শিল্প সাহিত্য

ফাল্গুনীদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই

– রুখসানা বিলকিস (শান্তা)

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা প্রায় হতে চলল। ফাল্গুনী তাড়াহুড়া করে কাজ করছে। এখনো মেলা কাজ বাকি আছে। শুকনো কাপড়গুলো উঠোন থেকে ঘরে তুলতে হবে, তোষক রোদে দেয়া আছে। সেটাকে বিছানায় নিতে হবে। জাফরের ওজুর পানি বারান্দায় এখনো রাখা হয়নি। হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে কেরোসিন ভরে জ্বালিয়ে রাখতে হবে উনি ঘরে আসার আগেই। নয়ত অনেক রেগে যাবেন। কপাল মন্দ থাকলে চুলের মুঠি ধরে মার খাওয়াও হতে পারে। আর ফাল্গুনীর কপাল! মার খাওয়া কপাল নিয়েই তো বিয়ে হয়েছিল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া এলাকার বড় মুন্সির বেটা জাফর মোল্লার সাথে। কিন্তু উনি যে বৌয়ের সাথে এমন খারাপ ব্যাবহার করতে পারেন তা তো ফাল্গুনীর বাবা মা কখনো ভাবতে পারেন নাই। ভেবেছিলেন মেয়ে তাদের খুব ভালো থাকবে এ রকম মানুষের কাছে।
কিন্তু তা আর হলো ক‌ই!
যা ভেবেছিল ঠিক তাই। মাত্র‌ই হাতের সব কাজ গুছিয়ে এনে হারিকেনের চিমনি ভালো মতন মুছে তেল ভরছিল ফাল্গুনী। সেই সময় বার বাড়ি থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে ভিতর বাড়িতে প্রবেশ করে জাফর মোল্লা। এসেই দেখে বাড়ি অন্ধকার। এখনো হারিকেন জ্বালানো হয় নাই। আর যায় কোথায়। টিনের গায়ে হেলান দেয়া ছিল ঘুটে লাগানো একটা পাটের কাঠি। সেটাই হাতে নিয়ে সপাট সপাট করে ফাল্গুনীর পিঠে বসিয়ে দিল দু’ঘা। “হারামজাদী, সারাদিন করিস কি তুই! এখনো কেনো আমার বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে? তোর মতন অলক্ষ্মীর জন্য আমার সংসারে কোনো দিন উন্নতি হবে না”। এই বলে আরো দুটো লাথি মেরে উঠোনে ফেলে দিল ফাল্গুনীকে। তারপর চলে গেলো ওজু করতে। এতো মার খাওয়ার পরেও ফাল্গুনীর মুখ দিয়ে একটা শব্দ‌ও বের হলো না। মেয়েদের গলার শব্দ নাকি বাইরের মানুষের শুনতে নেই। শুধু দু চোখ বেয়ে নীরবে নেমে এলো কয়েক ফোঁটা কষ্টের স্রোত। ওজু করে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে গিয়েছে জাফর। এই ফাঁকে তাড়াতাড়ি উঠে কাপড়ের ময়লা ঝেড়ে ফেলে ঘরে গেলো হারিকেন জ্বালাতে। হারিকেন জ্বালিয়ে ওজু করে নিজেও নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষে মুড়ি মাখা তৈরি করে রাখল। উনি এসেই খেতে বসবেন।
দরজা ভিড়িয়ে বসে র‌ইল ফাল্গুনী আর ভাবতে লাগল নিজের ছোটো বেলাকার কথা। কত‌ই না আদরে বড় করেছেন তার বাবা মা। বড় দুই ভাই অনেক আদর করত ছোটো বোন ফাল্গুনীকে। কি না করত তার জন্য। যা খেতে চাইত তাই এনে দিত। বৈশাখী মেলা অথবা পুজার মেলা থেকে কত রঙের চুড়ি, ফিতা, আলতা আর মজার মজার খাবার কিনে আনত তারা। আর বাবার কথা কি বলব। প্রতিদিন তাকে নিজের কাছে বসিয়ে ভাত মেখে খাওয়াতেন। মা কাছে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতেন। আহা! সে সব এখন শুধুই স্মৃতি। মনে হলেই বুকটা ফেটে কান্না চলে আসে। দুই গ্রাম পরেই ফাল্গুনীর বাবার বাড়ি। কিন্তু ওখানে যাওয়ার অনুমতি দেয় না জাফর। বাড়ির বৌদের নাকি বের হ‌ওয়া নিষেধ আছে। এটা নাকি ওদের বংশের নিয়ম। আর তাই ফাল্গুনী যেতে পারে না বাবার বাড়িতে। মাঝে মাঝে বড় দুই ভাইজান আসে। জাফর তাদের সাথে খুব একটা আন্তরিক ভাবে কথা বলেন না। ভালো মন্দ কুশলাদি জিজ্ঞাস করেই উনি চলে যান বাহিরে। ভাইজানেরা বুঝে সব‌ই। ফাল্গুনী যে খুব একটা ভালো নেই তা বুঝেও না বুঝার মতন করে থাকেন। তবে ভাইজানেরা যতবার আসেন ততবার‌ই তার পছন্দের সব কিছু নিয়ে আসেন। কিন্তু এখন আর আগের মতন খুশী হতে পারে না ফাল্গুনী। কোথায় যে তার সুখ অর হাসি হারিয়ে গেছে তা সে নিজেই জানে না। বাড়ি ফিরলে বাবা মা প‌ই প‌ই করে ফাল্গুনীর সব খবর জানতে চায়। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ফাল্গুনী সুখে আছে শুনে আল্লাহর কাছে দু হাত তুলে শুকরিয়া আদায় করেন তারা।
হঠাৎ‌ই তার ভাবনায় ইতি পরল জাফর আসাতে। মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টেনে দৌড়ে গেলো তার খাবার আর পানি আনতে। খাবার খাওয়ার সময় উনি একটা কথাও বলেন না ফাল্গুনীর সাথে। নীরবে খেতে থাকেন। একবারো ফাল্গুনীকে বলে না যে, এসো তুমিও খাও। ফাল্গুনীর খুব মনে চায় তার স্বামী তাকে কাছে ডাকুক একসাথে খাওয়ার জন্য। বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় দু বছর। একদিন‌ও জাফর জিজ্ঞাসা করে না সে খেয়েছে কি না। মনে হয় যেন সে তার বৌ নয়, জাফরের সেবা করার জন্য‌ বান্দী হয়ে এ বাড়িতে এসেছে।
জাফরের খাওয়া শেষ হলে সব কিছু উঠিয়ে নিয়ে চলে যায় সে পাকের ঘরে। এখন তাকে রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে। জাফর এক বেলার খাবার আরেক বেলায় খায় না। নতুন করে রান্না করতে হয়। গরম গরম সব কিছু না পেলে ভয়ঙ্কর রেগে যান। লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে দেন। আর ফাল্গুনীর গায়ে হাত তোলা তো মনে হয় পানি ভাত।
মাটির চুলাটা জ্বালিয়ে ভাতটা বসিয়ে দিল এক চুলায়। আরেক চুলায় চাপিয়ে দিল মাছের সালুন। মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে নিয়ে চুলায় জ্বাল দিতে লাগল। চারিদিকে কোনো শব্দ নেই। ভাতের বলকের শব্দ‌ই কেবল শোনা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ফাল্গুনী ভাবতে লাগল জাফরের হাতে তার প্রথম মার খাওয়ার কথা। বিয়ের এক সপ্তাহ হয়নি তখন। কুয়ো থেকে পানি তুলতে গিয়ে রশি ছিঁড়ে বালতিটা পরে যায়। জাফর কাছে পিঠেই ছিল। একটা বড় লাঠি দিয়ে সাজনা পারছিল। বালতি পরার শব্দে ফাল্গুনীর কাছে এসে ঠাস ঠাস করে দুই গালে লাগিয়ে দিল চড়। ও তো বুঝতেই পারল না কেনো ওকে মারল। ওর গায়ে কোনোদিন কেউ হাত তোলেনি। চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল সে। কেনো এত জোড়ে কাঁদল, আশেপাশের মানুষ জাফর মোল্লার বৌয়ের গলার আওয়াজ নিশ্চয় শুনতে পেয়েছে, এই জন্য চুলের মুঠি ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বেদম ভাবে পেটালো সে। এ রকম মার খেয়ে রাতে গা কাঁপিয়ে প্রচুর জ্বর এসেছিল। জাফর ফিরেও তাকায়নি। সারারাত জ্বর নিয়েই পরে ছিল। এক সপ্তাহ লেগেছিল সুস্থ হতে। ফাল্গুনী ইচ্ছা করলে হয়ত তার বাবা মা ভাইদের কাছে চলে যেতে পারত। কিন্তু তাদের এতো আদরের ধনকে কেউ এভাবে মেরেছে শুনলে মা বাবা সহ্য করতে পারত না। হয়ত তারা কষ্টে মরেই যেত। তাই ফাল্গুনী যায়নি। সেইদিন‌ই শুরু। এরপর থেকে অহরহ মার খাচ্ছে সে। পান থেকে চুন খসলেই মার। এখন সে আর চিৎকার করে না। নীরবে চোখের জল ফেলে আর একমনে কাজ করে যায়।
দু বছর তিন মাস পরের ঘটনা।
একদিন ভোর বেলায় জাফর ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠল। পাশে দেখে ফাল্গুনী নেই। দরজাটা খোলা। জাফর বাইরে আসে। উঠোন জুড়ে এখনো অন্ধকারের হালকা পোঁচ রয়ে গেছে। কোথায় গেলো ফাল্গুনী? পুকুর ঘাটটা ঘুরে আসল সে। সেখানেও নেই। কুয়া পাড়েও নেই। কি ব্যাপার! গেলো কোথায়? জাফরকে না বলে ফাল্গুনীর ছায়াটাও তো নড়ে নাই কখনো। সেই সাহসটাই তো ছিল না ওর। ভাবতে ভাবতে সে ওজু করে নামাজটা আদায় করে নিল।
একটু একটু করে চারিদিক আলো ফুটতে লাগল। ফাল্গুনীর কোনো খবর নেই। গতকাল রাতে জাফরের মাথাটা অত্যাধিক গরম হয়ে গিয়েছিল। তরকারিটা একটু ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। কেনো হলো! তাই খাওয়া রেখে উঠেই ভাতের চামচটা দিয়ে অনেক মারল সে। মাটিতে শুইয়ে ফেলেছিল ফাল্গুনীকে। ওর মুখ দিয়ে একটা শব্দ‌ও বের হয়নি। কি করে বের হবে। জাফর তো বলেই দিয়েছে এই বাড়ির মেয়েলোকের গলা যেন বাইরে না যায়। ফাল্গুনীর কি করে সাহস হবে শব্দ করার।
সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চলল। কোনো খবর নেই ফাল্গুনীর। নিজের ঘরের বৌ বাড়িতে নেই এটা জানলে লোকে কি বলবে। তাই আশেপাশের ঘরে গিয়ে খোঁজ ও নিতে পারছে না। হঠাৎ মনে হলো ফাল্গুনী হয়ত তার বাবার বাড়িতে চলে গেছে। তাই সে তার এক বিশ্বস্ত লোক পাঠালো ঐ গ্রামে খোঁজ নেয়ার জন্য। এমন ভাবে খোঁজ নিতে বলল যেন ওর বাড়ির লোকেরা টের না পায় যে ফাল্গুনীকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকেল নাগাদ ঐ লোক ফিরে এসে জানাল সে ঐ বাড়িতে যায়নি।
জাফরের এখন একটু ভয় করা শুরু করেছে। বৌটার সাথে সে অনেক খারাপ ব্যাবহার করত। অনেক ভালো ছিল বৌটা। তবুও সে ওকে মারত। কোনোদিন ভালো করে কথাও বলেনি। শখ করে কিছু কিনে দেয়নি। এমন ব্যবহার করত মনে হয় যেন কাজের লোক। ঘরের দাওয়ায় বসে বসে বিগত দিনের কথা সে ভাবতে লাগল। বেশ অনুশোচনাও হতে লাগল। কি হতো যদি বৌটার সাথে ও ভালো ব্যাবহার করত। নিজের উপর‌ই নিজের এখন রাগ হতে লাগল।
কোথায় যাবে সে ফাল্গুনীকে খুঁজতে? কার কাছে গিয়ে খুঁজবে? বৌ কেনো চলে গেছে কেউ জানতে চাইলে কি বলবে ও? বৌকে সে মারত? তাই বৌ চলে গেছে? ছিঃ ছিঃ। নিজের উপর এখন খুব ঘেন্না হচ্ছে। অজান্তেই কখন যেন চোখ বেয়ে বেয়ে জল পরতে শুরু করল। নিজের কাছেই নিজে প্রতিজ্ঞা করল যে একবার যদি বৌটা ফিরে আসে তবে আর কোনোদিন তাকে মারবে না, খারাপ ব্যাবহার করবে না। ভালোবেসে যত্ন করবে তার।
বাহিরে অন্ধকার প্রায় হয়ে এসেছে। ঘরের ভিতরেও অন্ধকার। আজ আলো জ্বালানোর কেউ নেই। ঘর অন্ধকার থাকাতে কার উপর আজ সে রাগ দেখাবে? কে তাকে ওজুর পানি দিবে? কে তাকে খেতে দিবে? ভাবতে ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখে দূর থেকে কে যেন আসছে। অন্ধকারে ঠিক মতন বুঝা যাচ্ছে না। কে আসছে বাড়ির দিকে এগিয়ে? মনে হলো কোনো‌ মেয়েলোক। মাথায় এক হাত ঘোমটা দেয়া। বুকটা ধক্ করে উঠল। চোখ বড় করে তাকালো সে। বসা থেকে সে উঠে দাঁড়ালো। এটা তার বৌ ফাল্গুনী নয়ত!