মতামত

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি সুবর্ণ জয়ন্তীতে কেমন দিন কাটাচ্ছেন?

-অধ্যাপক এম এম আকাশ

-৩য় পর্ব-

যে অংশটি তার সঙ্গে থেকে যায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ দলের ভেতরে থেকেই পুঁজিবাদী পথেই অগ্রসর হওয়ার জন্য গোপনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানপন্থি পরাজিত শ্ত্রুদের সাথে হাত মেলায়। সেসময় একমাত্র সোভিয়েতপন্থি বামরাই অর্ধচিত্তভাবে (Half Heartedly) তাঁর সঙ্গে তখনো অনুগত হিসেবে থেকে যান। তবে তারাও পুরোপুরি খুশী ছিলেন না কারন তারা দলীয় স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা বজায় রেখে মৈত্রী জোট বা United Front গঠন করতে চেয়েছিলেন। যদিও বাকশালের অর্থনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে তাদের মৌলিক কোন দ্বিমত ছিলনা –সেটিকে তারা শ্রমিক-কৃষকের পক্ষে একটি প্রগতিশীল কর্মসূচী হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বিকল্প শক্তি তৈরি না করেই দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী ঘোষণা দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বাকশালের দ্বিতীয় বিপ্লবের ঐ ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে বাম-মধ্যদক্ষিণপন্থি সকলকে তিনি তাঁর নেতৃত্বে একটি মাত্র দল বাকশালের ভেতরে জড় করেছিলেন। এই হ-য-ব-র-ল দল দিয়ে শেষ পর্যন্ত কি হতো তা নিয়ে সোভিয়েত পন্থিদের সন্দেহ ছিল তবে আগেই বলেছি দ্বিমত সত্ত্বেও তারা তাতে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে একলা শ্ত্রুর হাতে ছেড়ে দেননি। যদিও তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। পরবর্তীতে শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তাজউদ্দীন ও তাঁর সঙ্গিদের সবাইকে শত্রুরা নির্মমভাবে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এই প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে তখন কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কেউ কেউ ভারতে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে কোন ফল হয়নি।

জনগণের এই উদাসীনতার কোন কারন ব্যাখ্যা করা যায় কি? এই সময় বাংলাদেশে শ্রমজীবীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা নানা কারনেই চরম দারিদ্রের মধ্যে পতিত হয়। যুদ্ধের এক বছরের ধ্বংসলীলার পর সে সময় বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছিল ৮২.৭ শতাংশ। (আবুল বারাকাত, ২০২২, পৃঃ-৫১ দেখুন পরিশিষ্ট-১) তাছাড়া ১৯৭৪ সালে মার্কিন খাদ্য সাহায্য যথা স্পময়ে না আসার দরুন ১৯৭৪ সালে গ্রামে-শহরে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। না খেয়ে জীর্ণ-ককালসার মানুষ খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় দরিদ্র নিম্নবিত্তরা, বিশেষভাবে গ্রামীণ মজুররা ও শ্রমিক শ্রেণি তা কিনে খেতে পারছিলেন না। অমর্ত্য সেনের দুর্ভিক্ষ তত্ত্বে একে ই বলা হয়েছে  “FEEF” (Food Exchange Entitlement Failure)। তিনি অবশ্য নতুন যে কথাটি এর সঙ্গে যোগ করেছিলেন –তা হচ্ছে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশে খোলামেলা দুর্ভিক্ষ না থাকলেও “অপ্রকাশ্য ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতা” ব্যাপকভাবে বহুদিন থাকতে পারে। বস্তুত প্রয়োজনীয় ক্যালরির অভাবে ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতায় তখন বাংলাদেশের প্রায় সকল লোকই (৮২ শতাংশ) কম-বেশি ভুগছিলেন। ১৯৭৪ সালে গ্রমীন মজুররা কর্মসংস্থানের এবং আয়ের অভাবে এবং শহরের নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবীরা খাদ্য নাগালের বাহিরে চলে যাওয়ার দরুন সেসময় দুর্ভিক্ষে নিপতিত হয়েছিল, কিন্তু এমনিতেও ক্ষুধা ছিল তাদ্র নিত্যসঙ্গী।

তবে দুর্ভিক্ষের সময় বন্যার্ত এলাকার স্কুলগুলোতে সরকার ব্যাপকভাবে লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করেন, কৃচ্ছতার নির্দেশ দেন, অগ্রাধিকারভিত্তিতে রেশন ও সর্বজনের জন্য খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। আমি নিজেও তখন ঢাকায় পগোজ স্কুলে ছাত্র ইউনিয়নের কিশোর ভলান্টিয়ার হিসাবে লঙ্গরখানায় কাজ করেছি। তবে দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে মজুদদারি, চোরাচালানি, পারমিটবাজি, লাইসেন্সবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে তখনো একটি সময় নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটায়। স্বাধীন বাংলাদেশে একটি নব্য ধনিকশ্রেণিও গড়ে ওঠে। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষমতার বৃহৎ কেন্দ্রগুলোর (ব্যাংক, বিমা, বৃহৎ শিল্প, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পানি, গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে) উপর তাদের ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব পরতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাস্তব কারনেই তাই মানুষ আশাহত হচ্ছিল, সংকটে ছটফট করছিল।

চলবে  . . .

(প্রবন্ধটি বিগত ১৮ নভেমবর ‘২২ তারিখে টিইউসি চট্টগ্রাম জেলা কমিটি কর্তৃক আয়োজিত জননেতা চৌধুরী হারুনর রশীদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে পঠিত হয়েছে)

লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিভাগ