চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা: মিখাইল গর্বাচভ (৬৩)

-বিজন সাহা

গত পর্বে আমরা শেষ করেছিলাম এই বলে যে গর্বাচভ কি বিশ্বাসঘাতক ছিলেন নাকি হিসেবে ভুল করেছেন। এ নিয়ে কেউ কেউ লিখেছেন তিনি নিঃসন্দেহে বিশ্বাসঘাতক ছিলেন। সে ব্যাপারে তাদের কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কথা তো সেখানে নয়। আমরা যদি ধরেই নেই তিনি বিশ্বাসঘাতক ছিলেন তাহলে এ নিয়ে বলার কিছু থাকে না ঠিক যেমন হয়েছে মীর জাফর বা খন্দকার মুশতাকের বেলায়। কারণ সেক্ষেত্রে তাদের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যায়। কিন্তু এই লোকগুলো এমনি এমনি এত উঁচুতে ওঠে নাই। তাহলে কি এমন হল যে তারা বিশ্বাসঘতকতা করল তাদের এককালীন প্রভু বা বন্ধুর সাথে। এটা আমাদের জানা দরকার ভবিষ্যতে এ ধরণের বিপদ এড়ানোর জন্য। যদি আমরা এর আগে লেখা রোগের উদাহরণে আসি তাহলে এক্ষেত্রে রোগী মারা গেছে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায়। কিন্তু শুধু ডাক্তারকে দোষ দিয়ে কাজ শেষ করলেই তো হবে না। এমনও তো হতে পারে সে যেখানে পড়াশুনা করেছে সেখানে ঠিক মত শিক্ষা দেওয়া হয় না? অর্থাৎ যে উপসংহারেই আমরা আসি না কেন সেটা করতে হবে সব দিক বিবেচনা করে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরণের পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।

আমি যখন ১৯৮৩ সালে মস্কো আসি তখন অনেক কিছু দেখেই অবাক হয়েছি। অবাক হয়েছি পরিষ্কার রাস্তাঘাট দেখে, অবাক হয়েছি শহরে এত গাছপালা দেখে, অবাক হয়েছি কিভাবে মানুষ কন্ডাক্টর ছাড়া ঠিকঠাক ভাড়া দিচ্ছে সেটা দেখে, অবাক হয়েছি মানুষের চিন্তামুক্ত মুখ দেখে, অবাক হয়েছি বাসে মেট্রোয় মানুষকে বই পড়তে দেখে, অবাক হয়েছি আমাদের প্রতি তাদের সহানুভূতি দেখে, অবাক হয়েছি রাত বিরাতে মস্কোর রাস্তায় নিরাপদে হাঁটতে পেরে। আরও অবাক হয়েছি মাঝে মধ্যে অতি সামান্য কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব দেখে। ফলে কোথাও কোন ভালো জিনিস পেলেই মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছে সেসব কিনতে আর কিনেছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। তখনই বুঝেছি খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার পরেও মানুষ নিজেকে নিরাপদ মনে করত না। কিন্তু অভাব তো শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই ছিল না, ছিল দেশে দেশে। তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙল কেন? আমাদের সব দেশে জনগণের অভাবের সাথে আর যে জিনিসটা ছিল তা হল পাঁচ বছর পরে নতুন কাউকে ক্ষমতায় বসানোর সুযোগ। তাই আমাদের সব দেশের মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় সে ভাবে, ঠিক আছে পরবর্তী নির্বাচনে আমরা অন্যকে সুযোগ দেব। যদিও অনেক দেশেই সেটা হয়ে ওঠে না বিভিন্ন কারণে কিন্তু আশাটা থেকেই যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল এক দলীয় শাসন। তাই মানুষের কোনই বিকল্প ছিল না। সেটা গর্বাচভ বুঝতেন আর সে কারণেই হয়তো তিনি রাজনৈতিক রিফর্মে হাত দেন। কিন্তু হাত দিলেই তো হবে না। রাজনৈতিক দল তো আকাশ থেকে পড়ে না। সে সময় সরকারি ভাবে ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ আর গোপনে ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী আদর্শ। আমাদের সব দেশে যেমন একাধিক রাজনৈতিক দল আছে এবং তারা দেশের সংবিধানের মধ্যে থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে কখনই সেই সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে যেকোনো ভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক তৎপরতা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য করা হত। যদি এমন ব্যবস্থা করা হত যে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন বড় বড় শিল্প ও জাতীয় সম্পদে জনগণ তথা রাষ্ট্রের মালিকানা অক্ষুণ্ণ থাকবে অর্থাৎ জাতীয় অর্থনীতির মূলে থাকবে সামাজিক ন্যায় বন্টন তাহলে হয়তো সেই বিকল্প গড়ে তোলা যেত। কিন্তু সে জন্যে আগে সরকারি উদ্যোগে বিকল্প রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রিফর্মের দিকে হাঁটা উচিৎ ছিল। আমার বিশ্বাস দেশ ভাঙার পরে ইয়েলৎসিনের রাজনৈতিক দল যদি ইউনাইটেড রাশিয়ার মত জন সমর্থন পেত তিনি আবার এক দলীয় শাসন কায়েম করতেন। বর্তমান শাসক শ্রেণি এক দলীয় শাসনের বিপদ ভাল ভাবেই বোঝে তাই অতি যত্ন সহকারে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু রাখতে বদ্ধপরিকর। আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দ বিরোধী দলগুলোকে মাঠ থেকে তাড়ানোর আগে কথাটা ভেবে দেখতে পারেন।

আমরা যখন ডেফিসিটের কথা বলি একটা প্রশ্ন আমাকে খুব তাড়া করে। এই ডেফিসিটটা ছিল পণ্যে, মূলত ভোগ্য পণ্যে। আমাদের দেশে কোন দোকানে গেলে আপনাকে কিছু না কিনে যেতে দেয় না কেউ, এখানে দোকানে ঢুকে মনে হত ওদের বিক্রি করার দরকার নেই, কিনতে চেয়ে আপনি এক মহা অপরাধ করেছেন। অথচ সমাজের অন্য ক্ষেত্রে এটা তেমন চোখে পড়ত না। কী লেখাপড়া, কী চিকিৎসা, কী খেলাধুলা, কী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড – এসব ক্ষেত্রে  শিক্ষক, ডাক্তার, কোচ, মেন্টর এরা সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়াতেন, চিকিৎসা করতেন, খেলাধুলা শেখাতেন বা গান বাজনা নাটক এসব শেখাতেন। শুধু শেখাতেনই না তারা এটা করতেন খুবই যত্ন সহকারে, পেশা নয় যেন নেশার মত। কিন্তু বই বাদে প্রায় সব দোকানেই চিত্রটা ছিল ভিন্ন। প্রায়ই দোকানের সেলফ গড়ের মাঠের মত ফাঁকা থাকলেও বিভিন্ন পণ্য ব্যাক ডোর দিয়ে একটু বেশি দামে কেনা যেত। পণ্যের অভাব দোকানের কর্মচারীদের এমন দায়িত্বহীন করেছিল নাকি এদের দায়িত্বহীনতা পণ্যের অভাবটা প্রকট করে তুলেছিল বলা কষ্ট। এর সমাধান কী? উৎপাদন বাড়ানো। তখন প্রায়ই ব্যাক টু লেনিন কথাটা শোনা যেত। মানে সেই নেপ বা নিউ ইকোনমিক পলিসিতে ফিরে যাওয়া। কিন্তু সেজন্যে যখন বিভিন্ন কোঅপেরেটিভ তৈরি করা হল দেখা গেল এরা উৎপাদনের চেয়ে বিভিন্ন পণ্য বেশি দামে বিক্রী করতেই বেশি আগ্রহী। কারণ এসব কোঅপেরেটিভের মালিক তো আর গাছ থেকে পড়ে না, এরা ছিল পার্টি বা অন্য লাইনে সমাজে পরিচিত অথবা গুন্ডা টাইপের লোক। তারা লাইন ঘাট করে বিভিন্ন কারখানা থেকে জিনিস কিনত বা বাইরে থেকে আনত আর সেটাই ব্যাক ডোরের পরিবর্তে ওপেন মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করত। ফলে জিনিস বাজারে এলেও সমস্যা সেই আগের মতই থেকে গেল। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য তৈরি হল কালেক্টিভ মালিকানা – অর্থাৎ সরকার নিজে মালিক না থেকে কারখানা শ্রমিকদের কাছে পূর্ণ বা আংশিক ভাবে হস্তান্তর করল। কিন্তু যে শ্রমিক কাজ করা বা সেভাবে বললে হুকুম পালন করা ছাড়া আর কিছু জানে না সে কারখানা চালাবে কীভাবে? স্বাভাবিক ভাবেই কিছু উদ্যোগী মানুষ যাদের অধিকাংশই টাউট বাটপার এসবের দায়িত্ব নিল। তাতে কারখানার উৎপাদন বাড়ল না, কারণ এরা মালিকানা নিয়েছে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নয়, সহজ উপায়ে নিজেদের সম্পদ বাড়ানোর জন্য। ফলে ধীরে ধীরে কলকারখানায় অরাজকতা দেখা দিল। এ দেশে সবই ছিল পরিকল্পিত। পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় তখন পরবর্তী পার্টি কংগ্রেস বা পলিটব্যুরোর সিদ্ধান্তের আশায় বসে থাকার সময় কোথায়? হতে পারে পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রতি মানুষ এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল যে পার্টি ইচ্ছা করে পরিকল্পনা ব্যাপারটাই জীবন থেকে মাইনাস করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কোন কিছুই তা দেশ রাষ্ট্র হোক, অর্থনীতি বা আর যাই হোক, যে পরিকল্পনা ছাড়া চলতে পারে না সেটা তারা মাথায় রাখেনি। মনে পড়ে পাভলভের মানি রিফর্মের কথা। ইনি রিঝকভের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যাদের হাতে প্রচুর টাকা জমে গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৫০ ও ১০০ রুবলের নোট বাতিল করা হল। মনে পড়ে আমাদের অনেকেই এই ঘোষণা শোনার পর ট্যাক্সি চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আর ভাড়া হিসেবে দিয়েছে ৫০ বা ১০০ রুবলের নোট। এই রিফর্মে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা যারা জীবনের শেষ সম্বল দুই এক হাজার রুবল জমা রেখেছিল বালিশের নীচে আর স্বাভাবিক ভাবেই সেটা রেখেছিল ৫০ বা ১০০ রুবলের নোটে। আসলে এসব রিফর্মে সব সময় সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা সে সমাজতন্ত্রেই হোক আর পুঁজিবাদেই হোক। নরেন্দ্র মোদীর মানি রিফর্ম সেটা খুব ভাল ভাবেই দেখিয়ে দিয়েছে।

এই ডেফিসিট মেটাতে যে পন্থা নেওয়া হয় সেটাও কি ঠিক ছিল? মনে আছে তখন এ দেশে ভাল কম্পিউটার ছিল না। বিদেশী ছেলেমেয়েরা সিংগাপুর থেকে এসব নিয়ে আসত। তুরস্ক থেকে আনত বিভিন্ন ধরণের পোশাক। এদেশের সরকার এতে আগ্রহী ছিল কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণে কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। চাইলে তারা নিজেরা টাকা দিয়ে বিদেশীদের পাঠাতে পারত। সেটা না করে এই মার্কেট তারা নিজের মত চলতে দিয়েছে। অধিকাংশ মানুষ কোন রকম ট্যাক্স বা এ ধরণের সমস্ত ফর্মালিটি এড়িয়ে লেনদেন করেছে আর টাকা পয়সা শুরু থেকেই কালো টাকার রূপ নিয়েছে। ফলে আবার জমেছে কালো টাকা, ট্যাক্স ফাঁকি, মাফিয়া এসব। আসলে নিয়ন্ত্রিত জীবন থেকে হঠাৎ সব ধরণের নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে নেওয়ায় যা হয়েছে – অধিকাংশ মানুষ পড়েছে অথৈ জলে আর কিছু মানুষ তাদের ডুবিয়ে নিজেরা তীরে উঠেছে। সরকার ও পার্টি জাস্ট হাত ধুয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করেছে।  রাজনীতির মত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিতে লাঙ্গল না দিয়েই বীজ বপন করেছেন।

 

