন। কারণ আজ বিশ্বের দেশে দেশে যেসব ঘটছে, ভোগবাদের কাছে নতি স্বীকার করে যেভাবে মানুষের নৈতিকতার স্খলন ঘটছে তাতে যখন দেখছি এসব মানুষ সবাই বিভিন্ন ডিগ্রিধারী তখন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করতেই হবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো