মতামত

জাসদের আত্ম প্রকাশ: যড়যন্ত্রের তত্ব ……  তৃতীয় পর্ব: যুদ্ধত্তোর দেশে মস্কো ও চীন পন্থী কমিউনিস্টদের উত্থানের সম্ভবনা কত টুকু বাস্তব দাবী?

-অপু সরোয়ার

অপু সরোয়ার (ফাইল ছবি)

আট

লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা হটানোর অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল জাসদের উল্কা উত্থান । জাসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো ছিল শ্রুতি নির্ভর । জাসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো নিয়ে যুক্তি নির্ভর তেমন কোন লিপিবদ্ধ রূপ নেই। জাসদের বিরুদ্ধে বিপ্লব বিরোধিত অভিযোগে উঠেছিল তৎকালীন পুরোনো বামপন্থী দল গুলো থেকে। শ্রুতি নির্ভর অভিযোগ গুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বামপন্থী মননে এক প্রকার স্থায়ী হয়ে রূপ নিয়েছে শ্রুতি নির্ভর অভিযোগ । জাসদ আলোচনায় বিষয় গুলো বারবার দুষ্ট ক্ষতের মত ফিরে আসে।

জাসদের উত্থান কালে বাংলাদেশে দুই ধারার বামপন্থী দল ছিল। পিকিং ও মস্কো পন্থী। পিকিং পন্থী দল গুলো চূর্ন-বিচূর্ণ অবস্থান ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীল সময়ে পিকিং পন্থী দল গুলোর ৮টি পৃথক দল- গ্ৰুপ  ভারতে দেশান্তরী হয়ে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল। (২৫) প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের সহযোগিতা পায় নাই মুক্তিযুদ্ধে চীন পন্থীদের প্রবাসী জোট । ভারত সরকার চীন পন্থী বামপন্থিদের সন্দেহের চোখে দেখত। দেশের ভিতরে থেকে কিছু বাম পন্থীরা পৃথক ভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রতিরোধ আন্দোলন ছিল পরস্পর থেকে পৃথক। ন্যাপ-সিপিবি পৃথক ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

অপরাপর বামপন্থী দল গুলোর নেতিবাচক প্রচারণা জাসদের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকারক ছিল। জাসদ প্রধানত ছাত্র নির্ভর দল ছিল। এই প্রচারণার বিরুদ্ধে জাসদ-ছাত্রলীগ কলম ধরেছিল। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগ (বৈ: স) অপরাপর বামপন্থী দল গুলোর প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল “লাল ঝাণ্ডার ব্যবহার এবং সাম্যবাদ প্রচাররের অধিকার কেউ কখনো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হন? …………. ইতিহাস বারবার প্রমাণিত করেছে লাল ঝান্ডা ও সাম্যবাদে প্রচার কোন একটি নাম সর্বস্ব দলের একান্ত গোপনীয় বা একান্ত নিজেস্ব বস্তু নয়। লাল ঝান্ডা মেহনতি জনতার নিজেস্ব পতাকা এবং সাম্যবাদ মেহনতি জনতার একমাত্র লক্ষ্য। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কোন দল বা উপদলই সাম্যবাদের সোল্ এজেন্সির দাবিদার হতে পারে না। “ (২৬) যুদ্ধত্তোর দেশে মস্কো-পিকিং পন্থী দল গুলোর তৎকালীন রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে এই দুই ধারার উত্থানের সম্ভবনা নাকচ হয়ে যায়।

নয়

পুরো পাকিস্তান আমল (১৯৫৪ -১৯৭১ সাল ) কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৫৭ সালে ন্যাপ গঠন গঠিত হয়েছিল। এর পর থেকে ন্যাপের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি কাজ করত । আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিতর্কের প্রভাবে ন্যাপ ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায় ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ ( মোজাফ্ফর ) পিকিং পন্থী কমিউনিস্টরা ন্যাপ (ভাসানী) এর  পিঠে সওয়ার হয়েছিল। নকশাল আন্দোলনের প্রভাবে যুদ্ধ পূর্ব কালে পিকিং পন্থী কমিউনিস্টদের উপ দল গুলো ন্যাপ (ভাসানী)থেকে কর্মী সরিয়ে নেওয়ার ফলে দল হিসেবে ন্যাপ (ভাসানী) কঙ্কাল হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে কোলকাতায় মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি অফিস খোলে। কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ থেকে কর্মী সরিয়ে নিজেদের ব্যানারে নিতে শুরু করলে ন্যাপের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়, অস্থিরতার সৃষ্টি হয় । দল হিসেবে ন্যাপের মরণ ঘন্টা বেজে চলে যুদ্ধকালীন সময়ে। রুশ পন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ বাহ্যিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকলেও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধ কালীন সময়ে। ১৯৭২-১৯৭৫ সালে ন্যাপ ( মোজাফ্ফর) ও সিপিবি উভয়ই শেখ মুজিবর রহমান সরকারের সমর্থক ছিল। ক্ষমতাসীন মুজিব সরকারের পৃষ্টপোষকতায় ন্যাপ ( মোজাফ্ফর ) দলের ঐক্য ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে সামরিক শাসনামলে ন্যাপ ( মোজাফ্ফর) এ ভাঙ্গন প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তী ৬/৭ বছরের ব্যাবধানে ন্যাপ ( মোজাফ্ফর) বেশ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে নিখোঁজ হয়ে পড়ে।

ন্যাপ থেকে সিপিবির কর্মী প্রত্যাহারের অস্থিরতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে  তৎকালীন ন্যাপের কেন্দ্ৰীয় নেতা সাইফুল ইসলামের বক্তব্যে ন্যাপ কার্যালয়ে [ ১৯৭১ সালে যুদ্ধ কালীন কোলকাতা অফিস ] অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে সাথে করে পার্ক সার্কাসের পার্ক সংলগ্ন বাসায় নিয়ে গেলেন। ……অধ্যাপক সাহেব পাবনা জেলা ন্যাপ সভাপতি অমূল্য নাথ লাহিড়ীর ন্যাপ হতে কমিউনিস্ট পার্টিতে ফিরে যাওয়া সম্মন্ধে মন্তব্য করলেন। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে আমার যাতায়ত সম্মন্ধে প্রশ্ন তুললেন। (২৭) প্রসঙ্গ ক্রমে যুদ্ধকালীন সময়ে সাইফুল ইসলাম মাওলানা ভাসানীর সচিব হিসাবে কাজ করেছেন। ইসলাম পাবনা জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য  ছিলেন ১৯৭০-১৯৭১ সালে। যুদ্ধকালীন  ও যুদ্ধত্তোর সময় ছিল ন্যাপের ঘর রক্ষা আর কমিউনিস্ট পার্টির ছিল ঘর গোছানোর ব্যস্ততা।

যুদ্ধকালীন সময়ে ন্যাপকে শক্তিহীন করে সিপিবির ‘ নব জন্ম’ কতটুক রাজনৈতিক ভাবে কার্যকর ছিল তা পৃথক আলোচনার দাবী রাখে। ন্যাপ ( মোজাফ্ফর ) সর্বস্তরের সিপিবির প্রতি সমর্থন ছিল। কিন্তু দল হিসেবে ন্যাপের পৃথক অস্তিত্ব ছিল। যুদ্ধ পূর্ব কালে ন্যাপ দেশ ব্যাপী সংগঠন ছিল। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের জাতীয়  নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপরীতে ন্যাপ সারাদেশে প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা সাংগঠনিক ভিত্তির জানান দেয়। এই দুই নির্বাচনে ন্যাপ ভোট প্রাপ্তির বিচারে দ্বিতীয় প্রধান দল ছিল। ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সময়ে ন্যাপ বেশ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে ন্যাপ দেশব্যাপী প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা তুলনা মূলক ভাবে ছিল বেশ কম।   জন ভিত্তি সম্পন্ন ন্যাপ ধসিয়ে দিয়ে সিপিবি সেই মাত্রায় জন ভিত্তি সম্পন্ন সংগঠন হিসেবে দাঁড় হতে পারে নাই। সাংগঠনিক এই সংকট সিপিবি-ন্যাপের রাজনীতির বিকাশের অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে।

সিপিবি অতি দ্রুত আওয়ামীলীগ পন্থী হয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। কমিউনিস্ট পার্টি  কংগ্রেসের মত গুরুত্ব পূর্ন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন প্রধান শেখ মুজিবর রহমানকে প্রধান অতিথি করার মধ্য দিয়ে সিপিবি সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল। বর্তমান সিপিবি নেতা এম আকাশ যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থানের মূল্যায়ণ হচ্ছে  আমরা [ সিপিবিছাত্র ইউনিয়ন ] সে সময়ে আওয়ামীলীগের প্রগতিশীল ভূমিকার অতি মূল্যায়ন করেছিলাম এবং তার থেকে যে সুবিধাবাদী ঝোঁকের উদ্ভব হয়েছিল। (২৮) সিপিবির তৃতীয় কংগ্রেসে ১৯৭২ -১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগ পন্থী নীতি গ্রহণকে ” ঐক্যের সঙ্গে মিত্র দল গুলির নেতিবাচক দিক গুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে গুরুত্ব আছে , সে ক্ষেত্রে বিবেচনার ঘাটতি ছিল। এই বিবেচনা গোড়া থেকেই চলে আসছিল। “ (২৯) সিপিবির মুজিব ঘেঁষা নীতি খেসারত ছিল জন বিচ্ছিন্নতা। ১৯৭৬ সালে আত্মগোপনে  থাকা  সিপিবির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের স্ত্রীকে লেখা ব্যাক্তিগত চিঠিতে শেখ মুজিবর রহমানকে সমর্থনের খেসারতের বিষয়টি সামনে এসেছে।  মোহাম্মদ ফরহাদ লিখছেন ”  …….অধৈর্য হয়ে এমন কিছু স্লোগান দিয়ে ফেলেছে, যা হয়তো একটু লেফট। ঘটনাটা সিমিলার টু দ্যাট ইভেন্ট অব বাংলাদেশফার্স্ট জানুয়ারি সেভেনটি থ্রি। তোমাদের ভিয়েতনাম মিছিলে গুলি আর পরদিন পল্টন মাঠে স্পিচ…ফলে দ্বন্দ্ব। আমরা সামাল দিয়েছিলাম সত্য, বাট অ্যাট দা কস্ট অব সাম অ্যামাউন্ট অব পপুলারিটি অব বিএসইউ (বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন)।” (৩০)  জাসদের উত্থান যে কোন ষড়যন্ত্র নয় কিংবা লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকা হটানোর বিষয় ছিল না তা সঠিক উঠে এসেছে সিপিবি পন্থী অর্থনীতিবিদ ও লেখক নজরুল ইসলামের বিশ্লেষণে -“স্বাধীনতা -উত্তর বাংলাদেশের বাম সম্ভবনা বাস্তবায়নে মস্কো পন্থী বামের ভূমিকাই ছিল গুরুত্ব পূর্ন। …… কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ নীতি অনুসরণের কারণে এই সম্ভবনা বাস্তবায়িত হয় নাই। বামশক্তির এই ব্যর্থতাই জাসদের উত্থানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎ কারণ। একদিকে আওয়ামীলীগের দুর্বলতা অন্যদিকে বাম শক্তির দুর্বলতা , এই দুই কারণই জাসদের উত্থানকে সুগম করে। ”  (৩১)

 

তথ্যসূত্র
——-

(২৫)   পৃষ্ঠা ১০০ । স্বাধীনতা ভাসানী ভারত – সাইফুল ইসলাম। প্রকাশক বর্তমান সময়। প্রকাশ: ২০০৫ । বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি (১) কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি (২) পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (৩) কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র (৪) কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ (৫) বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার গ্ৰুপ) (৬) পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়ন (৭) ভাসানী ন্যাপ (৮) পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন।

(২৬) ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগ (বৈ: স) এর সম্মেলনে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হকের বক্তব্য। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট।

(২৭) পৃষ্ঠা ১৭৭ । স্বাধীনতা ভাসানী ভারত – সাইফুল ইসলাম। প্রকাশক বর্তমান সময়। প্রকাশ: ২০০৫ ।

(২৮) পৃষ্ঠা ১৪। আগামী দিনের বাংলাদেশ ও জাসদের রাজনীতি লেখক নজরুল ইসলাম। এম আকাশ এই বইয়ের মুখবন্ধে এই মন্তব্য করেছেন। অধ্যাপক এম আকাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চ। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য।

(২৯) পৃষ্ঠা ২৭। সিপিবির তৃতীয় কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক রিপোর্ট। সিপিবির তৃতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালের ২৪-২৮ ফেব্রুয়ারি।

(৩০) ০৯ অক্টোবর ২০২০। প্রথম আলো।   মোহাম্মদ ফরহাদের চিঠি থেকে: ‘কেউ কথা রাখেনি’- লেখক নূহ-উল-আলম লেনিন। দলত্যাগী সিপিবি নেতা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সাবেক সদস্য।

৩১) পৃষ্ঠা ৩৯। আগামীদিনের বাংলাদেশ ও জাসদের রাজনীতি। লেখক নজরুল ইসলাম।