বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৬৩): সমাজতন্ত্র কেন দরকার?

-বিজন সাহা  

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

বিগত কয়েক পর্বে চেষ্টা করেছি পেরেস্ত্রোইকা নিয়ে কথা বলতে আর সেটাই দেখাতে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন অনিবার্য ছিল না। সেই পতন হয়েছে যতটা না তত্ত্বের দুর্বলতার কারণে তারচেয়ে বেশি নেতৃত্বের দুর্বলতা আর অযোগ্যতার কারণে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন না ঘটত তাহলে কী হত আর তারচেয়েও বড় কথা যে সিস্টেম নিজেকে রক্ষা করতে পারল না সেটা কি আমাদের আদৌ দরকার আছে নাকি ভালো হয় একেবারেই নতুন কোন সিস্টেমের কথা চিন্তা করা, একেবারে নতুন কিছু ভাবা?

“তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে” এ কথা কংস রাজাকে উদ্দেশ্য করে মহামায়া বলেছিলেন। মহাভারতের এই গল্পে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে। সে গল্পে আমরা যাব না। তবে মূল কথা হল সব কিছু ধ্বংসের বীজ সেই সিস্টেমের ভেতরেই থাকে। এরাই কখনও বিভীষণের বেশে, কখনও মীরজাফর রূপে আবার কখনও বা মুশতাকের রূপ নিয়ে ভেতরে থেকে কোন সিস্টেম বা ব্যবস্থার ধ্বংস ডেকে আনে। মানুষ যেমন মৃত্যু পরওয়ানা হাতে নিয়েই জন্ম নেয়, প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থাও তেমন। তবে কে কতদিন পর্যন্ত নিজের মৃত্যু দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে সেটা যেমন ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে নির্ভর করে তার জীবনযাত্রার উপর সমাজের ক্ষেত্রে সেটা নির্ভর করে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে সেই সমাজের নিজেকে পরিবর্তন করার ক্ষমতার উপর। এখানে উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি পুঁজিবাদের কথা। ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে গত একশ বছরে পুঁজিবাদ বিভিন্ন রকম দুর্যোগের মধ্য দিয়ে গেছে। গ্রেট ডিপ্রেশন, বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহ, তার টিকে থাকার মূল ভিত্তি একের পর এক উপনিবেশ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক মন্দা – কিসের মধ্য দিয়ে না গেছে আধুনিক পুঁজিবাদ। কিন্তু নিজেকে বদলানোর ক্ষমতা, কখনও নরম, কখনও কঠিন হওয়ার মজ্জাগত অভ্যেস তাকে বার বার ধ্বংসের মুখ থেকে টেনে বের করে এনেছে। রাজনৈতিক ভাবে উপনিবেশ হারিয়ে সে পেরেছে সেসব দেশকেই অর্থনৈতিক বন্ধনে বন্দী করতে, নব্য উপনিবেশ গড়ে তুলতে। এসবই প্রমাণ করে সময়ের ডাকে সাড়া দিতে পারলে, যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে বদলাতে পারলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষেও দীর্ঘ সময় টিকে থাকা অসম্ভব নয়। আর পুঁজিবাদের মত অমানবিক ব্যবস্থা যদি শত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মানব জাতির জন্য অনেক মঙ্গল বার্তা বয়ে আনতে পারে সমাজতন্ত্র কেন পারবে না? আমাদের যে বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতি সেটা কিন্তু এসেছে পুঁজিবাদের হাত ধরেই যদিও সেক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এই দুই সিস্টেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই তাদের বাধ্য করেছে প্রথমে সামরিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত ভাবে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে যা পরবর্তীতে নাগরিক জীবনেও আমূল পরিবর্তন এনেছে।

আমরা যদি বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর মূলে রয়েছে ইউনিপোলার বা এক মেরুর বিশ্ব। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই কিন্তু সমাজতন্ত্র তো পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি। এখনও কিউবায় সমাজতন্ত্র আছে, সমাজতন্ত্র আছে চীনে। তাহলে কেন তারা সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে পারছে না? কিউবার নিজের অবস্থাই তথৈবচ। সে নিজে টিকে থাকলেও এবং চিকিৎসা সহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করলেও বিশ্ব মঞ্চে খুব বেশি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। চীন তার বর্তমান অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে অনেক কিছুই করতে পারে, কিন্তু করবে কি না সেটাই প্রশ্ন। ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর পর নিজের অস্তিত্বের জন্য মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল হলেও পরবর্তীতে দু দেশের মতবিরোধ দেখা দেয় আর এরপর থেকেই চীনের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের বিরুদ্ধে বললেও তার মূল শত্রু ছিল পশ্চিমা পুঁজিবাদ। এছাড়া চীনের বর্তমান উন্নয়ন ঘটেছে পুঁজিবাদের হাত ধরে, পুঁজিবাদের সাথে সার্বিকভাবে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। এমনকি এখনও তার অর্থনীতি আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। কিছু কিছু প্রশ্নে, বিশেষ করে তাইওয়ান প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে চীনের প্রচণ্ড মতবিরোধ থাকলেও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই তারা পরস্পরের সহযোগী। তাছাড়া চীনের বর্তমান অর্থনীতি গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে। তাই বিভিন্ন দেশের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীন যতটা না সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধি তার চেয়ে বেশি পুঁজিবাদের প্রতিনিধি। ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি যতটা আস্থা রাখতে পারত চীনের উপর ততটা পারে না। ঠিক একই কথা বলা চলে বিভিন্ন দেশের বাম আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। হয়তো এ কারণেই যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তখন চীন বিভিন্ন দেশে বাম আন্দোলনে ভাঙ্গন ধরিয়ে অনেককে নিজের কাছে টেনে নিলেও যখন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সে একচ্ছত্র অধিকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল দেশে দেশে বাম আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে সে এগিয়ে এলো না। কিন্তু সেটা চীনের আগ্রহের অভাব নাকি বিভিন্ন দেশের বাম দলগুলোর চীনের প্রতি অবিশ্বাস সেকথা ঠিক করে বলতে পারব না। তবে বাস্তবতা হল এই যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দেশে দেশে বাম আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আর সেই সুযোগ গ্রহণ করে অতি ডান, ধর্মীয় মৌলবাদী ও জাতীয়তাবাদী শক্তি নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে। কোন কোন দেশে তারা ক্ষমতা দখল করেছে, অনেক দেশে সেটা করতে না পারলেও বিভিন্ন ভাবে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের এজেন্ডা ঠিকই কার্যকরী করতে পেরেছে, পারছে। সেটা আমরা ভারত, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশেই দেখতে পাই। আমাদের সব দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ যেটাকে রাজনৈতিক না বলে অরাজনৈতিক বলাই শ্রেয়, নতুন করে প্রমাণ করে যে বাম রাজনীতির পুনরুত্থান ব্যাতীত এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু বিভিন্ন দেশের বাম রাজনীতির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতান্ত্রিক দেশ থাকা না থাকার সম্পর্ক কোথায়? যদিও অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হবার আগেই বিভিন্ন দেশে বাম আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, এই আন্দোলন গতি পায় মূলত অক্টোবর বিপ্লবের পরেই। এই বিপ্লব এক ধরণের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এটা মানুষকে আশার আলো দেখায়। সমাজের নীচু স্তরের মানুষও নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হতে পারে সেই বিশ্বাস জাগায় মানুষের মনে। তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকারের লড়াইয়ে মানসিক এবং অনেক ক্ষেত্রে ম্যাটেরিয়াল সমর্থন পায়। তারা এক বন্ধু পায় যে সত্যিকার অর্থেই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত। দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনে সোভিয়েত  সমর্থন বারবার এটাই প্রমাণ করে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তারা এই সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু বাম আন্দোলন নয় বিভিন্ন দেশের সরকার তা সে বাম ডান যাই হোক তারাও তাদের এক সময়ের প্রভুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সোভিয়েত সমর্থন পায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন এক দিকে বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষকে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে, তার উপস্থিতি উন্নত বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করে। নিজেদের দেশে যাতে এ ধরণের বিপ্লব না ঘটে সে উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদীরা নিজেরাই তাদের শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে বাধ্য হয়, বাধ্য হয় সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার রক্ষা করতে। আমার বিশ্বাস বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার স্টেট তো বটেই এমনকি খোদ আমেরিকায় নারী ও আফ্রো আমেরিকানদের ভোট সহ বিভিন্ন নাগরিক অধিকার পাবার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। আজ ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, তেল গ্যাস বিদ্যুৎ ইত্যাদির মূল্য কল্পনাতীত ভাবে বৃদ্ধি পেলেও দেশে দেশে সরকার সাধারণ মানুষের স্বার্থ তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বলে মনে হয় না। আর এটার কারণ একটাই – বিকল্প আদর্শ না থাকায় পুঁজিবাদ এখন আর নিজেকে আগের মত ভালনারেবল মনে করছে না।

যদিও এখন রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তবুও রাশিয়া তাদেরই একজন, সেও পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রতিনিধি। চার্চিলের কথা একটু ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায় “গণতন্ত্র সরকার পরিচালনায় সবচেয়ে খারাপ সিস্টেম, তারপরেও গণতন্ত্র অন্য যেকোনো সিস্টেমের চেয়ে ভালো।” কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ এক নয়। অনেকে পুঁজিবাদকেই গণতন্ত্রের সিনোনেম হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইছে। আবার এটাও ঠিক সমাজতন্ত্রের অনেক ভুলত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সে গণতন্ত্রের যোগ্য বিকল্প। যখন কোন বিকল্প না থাকে তখন এমনকি গণতন্ত্র পর্যন্ত স্বৈরাচারে পরিণত হতে পারে। অন্তত বিগত তিরিশ বছর ধরে বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে আমেরিকার হস্তক্ষেপ এটাই প্রমাণ করে। আর এর ফলে বিশ্ব শান্তি, মানব সভ্যতার অস্তিত্ব আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালনারেবল। তাই শুধু আমাদের মত উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের জন্যই নয়, বিশ্ব শান্তির জন্যও পুঁজিবাদের কাউন্টার ওয়েট হিসেবে সমাজতন্ত্র অথবা অন্য যেকোনো ব্যবস্থা যা সামাজিক সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের গ্যারান্টি দেয় এরকম শক্তিশালী দেশের আগমন একান্ত প্রয়োজন। এবং সে দেশকে হতে হবে শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই নয় সামরিক ভাবেও শক্তিশালী, অন্যথায় পুঁজিবাদ তাকে কখনই মাথা তুলতে দেবে না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন সমাজতন্ত্র, কেন ওয়েলফেয়ার স্টেট নয়। কারণ ওয়েলফেয়ার স্টেট আসলে পুঁজিবাদ বা বলা যায় সমাজতন্ত্রের মোকাবিলায় পুঁজিবাদের শোরুম। কোন সমস্যারই চিরস্থায়ী সমাধান নেই। সব কিছুর মত সমস্যাও পরিবর্তনশীল। তাই সেভাবেই সমাধান খুঁজতে হবে। পুঁজিবাদের মূল হল অসাম্য। হ্যাঁ, আধুনিক পুঁজিবাদ মানবতা, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য এসবের কথা বলে – তবে সেটা থেকে যায় কাগজে কলমে। আর সবচেয়ে বড় কথা এসব সাম্য অর্থনৈতিক নয়, আদর্শিক। যদি ভারতীয় ধর্মীয় ব্যবস্থায় শূদ্র বা বৈশ্য ব্রাহ্মণ হতে পারে না, পুঁজিবাদে সেটা সম্ভব। কিন্তু সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর এ কারণেই আজ সারা পৃথিবী জুড়ে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে অসাম্য শুধু বেড়েই চলছে। তাই আমাদের এমন ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে যা মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাবে। সেটা যে অসম্ভব নয় তা সোভিয়েত ইউনিয়ন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। আর এ কারণেই আমাদের এমন এক সমাজের কথা ভাবতে হবে যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের ন্যুনতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে এবং সেখানেই বসে না থেকে ধীরে ধীরে সমাজের সাথে সাথে ব্যক্তি মানুষের জীবন কিভাবে উন্নত থেকে উন্নততর করা যায় সেদিকে নজর দেবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো