চলমান সংবাদ

গুজরাটে মুসলমানদের কথা বলা মানেই কি ভোটে পরাজয়?

২০০২ এর দাঙ্গার বছরেই বিপুল ভোটে জিতে ৫ বছরের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী
২০০২ এর দাঙ্গার বছরেই বিপুল ভোটে জিতে ৫ বছরের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী

 দুই দশক আগে দাঙ্গার বছরেই বিধানসভার ভোটে বিপুলভাবে জিতে প্রথমবার পুরো পাঁচ বছরের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি ভুলে যেতে চায় সেই ইতিহাস? কেন তারা দাঙ্গার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়?

দাঙ্গার পরের নির্বাচনে মুসলমান প্রধান এলাকায় প্রচারেও যায়নি কংগ্রেস প্রার্থীরা।

যেসব এলাকায় দাঙ্গা বেশি হয়েছিল, সেখানেই বেশি আসন পেয়েছিল বিজেপি।

২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার খন্ডচিত্র
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার খন্ডচিত্র

চাকরির বিজ্ঞাপনে উচ্চবর্ণের অগ্রাধিকার

দুই হাজার ষোল সালের ৬ এপ্রিল সাফাই কর্মী নিয়োগের একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল।

আহমেদাবাদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিউমান ডেভেলপমেন্ট এন্ড রিসার্চ সেন্টারের দেওয়া ওই বিজ্ঞাপনটায় কয়েকটা শর্ত ছিল: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বানিয়া, প্যাটেল আর জৈন সম্প্রদায়ের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিজ্ঞাপনের শেষে সই করেছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির পরিচালক প্রসাদ চাকো।

সাফাইকর্মী নিয়োগের ওই বিজ্ঞাপনটা ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল, কারণ তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের সেখানে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা লেখা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপনটা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির দপ্তরে হামলাও হয়েছিল।

যারা সেই হামলা চালিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কিছু দক্ষিণপন্থী সংগঠন যেমন ছিল, তেমনই সেদিন হাজির হয়েছিলেন কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন এন এস ইউ আইয়ের কর্মী সমর্থকরাও।

পরিচালক প্রসাদ চাকোকে আত্মগোপন করতে হয়েছিল ওই বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য।

মি. চাকোর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি ওই বিজ্ঞাপনটা কেন ছেপেছিলেন।

তার কথায়, “আমার কাছে পুরো বিষয়টা খুব পরিষ্কার ছিল। উচ্চবর্ণের মানুষরা তো সংরক্ষণের বিরোধিতা করে থাকেন। তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম, যে কাজটা প্রাচীন কাল থেকে দলিত শ্রেণীর মানুষরাই করে আসছেন, সেরকম একটা কাজের জন্য উচ্চবর্ণের লোকেদের নিয়োগ করার প্রশ্নে কীরকম প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়াটা তো দেখাই গেল।”

গুজরাট দাঙ্গায় নিহত কংগ্রেস এম পি এহসান জাফরি। তবে কংগ্রেস ওই দাঙ্গার প্রসঙ্গ এখন আর তোলে না
গুজরাট দাঙ্গায় নিহত কংগ্রেস এম পি এহসান জাফরির (ডানদিক থেকে দ্বিতীয়) ফাইল ছবি। তবে কংগ্রেস ওই দাঙ্গার প্রসঙ্গ এখন আর তোলে না

‘কংগ্রেসে সাম্প্রদায়িক মানুষ মিশে আছে’

“পি সি চাকোর ওই পরীক্ষাটা খুবই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। উচ্চবর্ণের মানুষদের চিন্তাভাবনা একেবারে প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল,” বলছিলেন আহমেদাবাদের সিনিয়র সাংবাদিক রাজীব শাহ।

“মি. চাকোর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে এনএসইউআই-এর ছাত্রদের হামলা চালানোর মাধ্যমে বোঝা গিয়েছিল যে গুজরাটের কংগ্রেস দলের মধ্যে কীভাবে জাতিয়তাবাদী আর সাম্প্রদায়িক ভাবনার উচ্চবর্ণের মানুষ মিশে আছে। ২০০২ সালের দাঙ্গার পর থেকেই গুজরাটের ভোটে কংগ্রেস যে কীভাবে ভয়ে ভয়ে বিজেপির মোকাবিলা করে, সেটা তো দেখাই গেছে। হিন্দুত্ব এবং সংখ্যাগুরুত্বর যে রাজনীতি বিজেপি করে তার সরাসরি বিরোধিতা করতে কংগ্রেস আসলে ভয় পায়,” বলছিলেন মি. শাহ।

তার কথায়, কংগ্রেস মনে করে যে তারা যদি ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আনে, তাহলে ভোটের সময়ে দলের ক্ষতিই হবে।

গুজরাট, ২০০২। ফাইল চিত্র
গুজরাট, ২০০২ – ফাইল চিত্র

দাঙ্গার বছরের কথা তুললে কি হিন্দুরা ভয় পায়?

এটা কতটা সত্যি যে ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ যদি কংগ্রেস তোলে তাহলে গুজরাটের হিন্দুরা আতঙ্কিত হয়ে বিজেপির পক্ষে এককাট্টা হয়ে যাবে?

রাজীব শাহের কথায়, “কংগ্রেসের এই ভয়টা পাওয়া যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। আমার নিজেরও মনে হয় যে গুজরাটের শহুরে মধ্যবিত্ত হিন্দুরা ২০০২ সালের দাঙ্গা নিয়ে প্রত্যয়ী। এই অবস্থায় কংগ্রেস যদি দাঙ্গার বিরোধিতা করতে যায়, তাহলে মধ্যবিত্তরা আরও বেশি করে বিজেপির দিকে চলে যেতে পারে। কিন্তু এটাও সত্যি যে কংগ্রেস এই নীতি নিয়ে চললে বিজেপিকে হারাতে পারবে না কখনই। বিজেপিকে হারাতে হলে তার সঙ্গে সরাসরি টক্কর দিতে হবে।”

দুই হাজার দুই সালেই ডিসেম্বরে গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল।

যেসব এলাকায় দাঙ্গা সবথেকে বেশি হয়েছিল, সেরকম ৬৫ টা আসনের মধ্যে ৫৩টাতেই জিতেছিল বিজেপি।

গুজরাট দাঙ্গার আগে গোধরায় ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়, যাতে ৫৯ জন হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক নিহত হন। ফাইল চিত্র
গুজরাট দাঙ্গার আগে গোধরায় ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়, যাতে ৫৯ জন হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক নিহত হন – ফাইল চিত্র

‘বিজেপি ভেদাভেদের রাজনীতি করে না’

গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপির সিনিয়র নেতা নীতিন প্যাটেল বলছেন, “২০০২ সালের গুজরাটে যে দাঙ্গার কথা যারা বলেন, তারা এটা ভুলে যান যে গোধরায় কী হয়েছিল। কংগ্রেস রাজত্বেই সব থেকে বেশি দাঙ্গা হয়েছে আর বিজেপি আসার পরে তো পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা তুষ্টিকরণের রাজনীতি করি না।”

এই প্রসঙ্গে বিজেপির অবস্থান যে এরকমই হবে, তা আন্দাজ করা কঠিন ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস কেন এরকম অবস্থান নিয়েছে গুজরাটে?

আহমেদাবাদের সেন্টার ফর সোশ্যাল নলেজ এন্ড অ্যাকশানের পরিচালক ও সমাজবিজ্ঞানী অচ্যুত ইয়াগনিক বলছেন, “কংগ্রেস শিবির মনে করে যে ওই প্রসঙ্গে যদি কিছু না বলা যায়, তাহলেই তাদের বেশি সংখ্যক ভোট দিয়ে যাবে মানুষ। তাই এরকম একটা নীতি নিয়েছে তারা যে দাঙ্গা নিয়ে কিছু বলবেই না তারা।”

দুই হাজার দুই সালের বিধানসভা ভোটে শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়ার পরে সোনিয়া গান্ধীর কাছে একটা রিপোর্ট দিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা।

মি. ইয়াগনিক বলছেন, “ওই রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, যেসব আসনে ২৫ হাজারের বেশি মুসলমান ভোটার আছেন, সেইসব আসনেই কংগ্রেস হেরেছে। কংগ্রেস প্রার্থীরা মুসলমান এলাকায় প্রচার পর্যন্ত করতে যাননি। পার্টি একটা অনুচ্চ হিন্দুত্বের লাইন নিয়েছিল, তবে সেটা কিন্তু রাজ্যে কংগ্রেসকে শক্তি যোগাতে পারেনি। গুজরাটে হিন্দুত্বের জবাব হিন্দুবিরোধী রাজনীতি দিয়েই করতে হবে। তাদের সেই প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি।”

দাঙ্গার সময়ে চলছে পুলিশ পাহারা, তবে কংগ্রেস ভুলতে চায় ওই দাঙ্গার কথা
দাঙ্গার সময়ে চলছে পুলিশ পাহারা, তবে কংগ্রেস ভুলতে চায় ওই দাঙ্গার কথা

কংগ্রেস ভুলতে চায় দাঙ্গার কথা?

রাজস্থানের প্রাক্তন মন্ত্রী রঘু শর্মাকে কংগ্রেস এবারের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছে।

তিনি বলছেন, “আমরা অতীতের দিকে তাকাতে চাই না। দুই হাজার দুই সালের দাঙ্গা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে। এবারে উন্নয়ন নিয়ে কথা হোক। প্রশ্ন উঠুক এখানকার বেকারত্ব, গরিবি আর শিক্ষা নিয়ে।”

রাহুল গান্ধী যেখানে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে সরাসরি আক্রমণের পথে হাঁটেন, সেখানে গুজরাটে কংগ্রেস তা থেকে বিরত থাকে?

এই প্রশ্নে মি. শর্মা বেশ রেগে গেলেন।

বললেন, “রাহুল গান্ধী হিন্দুত্ব বা হিন্দুদের বিরোধী নন। আপনারা বরং নিজেদের এজেন্ডা থেকে বেরিয়ে আসুন। আমরা হিন্দু ধর্মের বিরোধী নই। আপনি আমাকে এধরণের প্রশ্ন করে বিপদে ফেলতে চাইছেন।”

সমাজবিজ্ঞানী অচ্যুত ইয়াগনিক বলছেন, “কংগ্রেস নেতাদের তো আগে তাত্ত্বিক জ্ঞান বৃদ্ধি দরকার। কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতা তো এটাই বোঝেন না যে হিন্দুত্ব আর হিন্দু ধর্ম এক ব্যাপার নয়।”

ভোটে বিজেপি মুসলমানদের প্রার্থী করে না, যদিও রাজ্যে ১০ শতাংশ বাসিন্দা মুসলমান। আর এর মোকাবিলায় কংগ্রেসও মুসলমানদের প্রার্থী করা কমিয়ে দিয়েছে।

দাঙ্গা বিধ্বস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধী। ফাইল চিত্র
দাঙ্গা বিধ্বস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী – ফাইল চিত্র

কংগ্রেস কত টিকিট দেবে মুসলমানদের?

গত বিধানসভা ভোটে তারা মাত্র ছয়জন মুসলমানকে প্রার্থী করেছিল, যার মধ্যে তিনজন জয়ী হয়েছিলেন।

দরিয়াপুর আসনের কংগ্রেস বিধায়ক গিয়াসুদ্দিন শেখ সম্প্রতি দাবী করেছেন যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমানদের অন্তত ১৮ টা টিকিট পাওয়া উচিত, কিন্তু যদি এতটা না দিতে পারে দল, তাহলে অন্তত ১০-১১ টা টিকিট দেওয়া হোক।

এই প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা রঘু শর্মা বলছিলেন, “দল তাদেরকেই টিকিট দেয়, যাদের জেতার সম্ভাবনা আছে।

শুধু মুসলমানদের টিকিট না দেওয়া বা ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ উত্থাপন না করাতেই যে কংগ্রেসের নীতি সীমাবদ্ধ থাকছে, তা নয়।

সম্প্রতি নবরাত্রিতে গরবা নাচের অনুষ্ঠানে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগে কয়েকজন মুসলমান যুবককে যেভাবে রাস্তায় বেঁধে পেটানো হয়েছে, তা নিয়েও কংগ্রেস কোনও কথা বলেনি।

তবে গিয়াসুদ্দিন শেখ এবং আরেক কংগ্রেস বিধায়ক ইমরান খেড়াওয়ালা ওই ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।

খেড়াওয়ালা মন্তব্য করেছিলেন যে, ওই ঘটনায় দল চুপ থাকায় সংখ্যালঘুদের কপালে কংগ্রেসকে নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

দাঙ্গার সময়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল আহমেদাবাদের এই মুসলমান আবাসনটি
দাঙ্গার সময়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল আহমেদাবাদের এই মুসলমান আবাসনটি

মুসলমানদের নিয়ে কথা বলা কি পাপ?

ভাদোদরার সামাজিক কর্মকর্তা জুবেইর গোপলানী মনে করেন যে, গুজরাতে মুসলমানদের নিয়ে আলোচনা করাটা যেন একটা পাপ কাজ।

“বিজেপির কাছ থেকে তো কিছু আশাই করা যায় না। ভোটে জেতার জন্য মুসলমানদের প্রতি ঘৃণাটাই বিজেপির দরকার। কিন্তু আমরা কংগ্রেসের কাছে আশা করতাম যে তারা ওই ঘৃণার চূড়ান্ত বিরোধিতা করবে। তবে তারা হয়তো মনে করে যে সেরকম কোনও পদক্ষেপ নিলে তারা ভোটে হারবে। কংগ্রেস ২০০২ এর দাঙ্গার কথা কি ভুলিয়ে দিতে চায়, নাকি জেনে বুঝেই তারা স্মরণ করতে চায় না সেই সময়টা!”

“রাহুল গান্ধী আশা দেখান। হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণে যান তিনি, কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস পুরোপুরি বিপরীত অবস্থান নিয়ে চলে। রাহুল গান্ধীকে তো আমার মনে হয় সোনিয়া বা রাজীব গান্ধীর থেকেও অনেক বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। সেজন্যই হয়তো সংবাদমাধ্যমের একাংশে তাকে ‘পাপ্পু’ বলে মশকরা করা হয়।”

দুই হাজার দুই সালের দাঙ্গা নিয়ে শুধু যে কংগ্রেস নিশ্চুপ থাকে তা নয়।

ওই রাজ্যে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে চাইছে যে আম আদমি পার্টি, তারাও কিন্তু বিলকিস বানোর গণধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া নিয়ে কোনও কথা বলেনি।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা