চলমান সংবাদ

‘মেসি সর্বকালের সেরা’ – এই বিতর্ক কি এখনও থাকতে পারে?

 

ফিল ম্যাকনাল্টি
প্রধান ফুটবল লেখক, বিবিসি, দোহার লুসাইল স্টেডিয়াম থেকে
মেসির হাতে বিশ্বকাপ
মেসির হাতে বিশ্বকাপ

লুসাইল স্টেডিয়ামের আলো-আঁধারির মধ্যে একমাত্র দ্যুতির বিচ্ছুরণ ছিল মেসির ওপর, যখন তিনি তার অলঙ্কৃত ক্যারিয়ারের একমাত্র অধরা পুরষ্কারটি অবশেষে হাতে নেন।

আরবদের ঐতিহ্যবাহী আলখাল্লা গায়ে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন যাদুকর তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আরাধ্য পুরষ্কারটি হাতে নেয়ার আগে মধুর অপেক্ষায় দুহাত ঘষছিলেন।

অবশেষে বিশ্বকাপ ট্রফিটি যখন তিনি তুলে ধরেন, তখন স্টেডিয়ামজুড়ে শুরু হয় নানা রঙের চোখ ধাঁধানো আলোর খেলা।

মেসি তার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তার বর্ণাঢ্য সংগ্রহশালায় যে একটিমাত্র কমতি ছিল, সেটি অর্জন করলেন ইতিহাসের সবচেয়ে দর্শনীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতে।

সর্তীর্থদের সাথে মেসি
ম্যাচের ফলাফল হওয়ার পর সর্তীর্থদের সাথে মেসি

সাতটি ব্যালন ডি’অর, চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, একটি কোপা আমেরিকা, বার্সেলোনার হয়ে দশটি স্প্যানিশ লিগ শিরোপা ও প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের হয়ে জেতা একটি ফ্রেঞ্চ লিগ শিরোপার সাথে এবার বিশ্বকাপটিও রাখতে পারবেন তিনি।

আর এই বিশ্বকাপটিই নিঃসন্দেহে সবগুলোর সেরা পুরষ্কার। মেসিই যে সর্বকালের সেরা, সেই বিতর্কের মীমাংসায় তার কোটি কোটি ভক্ত এই ট্রফিটিকেই ‘প্রধান বিবেচ্য’ হিসেবে তুলে ধরবেন এখন থেকে।

খাঁটি সোনায় তৈরি প্রায় ১৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই ট্রফিটির জন্যই অসংখ্য মানুষ নিঃসন্দেহে মেসিকে সর্বকালের সেরার স্বীকৃতি দেবে – আর তাদের বিপরীতে যারা থাকবেন, তাদের নিজেদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা এখন আরো এক ধাপ কঠিন হয়ে যাবে।

প্রত্যেক প্রজন্মেই খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা হয়ে আসছে, যা তর্ক-বিতর্ককে ভিন্ন একটি মাত্রা দেয়। কিন্তু মেসি যে নিজেকে পেলে ও আরেকজন গ্রেটের কাতারে নিয়ে গেছেন – যার ছবি রবিবার লুসাইল স্টেডিয়ামে বহু আর্জেন্টাইনের হাতে থাকা ব্যানারে শোভা পাচ্ছিল – তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

মেসি
এতদিন বিশ্বকাপ বাদে পেশাদার ক্যারিয়ারে সব শিরোপাই ছিল মেসির

নিঃসন্দেহে আর্জেন্টিনার দশ নম্বর জার্সির মেসির পূর্বসূরি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে সর্বকালের সেরার তকমা দেয়ার পেছনে যৌক্তিক কারণ ছিল।

প্রধান যুক্তিটি ছিল ৩৬ বছর আগে মেক্সিকোতে হওয়া বিশ্বকাপের শিরোপাটি, যেটি মেসির এতদিন ছিল না।

সেই যুক্তিটি এখন আর প্রযোজ্য নয়।

মেসির উত্থানের গল্পটা আপনি কী দিয়ে বলা শুরু করবেন?

আর্জেন্টিনার এই বিশ্বকাপ জয়ের পেছনের ছোট ছোট গল্পগুলো আপনি কীভাবে ইতিহাসের পাতায় চিত্রিত করবেন, যেই ট্রফিটিতে চিরকাল মেসির নাম লেখা থাকবে?

দুই হাজার ছয় সালে স্বপ্নভঙ্গ থেকে রিও’র মারাকানায় ২০১৪ সালে জার্মানির কাছে পরাজয় – নিজের বিশ্বকাপ যাত্রাটার দিকে ফিরে চেয়ে মেসি নিশ্চয়ই এটা বুঝেছিলেন যে এই সম্মান সহজে ধরা দেবার নয়।

আর এই শিরোপা অর্জনের পথে মেসি ও আর্জেন্টিনাকে যেই প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা হয়তো এই অর্জনের স্বাদ আরো বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।

লুসাইল স্টেডিয়ামে পেনাল্টি থেকে আর্জেন্টিনার প্রথম গোল করেন মেসি, যার বদৌলতে তিনি বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একই আসরে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল ও ফাইনালে গোল করা ফুটবলার হন।

এরপর তিনি ডি মারিয়ার গোলে সহায়তা করেন, যার পরপরই আর্জেন্টিনার সমর্থকরা বিজয় উদযাপন শুরু করে দেন।

তবে ঐ গোলের কিছুক্ষণের মধ্যেই এমবাপের সাথে বহু প্রত্যাশিত লড়াইটা শুরু হয়।

বিশ্বকাপ হাতে নেয়ার আগ মুহূর্তে মেসি
বিশ্বকাপ হাতে নেয়ার আগ মুহূর্তে মেসি

দশ মিনিট বাকি থাকতে এমবাপে পেনাল্টি থেকে একটি গোল ফেরত দেন, যার দুই মিনিটের মধ্যেই চমৎকার ভলিতে ম্যাচে সমতা ফেরান। সে সময় স্টেডিয়ামের প্রতি কোনায় থাকা বিশাল পর্দায় মেসিকে দেখানো হচ্ছিল – তখন তার অবিশ্বাস মাখা হাসিতে কেবল একটি বার্তাই পাওয়া যাচ্ছিল, ‘আবার নয়।’

এরপর সেই মেসিই আবার আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন অতিরিক্ত সময়ে। তবে প্রায় পুরো ম্যাচ মলিন থাকা ফ্রান্সও এমবাপের পেনাল্টি থেকে ম্যাচে ফেরে।

চরম উত্তেজনার মুহূর্তে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ র‍্যান্ডাল কোলো মুয়ানির শেষ মুহূর্তের শট ঠেকিয়ে দেন।

তারপর লাউতারো মার্টেনেজও প্রায় ফাঁকা পোস্টে হেড মিস করেন।

টাইব্রেকারে গঞ্জালো মন্টিয়েল যখন জয়সূচক গোলটি করেন, তখন মেসি মাঠের মাঝে অশ্রুসিক্ত চোখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন।

তার দুহাত উঠে যায় অসীম আকাশের দিকে।

এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আকাশী নীল আর সাদার এক বাঁধভাঙা জোয়ার ঢেকে ফেলে তাকে।

এর কিছুক্ষণ পর স্টেডিয়ামে আনন্দে প্রায় উন্মত্ত আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন মেসি।

টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়, গোল্ডেন বল, পুরষ্কার পান মেসি।

উনিশশো বিরাশি সালে চালু হওয়ার পর প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার এই খেতাব জিতলেন তিনি।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে আর্জেন্টিনা দল
ছত্রিশ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা জিতলো আর্জেন্টিনা

বিশ্বকাপে এ নিয়ে আর্জেন্টিনার ২১টি গোলে ভূমিকা রাখলেন মেসি – ১৩টি গোল ও ৮টি অ্যাসিস্ট, যা যে কোনো দেশের যে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য সর্বোচ্চ।

বিশ্বকাপ ফাইনালে করা গোলগুলো তার ক্যারিয়ারের গোলের সংখ্যা নিয়ে যায় ৭৯৩’তে।

তবে যে কোনো পরিসংখ্যানের চেয়ে এদিন বড় হয়ে উঠেছিল একটি পরিসংখ্যান; মেসি এখন বিশ্বকাপ বিজয়ী।

আর এই একটি বিষয়ই হয়তো বাকি ছিল তাকে তার সমসাময়িক বা সর্বকালের সকল খেলোয়াড়দের মধ্যে অবিসংবাদিত সেরার আসনে অধিষ্ঠিত করতে।