চলমান সংবাদ

বান্দরবানের লামার প্রত্যন্ত ম্রো পাড়ায় মধ্যরাতে কী ঘটেছে

বান্দরবানের লামা এলাকা
বান্দরবানের লামা এলাকা

বান্দরবানে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় ম্রো জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন এমন একটি গ্রামে রাতের অন্ধকারে কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন ও ভাংচুরের ঘটনার তিনদিন পরেও সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

লামা উপজেলার সরইয়ে এ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বুধবার বিকেলে।

তবে পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক এবং ঘটনাটির তদন্ত চলছে।

যদিও স্থানীয়রা বলছেন ‘আপাতদৃষ্টিতে’ স্বাভাবিক মনে হলেও হামলার শিকার পরিবারগুলো দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আছে।

তাদের অভিযোগ, পাহাড়ের ওই এলাকার জমি একটি কোম্পানিকে লিজ দেয়ার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে।

তবে এটিও সত্যি যে ওই জমি সরকারি খাস জমি এবং ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষ ওই জমিতে অনেকদিন ধরে বসবাস করলেও তারা সেটি কখনো নিজেদের নামে বন্দোবস্ত নেয়ার জন্য আবেদন করেননি।

স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন দু’পক্ষই অনমনীয় হওয়ায় পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলে পুলিশী অবস্থান জোরদার ও টহল বাড়ানো হয়েছে।

কী ঘটেছিলো সেখানে মধ্যরাতে

লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে লামার সরইয়ের খুবই প্রত্যন্ত একটি এলাকা রেংয়েনপাড়ায় প্রায় এক বছর ধরেই ম্রো পাহাড়ি গোষ্ঠী ও একটি রাবার কোম্পানির লোকজনের মধ্যে বিরোধ চলছিলো।

“এর মধ্যেই পহেলা জানুয়ারি গভীর রাতে কে বা কারা ম্রো পাড়ার তিনটি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে ও আরও তিনটি ঘর ভাংচুর করেছে। আমরা ঘটনাটির তদন্ত করছি। তবে এখন সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে,” বলছিলেন মিস্টার চৌধুরী।

জানা গেছে সেখানে দুটি গ্রামে ৩৬টির মতো ম্রো পরিবার বসবাস করেন।

তবে পাহাড়ি এলাকার প্রথা অনুযায়ী সরকারি খাস জমি হিসেবেই তারা সেখানে বসবাস করে এবং ওই জমি বন্দোবস্ত নেয়ার জন্যও তারা কখনো জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেনি।

বান্দরবানের সাংবাদিক ও লামার স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী যে জমিতে ম্রোরা বাস করেন সেই খাস জমি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছে একটি রাবার কোম্পানি।

কিন্তু ওই জমিতে ম্রোরা বাস করায় কোম্পানিটি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করতে পারছিলো না।

পাহাড়ি এলাকা
পাহাড়ি এলাকায় অনেক জায়গায় খাস জমিতে বসবাস ও চাষাবাদ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

এ পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের ডাকে একজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা বৈঠকসহ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

পাহাড়ি এলাকায় সেখানকার পাহাড়ি গোষ্ঠীগুলো খাস জমিতে বাস করে ও নিজেদের মতো করে চাষাবাদ করে। ম্রো পরিবারগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে সেখানে বসবাস করছে।

সমঝোতা বৈঠকগুলোতে ম্রো পরিবারপ্রতি তিন বা পাঁচ একর জায়গা বন্দোবস্ত দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে সমঝোতাও হয়েছিলো।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু পরিবার পিছিয়ে যাওয়াতে এগুলো কার্যকর হয়নি বলে জানিয়েছেন লামার উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তফা জামাল।

তার মতে এর আগেও দু’পক্ষের মধ্যে নানা ঘটনা ঘটেছে যেগুলো প্রশাসনের সহায়তায় তারা নিষ্পত্তি করেছেন।

সবশেষ সমঝোতা অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারের সেখান থেকে সরে যাওয়ার কথা এবং এর বিপরীতে তারা পাঁচ একর করে জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার কথা ছিলো।

কিন্তু সে সমঝোতাও টেকেনি কয়েকটি পরিবার শেষ পর্যন্ত একমত না হওয়ার কারণে। এর মধ্যেই পহেলা জানুয়ারি রাতে ম্রো পাড়ার বাড়িগুলোতে হামলার ঘটনা ঘটলো।

মোস্তফা জামাল বলছেন, তারা প্রশাসনের মাধ্যমে রাবার কোম্পানিকে জানিয়েছেন যেন তারা জমি দখলে নেয়ার চেষ্টা বা অন্য কোনো পদক্ষেপ না নেন।

“আমরা আবার বসবো। একটা সমাধান নিশ্চয়ই হবে। তবে এর সাথে স্থানীয় রাজনীতি জড়িয়ে যাওয়ার কারণেই সমঝোতা হয়েও পরে তা টিকে থাকছে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

পাহাড়ি এলাকা
পাহাড়ি এলাকায় বেশ কিছু রাবার কোম্পানিসহ নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লিজ নিয়েছে।

পাহাড়ের জমি লিজ নেয় কীভাবে

জানা গেছে পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত হেডম্যানদের সুপারিশে পাহাড়িদের মধ্যে জমি লিজ দেয়ার ব্যবস্থা করে জেলা প্রশাসন।

আবার সরকারি খাস জমি অন্য কেউ লিজ নিতে চাইলে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে হয়।

খাস জমি ব্যবস্থাপনা বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুযায়ী সরকারী খাস জমি ভূমিহীন দের দিয়ে থাকে সরকার।

সাধারণত বসতবাড়ি ও কৃষি জমি নেই কিন্তু পরিবারটি কৃষিনির্ভর এমন পরিবারকে খাস জমি দেয় সরকার।

তবে লামার সরইয়ে যে জমি নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে – সেখানে প্রায় চারশো একর জমি লিজ বা ইজারা নিয়েছে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রীজ কোম্পানি।

গত অক্টোবরে বান্দরবানে সংবাদ সম্মেলন করেছিলো ।

তবে এর আগে গত বছর মার্চে ওই এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিলো এবং এরপর থেকেই

মূলত ওই চারশো একর জমি রক্ষার আন্দোলন শুরু হয় সেখানে।

যদিও আগুন লাগার ঘটনা কারা ঘটিয়েছে সেটি এখনো জানা যায়নি।

এখন কী পরিস্থিতি

বান্দরবানের স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন পহেলা জানুয়ারির ঘটনার পরের রাতে গ্রামের মানুষ রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। হামলার শিকার বাড়িগুলো ওই অবস্থাতেই ছিলো।

নতুন করে হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় এখনও তাদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দেয়া হয়েছে।

লামার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা