বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৭১): যুদ্ধকালীন শিল্প ও শিল্পী

– বিজন সাহা     

 

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে তখন এদেশের অনেক শিল্পী সাহিত্যিক দেশত্যাগ করেন। এটা কতটুকু গণতন্ত্রকে ভালোবেসে বা যুদ্ধকে ঘৃণা করে আর কতটুকু ইউরোপ আমেরিকায় নিজেদের ধন সম্পদ ও বিদেশীদের চোখে নিজেদের ইমেজ রক্ষা করার জন্য সেটা ভাবার বিষয়। কারণ যেসব শিল্পী সাহিত্যিক দেশত্যাগ করেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের ইউরোপ বা আমেরিকায় বিভিন্ন রকমের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ছিল বা আছে। আর এসব লোকের প্রায় সকলেই পশ্চিমা আদর্শ, ভোগবাদী আদর্শ দ্বারা এতটাই আক্রান্ত যে নিজেদের ব্যক্তিগত আরাম আয়েশের বাইরে অন্য কিছু তারা দেখে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে রুশ দেশে এদের নিয়ে বিভিন্ন জোক তৈরি হয়েছে। যেমন এক শিল্পী দেশত্যাগ করেছে রাশিয়া প্রতিবেশীর উপর আক্রমণ করেছে এই অজুহাতে, অথচ সে গেছে ইসরাইলে যে দেশ প্রায় পশ্চাশ বছর ধরে প্রতিবেশীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এদের অধিকাংশই বিগত বছরগুলোতে রাশিয়ায় পশ্চিমা ধারার রাজনীতি, পশ্চিমা ধারার সংস্কৃতির প্রোপ্যাগান্ডা করে এসেছে। তাই বর্তমান অবস্থায় তারা যে দেশে অস্বস্তি বোধ করবে সেটা বলাই বাহুল্য। এদের অনেকের শুধু ধারণাই ছিল না, অনেকে বলেছেও যে তারাই আসল রাশিয়া, তারাই রাশিয়ার সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, তাই তারা চলে গেলে রাশিয়া চলে যাবে। আর যারা এখানে থেকে যাবে তারা আসলে চাষাভুষা অশিক্ষিত আম জনতা। এদের অনেকেই রাশিয়ার সাধারণ মানুষকে ঘৃণা করে এবং সেটা প্রকাশ্যেই বলে। তবে এদের মধ্যে যে অনেক অপ্রত্যাশিত নাম ছিল না তাও নয়। অনেকেই তাদের অভিনয়, লেখালেখি ও সমাজসেবা মূলত কাজ দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। তাই এদের চলে যাওয়া অনেককে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু সমস্যা হল, যারা চলে গেছিল তাদের অনেককেই পশ্চিমা বিশ্বে গিয়ে রাশিয়ার সমালোচনা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এর ফলে তারা শুধু বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেই নয় নিজেদের দাড় করিয়েছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধেও। কারণ এদের বেশির ভাগ যে বর্তমান সরকার বিরোধী সেটা কারোই অজানা ছিল না। তবে সরকার বিরোধী হওয়া আর দেশ বিরোধী হওয়া এক কথা নয়। যেমন ১৫ নভেম্বর যখন পোল্যান্ডে একটা রকেট পড়ে দুজন শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ হয় এবং সেটাকে রাশিয়ান রকেট বলে চালিয়ে ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার সরাসরি সংঘর্ষ লাগানোর চেষ্টা করা হয়, যেটা তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত হয়ে মানব সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হতে পারত, বাইডেন সহ ন্যাটোর নেতৃবৃন্দ যখন সেটাকে ইউক্রেন রকেট হবার সম্ভাবনার কথা বলছেন উত্তেজনা কমানোর জন্য। ঠিক সেসময়  রাশিয়া থেকে চলে যাওয়া লিবারেলরা লিখছে  “এটা রাশিয়ান রকেট। রাশিয়ান, রাশিয়ান, রাশিয়ান রকেট। মায়ের দিব্যি দিয়ে বলছি এটা রাশিয়ান রকেট। ন্যাটো নামাও। পুতিনের সমর্থকদের উপর যত দ্রুত সম্ভব বোমা ফেল। এটা রাশিয়ান, রাশিয়ান, রাশিয়ান রকেট। রুশরা কোন কিছুই ঠিক মত করতে পারে না। তারা কোথাও কোন লক্ষ্য ভেদ করতে পারে না। সত্যি বলতে কি তারা ইচ্ছে করে এটা করেছে। প্লীজ, তাদের উপর বোমা বর্ষণ কর।”  এই লোকগুলো গত ২২ বছর ধরে রাশিয়ার উপর স্যাঙ্কশন আরোপ করার জন্য আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে বিভিন্ন তালিকা দিয়েছে। তাই এদের দেশপ্রেম নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতেই পারে। তারা পুতিন বিরোধী তাতে সন্দেহ নেই, তাতে সমস্যাও নেই। কিন্তু পুতিনের বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশের জন্য দুর্যোগ ডেকে আনা মোটেই দেশপ্রেম নয়। কে জানে, তারা হয়তো লেনিনপন্থী – “যত খারাপ তত ভালো” স্লোগানে বিশ্বাসী।

তবে সবাই যে এ রকম তা কিন্তু নয়। এই যুদ্ধে সেনাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এমন শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখক, অভিনেতা, নাট্যকারদের সংখ্যাও কম নয়। এটা ঠিক যে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া আর দেশের সত্যিকারের নাগরিক হওয়া এক কথা নয়। সত্যিকার নাগরিকেরা এসবের বাইরেও অনেক কিছুই করে। যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উতেসভ, বার্নেস, রুসলানভা ও অন্যান্য শিল্পী, অভিনেতারা তাদের গান, কবিতা, নাটক নিয়ে সেনাবাহিনীর মনোবল উঁচু রাখতে সেখানে যেতেন সরকারি তত্ত্বাবধানে, এখন যারা যাচ্ছেন তারা যাচ্ছেন নিজেদের উদ্যোগে। তারা শুধু পারফর্ম করছেন না তারা নিয়ে যাচ্ছেন সাহায্য সামগ্রী নিজেদের পয়সায়, কনসার্ট থেকে পাওয়া সমস্ত টাকাপয়সা দিচ্ছেন যারা তাদের জন্য রনাঙ্গনে যুদ্ধ করছে, প্রাণ দিচ্ছে তাদের জন্য, দিচ্ছেন সেই সমস্ত মানুষদের যারা যুদ্ধের কারণে সব হারিয়েছে। আবার এদেরই এক অংশ দেশত্যাগ করেছে, দেশের, দেশের মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, করছে। বা বলা যায় ইতিহাসের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে। কারা ইতিহাসের সঠিক দিকে থাকবে সেটা ঠিক করবে যুদ্ধের ফলাফল। রাশিয়ার সাংস্কৃতিক এলিট এই যুদ্ধকে ঘিরে আজ দু’ ভাগে বিভক্ত। তবে আজ যারা দনবাসের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন আমার মনে হয় তারাই মানবতার সেবা করছেন। আর এদের সংখ্যা একেবারেই কম নয়। এদের অনেকেই শুধু ফেব্রুয়ারি থেকে নয় সেই ২০১৪ সালে যখন দনবাসের উপর নেমে আসে ইউক্রেন সেনা বিশেষ করে ফ্যাসিবাদী বিভিন্ন গ্রুপের খড়গ তখন থেকে এসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছেন, বিভিন্ন সময় তারা চেষ্টা করেছেন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। কেন এরা এমন করেন? কারণ সত্যিকারের লেখক, কবি, শিল্পী যারা তারা রাজনৈতিক হিসাব করেন না, তারা মানুষের কষ্ট অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেন আর তাই আসন্ন বিপদ আগে থেকেই টের পান। আমাদের দেশেও এমনটা হয়েছে। জর্জ হ্যারিসন, রবি শঙ্কর, রজারস ওয়াটার্স, ঋত্বিক ঘটক থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জগতের অসংখ্য মানুষ এ কারণেই বার বার রাজনীতিবিদদের, মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

অনেক জনপ্রিয় শিল্পী যাদের অনেকেই রোল মডেল হিসেবে দেখত তারা যখন দেশের এই সংকটজনক সময় দেশত্যাগ করে চলে যায় স্বাভাবিক ভাবেই তারা নিজেদের শুধু রাষ্ট্রের নয়, সাধারণ মানুষের চোখেও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তুলে ধরে। নব্বুইয়ের দশকের এক জনপ্রিয় অভিনেতা ছিল সেরগেই বাদ্রভ। ব্রাত বা ভাই নামে এক সিনেমায় অভিনয় করে প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়া তার জীবন দর্শন অনেককেই আকৃষ্ট করত। খুব অল্প বয়সে তুষার ধ্বসে মারা যায় একটা সিনেমার অভিনয় করতে গিয়ে ককেসাস পাহাড়ে, যে ছবির পরিচালক ছিল সে নিজে। তার একটা কথা যা এখন অনেকের মুখেই শুনি «তোমার দেশ যখন যুদ্ধে রত তখন একটাই কাজ – যুদ্ধ করা, জয়ের জন্য সব কিছু করা। পরে দেখা যাবে কে দোষী আর কে নয়। » আসলেও তাই। ঘরে যখন আগুন লাগে তখন কে আগুন লাগালো বা কেন আগুন লাগল সেটা নিয়ে বিতর্ক করার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আগুন নেভানো। যখন আগুন নেভানো শেষ তখন দেখা যাবে আগুন কে লাগিয়েছে আর কেন লাগিয়েছে। যতক্ষণ আগুন জ্বলছে – এসব প্রশ্ন গঠনমূলক তো নয়ই বরং আত্মঘাতী। উল্লেখ করা যেতে পারে যে যারা এই যুদ্ধের কারণে দেশত্যাগ করে বিদেশে যাচ্ছে, বিশেষ করে পাবলিক ফিগার, তারা সবাই যে ভালো আছে তা কিন্তু নয়। যা কিছু রুশ সবই কমবেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বে। তা সে শিল্প, সাহিত্য, গান, কবিতা, খেলাধুলা যাই হোক। এমনকি পুশকিন, তলস্তয়, দস্তইয়েফস্কি, চেখভ যারা শুধু রাশিয়া বা ইউরোপের নন, বিশ্ব সাহিত্যের পুরোধা তাদের পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় কী আশা করতে পারে নব্য ইমিগ্রান্টরা? অনেককেই বার বার রাশিয়ার (পুতিন নয়, রাশিয়া) সমালোচনা করে নিজেদের ইউরোপ প্রীতি প্রমাণ করতে হচ্ছে। এইতো পোল্যান্ডে লিটল বিগ নামে এক রুশ গ্রুপের কনসার্ট বাতিল করা হল যেসব ইউক্রেনের জনগণ আজ সেখানে আছে তাদের প্রতিবাদে। কারণ শুধু দেশত্যাগ করা বা যুদ্ধবিরোধী গান গাওয়াই যথেষ্ট নয়, ইউক্রেনের সেনাদের জন্য ডোনেশন দরকার। উল্লেখ করা যেতে পারে যে অনেক রুশ যারা দেশত্যাগ করেছে তারা ইউক্রেনের সেনাদের জন্য ডোনেট করছে আর এটা করছে সেই ইউক্রেন সেনাদের জন্য যারা অনেক ক্ষেত্রে হিটলারের বাহিনীকেও যে ছাড়িয়ে গেছে আর সেটা তাদের নিজেদের ভিডিও দিয়েই প্রমাণ করছে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও এ নিয়ে আলচনা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন – যদি যুদ্ধের বিরোধিতা করেই দেশত্যাগ কর তাহলে অন্য পক্ষকে যুদ্ধের জন্য অর্থ সাহায্য করা – সেটা কি শান্তির জন্য?

“তোমরা যাদের মানুষ বল না, বিধিও তাদের কান্না শোনে না” অথবা “তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়”
ছোটবেলায় এসব গান শুনতে শুনতে বড় হতে থাকি আমি। এরপর একাত্তরের সেই সব কালজয়ী গান – “জয়  বাংলার বাংলার জয়”, “শোন একটি মুজিবরের চেয়েও লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ” বা “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে” আরও কত গান। কিন্তু যুদ্ধের পর পর “সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা” জাতীয় (আমি ভালো বা মন্দ বলছি না) গান শুনে প্রায়ই মনে হত কেন এখন সেই রকম গান তৈরি হয় না। এটা হয়তো এ কারণে যে দেশে ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর বা মস্কো এসে ছাত্র সংগঠনের সাংস্কৃতিক দলে মূলত দেশাত্মবধক গান ও গণ সঙ্গীত গাইতাম। এছাড়া যখন রুশ গান শুনতে ও বুঝতে শুরু করলাম, দেখলাম যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধ বিষয়ক গান বা সাহিত্যের যে আবেদন নতুন সাহিত্যে সেটা নেই। “মানুষের মত মানুষ”, “মানুষের ভাগ্য”, “বেঁচে থেকো ও মনে রেখো” ইত্যাদি লেখায় মানব চরিত্র যেভাবে ফুটে উঠেছে আধুনিক লেখায় তেমন নয়। বিশেষ করে নতুন যেসব গান লেখা হচ্ছে সেখানে কথাটা যেন গৌণ হয়ে যাচ্ছে, অথচ সোভিয়েত আমলের অনেক লেখায় কথাই ছিল আসল। কেন এখন “কাতিউশা”র মত গান আর তৈরি হচ্ছে না। তার মানে কি শুধুমাত্র যুদ্ধের সময়ই এরকম গান, কবিতা, সাহিত্য তৈরি হয়? আসলে যুদ্ধ বা কঠিন বাস্তবতা মানুষকে একেবারে ভিন্ন দিক থেকে জীবনটা দেখায়। সে অন্য ভাবে জীবনকে মূল্যায়ন করতে শেখে। নতুন করে জীবনের গান গাইতে শেখে। এ নিয়ে আমরা কথা বলব আগামী পর্বে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো