মতামত

জাসদ রাজনীতির ৫০বছর: ১৯৭২ – ২০২২(শেষ পর্ব)

– অপু সারোয়ার

জাসদের  সৃষ্টি যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনা ও সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আখাঙ্খা থাকে । স্বাধীনতা আন্দোলনের পর আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা লাভ করেছি  এবং উৎখাত করেছি পাকিস্থানী ঔপনিবেশিক শাসক বর্গ এবং তাদের বংশবদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল সমূহকে কিন্ত স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের শূন্য স্থান পূরণ করেছে নয়া উপনিবেশবাদী শক্তি সমূহ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশীয় উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণী, শিল্প প্রশাসক গোষ্ঠী, জোতদার মহাজন, অসৎ ব্যবসায়ী মহল , সুবিধাবাদী রাজনৈতিক টাউট অতি অভিলাষী সামরিক আধাসামরিক চক্র বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে সকল সাম্রাজ্যবাদী , নয়া উপনিবেশবাদী দেশীয় শোষক সম্প্রদায় বাংলাদেশের মেহনতী মানুষকে শোষণ করছে বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে শোষনের একটি কেন্দ্রবিন্দু(১৬)  জাসদ একটা ঐতিহাসিক সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেছিল।  বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের  আন্দোলন হটাৎ  করে গাছ থেকে পড়েনি। যুদ্ধ পূর্ব কালে সীমাবদ্ধতা নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে এই ধারার চর্চা ছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে এই চর্চা সংকট ও সীমাবদ্ধতায় চলমান ছিল।(১৭)  মুক্তিযুদ্ধের পর এই ধারা জাসদে সামিল হয়।  মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লবাকাঙ্খীদের ঐকান্তিক চেষ্টা, ধনুর্ভঙ্গ পণ থেকে নিঃশর্ত আত্মত্যাগ জাসদের পাথেয় ছিল। জাসদের জন্ম যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে ইতিহাসের  বিভাজন–রেখা। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ–সংস্কৃতি  জাসদের উত্থান –অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা – ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার  আগে যেমনটি ছিল পরে আর তেমনটি থাকেনি। দল হিসেবে জাসদ নিঃস্ব হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে জাসদ রাজনীতি বারবার ফিরে আসে।

যুদ্ধত্তোর কালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা শেখ মুজিবর রহমানের রাজনীতির সাথে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টা সফল হয় নাই। রাজনৈতিক ভাবে সফল হওয়া কোন সম্ভবনা ছিল না। এমন একটি উদ্দ্যোগের হদিস পাওয়া যায় জাসদ আত্ম প্রকাশের পূর্বের গণকণ্ঠে। (১৮ ) ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক ভাঙ্গনের পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ – ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ দুইটি পৃথক প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। (১৯) নির্বাচনে ছাত্রলীগের দুই গ্ৰুপের ভরাডুবি ঘটে। ছাত্রলীগ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী গ্ৰুপ নিবার্চনে যৎসামান্য অর্জন নিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে গণভবনে দেখা করেন। শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় ছাত্রলীগ ( বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) বঙ্গভবনের করিডোরে  ‘ সর্বহারার অপর নাম শেখ মুজিবর রহমান / শেখ মুজিবের মন্ত্র – সমাজতন্ত্র / এবারের বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব / শ্রেণী শত্রু খতম কর /  প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন। এই মিটিংয়ে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন – আ স ম রব , শাহজাহান সিরাজ , আ ফ ম মাহবুবুল হক প্রমুখ ।গণকণ্ঠের একই রিপোর্টে তৎকালীন ছাত্র লীগের ( বৈ : স ) এর সাথে শেখ মুজিবর রহমানের  সহ সম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হকের সাথে শেখ মুজিবের আলাপচারিতা অনাগত সংকটের অভ্যাস দেয়।  আমরা মুজিববাদের বিরোধী নই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিবার্চনকে  [ ডাকসু ১৯৭২ ] কেন্দ্র করে একদল লোক মুজিববাদের নামে যে মতবাদ প্রচার করেছে তা পুজিঁবাদেরই নামান্তর আমরা এই মতবাদের বিরোধিতা করি আমরা মনে করি মার্ক্সবাদের ভিত্তিতে শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লব সামনের মাধ্যমে এদেশে শোষণহীনশ্রেণীহীন সমাজ কায়েম করা সম্ভব …..বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পরিবেশ , মানুষের মানসিকতা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণী সংগ্রাম সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে তত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাই মার্ক্সবাদমুজিববাদ নামে পরিচিত হবে  (২০)  ১৯৭১/৭২ সালে মুজিববাদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য গ্রহণযোগ্য যুক্তি দাঁড় করানোর অসফল চেষ্টা করেছেন জাসদ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম আ ফ ম মাহবুবুল হকতখনকার [ ১৯৭১] স্লোগান ছিলমুজিববাদ, যার ব্যাখ্যা ছিল রকম -‘ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে শ্রমিক রাজ্কৃষকরাজ প্রতিষ্ঠায় হবে মুজিববাদএই বক্তব্যে কিছু অসুম্পর্ণতা থাকলেও তখনকার বাস্তবতায় এই বক্তব্য যুক্তি যুক্ত ছিল(২১)

জাসদের তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বর্ণনা করেছেন “রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই নিজেদের তারা সমাজতন্ত্রী বলত, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তাদের প্রধান নেতাদের সমাজতন্ত্রও মুজিববাদী সমাজতন্ত্রই রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের মূল দ্বন্দ্বটা মোটেই সমাজতন্ত্রকেন্দ্রিক মতাদর্শগত ছিল না, ছিল বঙ্গবন্ধুকে কাছে পাওয়ার প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক। ” (২২)

১৯৭০ সালের অগাস্ট মাসে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে প্রাস্তাব পাশ হয়ে ছিল। এই প্রস্তাব পাশের সময় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির  তিন ভাগের এক ভাগ সদস্য বৈঠক বয়কট করেছিল। প্রস্তাব পাশের পর শেখ মুজিবর রহমানের অসন্তুষ্টির কারণে ছাত্রলীগ এই প্রস্তাব থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের সময়  সমাজতান্ত্রিক প্রস্তাবের বিষয়টি মাটি চাপা পড়ে যায়। নির্বাচনী প্রচার কালে  সমাজততন্ত্র ও স্বাধীনতার বিষয়টি পুরোপুরি অনালোচিত থাকে।  যদিও সারাদেশের নির্বাচনী এলাকায়  ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ অংশ নিয়েছিল। কোন কোন এলাকায় ছাত্রলীগ নেতারা স্বাধীনতার কথা বলায়  তাদেরকে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। (**) ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে  আওয়ামী লীগ ভূমি সংস্কারের মত  কিছু সংস্কারবাদী কর্মসূচী স্থান পেয়েছিল।  ১৯৭০ সালের অগাস্ট  সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব থেকে থেকে  জাসদের  আত্ম প্রকাশ ১৯৭২ সালের অক্টোবর। ১৯৭০ সালের অগাস্ট   থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের বিজয় পর্যন্ত যুদ্ধ ও রাজনীতিতে জাসদ পন্থীদের সমাজতন্ত্র নিয়ে কোন আলোচনা বা উদ্যোগ চোখে পড়ে  না। যুদ্ধত্তোর কালে ছাত্রলীগের ভাঙ্গন ২১ জুলাই ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই অংশ মুজিববাদ দ্রবীভূত সমাজতনতন্ত্রকে যুদ্ধ পতাকা হিসেবে উড়িয়েছিল। ২১ জুলাই ১৯৭২ জাসদ পন্থীরা প্রকাশ্য কর্তৃক প্রত্যাখিত হওয়ার পরেই জাসদের জন্মের বিষয়টি সামনে আসে। জাসদের আত্ম প্রকাশ আকস্মিক। শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক দূরে ঠেলে দেওয়াই জাসদের জন্মের কারণ। অবিভক্ত ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থীদের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন থেকেই জাসদের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমতার আখাঙ্খার জন্ম নিয়েছিল।  তৎকালীন ছাত্রলীগের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থীরাই জাসদের পতাকা নিয়ে রাজনীতিতে হাজির হয়।  জাসদের জন্ম ১৯৭২ সালে তবে এই ধারার  পূর্ব-ইতিহাস আছে। জাসদকে বুঝতে হলে এর পটভূমিকে পাশ কাটানোর দুস্কর।
 জাসদ ও সিপিবি পৃথক ধারার দল। মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তবে যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে উভয় দলই শেখ মুজিবর রহমানকে কাজে লাগিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেষ্টা করে ছিল। ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের এই উদ্দ্যোগের সমাধি ঘটে ২১ জুলাই ১৯৭২ সালে। জাসদ বেছে  নেয় মুজিবের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিরোধিতার পথ।   সিপিবির শেখ মুজিবর রহমানের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে এগুতে চেষ্টা করেছিল ১৯৭২ সাল থেকেই। শেখ মুজিব সরকারের সকল কাজকে সমর্থন করার মধ্য দিয়ে ন্যায্যভাবে প্রতিবাদী যুবক শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সিপিবির পথ চলা।  মুক্তিযুদ্ধে মোটা দাগে চীনপন্থীদের ভূমিকা জটিল। এলাকা ভেদে ভিন্ন। তবে দেশের মানুষের কাছে বার্তা গিয়েছিল চীন পন্থীরা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধী ছিল। এই বার্তাটি পুরোপুরি সত্য না তবে তকমাওলা  চীনপন্থী দের পথ হারা এই বার্তাকে সহজ বোধ্য করে ছিল। এই পরিবেশ জাসদের উত্থানকে সহজতর  করে ছিল।

অপু সারোয়ার : ফ্রি ল্যান্স লেখক

তথ্য সূত্র  

(১৬) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রথম কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্মেলনেআহ্ববায়ক কমিটির বক্তব্য ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল

(১৭) পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি” – লেখক ডা শহীদুল ইসলাম খান জাসদবাসদ রাজনীতি মাহবুবুল হক ৬০৬১ পৃষ্ঠা বেহুলা বাংলা প্রকাশনী নভেম্বর ২০২১ যুদ্ধকালে বিএলএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ নিয়ে আলোচনার কথা উল্ল্যেখ করেছেন দিনাজপুরের ডা শহীদুল ইসলাম খান. যুদ্ধকালে বিএলএফ সদস্য যুদ্ধত্তোর কালে মুজিববাদী ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন শহীদুল ইসলাম খান শহীদুল ইসলাম খান বিএলএফ ক্যাম্পে যে আলোচনার কথা বলেছেন এই আলোচনা গুলি বিএলএফ এর নির্ধারিত প্রশিক্ষণের বাইরে ছিল বিএলএফ ক্যাম্পে মার্ক্সবাদ কেন্দ্রিক আলোচনা ছিল প্রান্তিক

(১৮) ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী গণকণ্ঠ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় প্রকাশনায় মুখ্য ভূমিকা রাখেন আফতাবউদ্দিন আহমেদ ফিরদাউস রায়হান মধু প্রকাশনার শুরুতে পত্রিকাটি সরকারী দপ্তরে নিবন্ধিত ছিল না ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ সাল থেকে গণকণ্ঠ দৈনিক হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে  

(১৯) ছাত্রলীগের একাংশের প্যানেল ছিল জিনাতমজলিশ ডাকসুর সহসভাপতি জিনাত আলী আর সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিস নেতৃত্বে প্যানেল দেয়া হয়েছিল এই অংশ পরবর্তীতে ছাত্রলীগের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ধারা হিসেবে পরিচিত লাভ করে ছাত্রলীগের অপরাংশের প্যানেল ছিল শহীদমুনির ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে শেখ শহিদুল ইসলাম আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনিরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে প্যানেল দেয়া হয়েছিল উভয় গ্ৰুপ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল এই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মাহবুব জামান পরিষদ

(২০) দৈনিক গণকণ্ঠ ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর একটি অন্তরঙ্গ সন্ধ্যা২২শে মে ১৯৭২

(২১) বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স: একটি পর্যালোচনা মাহবুবুল হক পৃষ্ঠা ২৫৯ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা সম্পাদকডঃ মেসবাহকামাল প্রকাশ কাল২০০০ প্রকাশকসম্পর্ক, কলিকাতা

(২২) ফম মাহবুবুল হক তার রাজনীতি লেখক   সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পৃষ্ঠা ২৬ যে জীবন জনতারকমরেড ফম মাহবুবুল হক স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ কাল ২০২০