নিকোলাই বেরদেয়েভ সম্পর্কে বলা হয় তিনি নাকি লিখেছিলেন রুশ বিপ্লব অন্যদের দেখাবে কীভাবে জীবন যাপন করতে নেই। সেটা ঠিক কিনা বলতে পারব না তবে গর্বাচভ দেখিয়েছেন কীভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রিফর্ম করতে নেই। অথচ বিভিন্ন রকম সফল রিফর্মের উদাহরণ রুশ ইতিহাসেই ছিল। জার তৃতীয় আলেক্সান্দর, জার দ্বিতীয় নিকোলাই এর প্রধানমন্ত্রী স্তলেপিন অত্যন্ত সফল ভাবে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রিফর্মে নেতৃত্ব দেন। গর্বাচভ বলতেন (শুধু তিনি নন, সমাজতান্ত্রিক তাত্ত্বিকদের অনেকেই) যে সমাজতন্ত্র হলো পুঁজিবাদকে বাইপাস করে সাম্যবাদে যাবার সোজা পথ। রিগ্যান অসম্মতি জানাতেন, বলতেন সমাজতন্ত্র হলো সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের দীর্ঘ ও কষ্টকর পথ। হয়তো রিগ্যানই সঠিক ছিলেন।  সবাই জানে যে জার দ্বিতীয় নিকোলাই ছিলেন স্ত্রীর প্রচন্ড অনুরাগী। যে কারণে অনেক সময়ই সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। রাইসা গর্বাচভার প্রতি মিশা মানে মিখাইল সের্গেয়েভিচ গর্বাচেভের প্রেম প্রবাদ প্রতিম। সেটাই কি ব্যর্থতার কারণগুলোর একটা?

প্রগতির সাথে গতি শব্দটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রগতি মানেই গতি। তাই প্রগতি আর ডগমা একসাথে চলতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেই গরু বা শুয়োর খাওয়াকে আর ধর্মকে গালিগালাজ করাকেই প্রগতিশীলতার মাপকাঠি মনে করে, যেমন পুরুষের পিন্ডি চটকানো অনেকের কাছে নারীবাদ। একই ঘটনা ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। লেনিনকে তো সাধারণ মানুষ ভগবান বলে মনে করতই, গর্বাচেভও প্রথমে তাদের জন্য ছিল রক্ষাকর্তা যীশু। ফলে পেরেস্ত্রোইকার শুরুর দিকে সবাই পরিবর্তনকে অন্ধ ভাবে স্বাগত জানিয়েছে, সেখানে যে ভুল হতে পারে, নৌকা যে পথ হারাতে পারে সেই প্রশ্ন কেউ করেনি। কেন? গণতন্ত্রহীনতা? গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা? অন্ধবিশ্বাস? ব্যক্তি পূজা?

 

গর্বাচভ যখন মারা যান আমি হাসপাতালে ছিলাম। একটা লোককেও এ নিয়ে কথা বলতে শুনলাম না। আমাদের ফ্যামিলি গ্রুপে না স্ত্রী না ছেলেমেয়েরা কেউ এ নিয়ে কিছু লিখল না। ফটোগ্রাফার বন্ধুরাও না। পরে যখন অফিসে ফিরলাম, ভার্সিটিতে ক্লাস নিতে শুরু করলাম – কোথাও কাউকে তাঁর সম্পর্কে কোন উচ্যবাচ্য করতে শুনলাম না। বরং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করায় অনেকেই নাখোশ বলে মনে হল। ওনাকে সমাহিত করা হল স্ত্রীর পাশে নভ দেভিচি সমাধি ক্ষেত্রে, তাঁর শত্রু ইয়েলৎসিনের সমাধি থেকে কিছুটা দূরে। আসলে উনি অনেক আগেই এদেশের মানুষের কাছে মরে গেছিলেন। হয়তোবা তাঁর ভুলের জন্য ন্যাটোর সম্প্রসারণ না ঘটলে, রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে নতুন করে ঠাণ্ডা গরম  যুদ্ধের সূচনা না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন অনেকেই তাঁকে ক্ষমা করে দিত। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তিনি একেবারেই সর্বশান্ত।

 

কোন দেশের নেতা আসলে যে দেশের নেতা সেই দেশের মানুষের ভালো-মন্দ দেখাই তার প্রধান কাজ। যখন সে সেটা করতে পারে না তখন সে কাজ খুঁজে বাইরে। এ কারণেই গর্বাচভ যখন নাকি দেশের সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হন উনি বহির্বিশ্বের দিকে নজর দেন। হয়তো এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করেছিলেন ইতিহাসের পাতায়। সব কিছুর পরেও আমাদের দেখার সীমাবদ্ধতা ছিল। আমরা মূলত নিজ নিজ শহর বা শহরাঞ্চলের মানুষের দেখা পেতাম, তাদের মতামত পেতাম। দেশের অধিকাংশ মানুষ আমাদের অজানা ছিল। ডেফিসিট নিঃসন্দেহে বিরাট রোল প্লে করেছে কিন্তু আরও অনেক কারণ ছিল যা এড়ানো সম্ভব ছিল বলেই অনেকের ধারণা। অন্তত পরবর্তী কালে অনেককেই বলতে শুনেছি যে গর্বাচভের অযোগ্য নেতৃত্বই এমনটা ঘটার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।   গর্বাচভ সমস্যা সমাধানের চেয়ে নিজের ইমেজ নিয়ে রেশি চিন্তিত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি ইন্টারভিউ দিতেন কিন্তু কোন জায়গায় নিজের ভুল স্বীকার করেননি। তাঁর বক্তব্যের মূল কথা ছিল তিনি যা করেছিলেন সব ঠিক কিন্তু ইয়েলৎসিন ও অন্যান্যরা সেটাকে সাবটেজ করেছেন। এই যে একটা দেশ নাই হয়ে গেল, হাজার হাজার মানুষ মারা গেল, দেশান্তরী হল লাখ লাখ – সেই দায়িত্ব গ্রহণ করার ব্যর্থতাই কি প্রমাণ করে না যে তিনি নেতা হিসেবে মোটেই যোগ্য ছিলেন না। যার দোষেই হোক, নৌকার কাণ্ডারি ছিলেন তিনি, তাঁরই কথা ছিল নৌকা নিরাপদে ঘাঁটে ভেড়ানোর। তাহলে? পেরেস্ত্রোইকা, গ্লাসনস্ত, নভোযে মিশলেনিয়ে – এসবই ছিল সত্যিকার অর্থেই গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলমান   সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক দেশটি নিরাময় করার ঔষধ। রোগী যখন মৃত তখন ডাক্তারের সাফল্যের কথা বলা কষ্টকর। তারপরেও যদি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা হত হয়তো অন্যভাবে তার ঐ ব্যর্থতার মূল্যায়ন করা যেত। কিন্তু এই যে এত মৃত্যু, এত যুদ্ধ, এককেন্দ্রিক বিশ্ব, যা তার অযোগ্যতা বা বোকামির ফল সেই দায়িত্ব কে নেবে?

 

কিন্তু আমাদের কি কিছুই শেখার নেই এই ঘটনা থেকে? শুধু গর্বাচভের কাঁধে সমস্ত দোষ চাপিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব? অনেকেই বলেন, আমি নিজেও বিশ্বাস করি বর্তমানে বিশ্বে যা ঘটছে তার পেছনে আছে পশ্চিমা বিশ্বের বিশ্বাসঘাতকতা বা কথা না রাখা। তারাই গর্বাচভকে কথা দিয়েছিল ন্যাটো এক ইঞ্চিও সম্প্রসারণ না করার ব্যাপারে। কিন্তু তারাই তাদের কথা ভঙ্গ করেছে। অনেকেই বলেন তারা তো কোন লিখিত অঙ্গীকার করেনি। ভদ্রলোকের মুখের কথাই যথেষ্ট। আমরা তো তাদেরকেই জানি ভদ্র বলে। পশ্চিমা বিশ্বকে জানি সভ্য বিশ্ব বলে, সভ্যতা, ভদ্রতার ধারক ও বাহক বলে। তাহলে কি তাদের বিশ্বাস করা ঠিক নয়? তাই তো দেখছি। তারাই বাংলার চুয়াল্লিশের মন্বন্তরের জন্য দায়ী। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ তাদের তৈরি। পঁচাত্তরের মুজিব হত্যা – সেটাও কি তাদের কাজ নয়? অথবা পদ্মা সেতু নিয়ে নাটক। সাদ্দাম, গাদ্দাফি যারাই তাদের বিশ্বাস করেছে তারাই খুন হয়েছে। ইনুকোভিচ কি তাদের রাজনীতির শিকার নয়? আর সার্বিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইউক্রেনের লাখ লাখ মানুষ। আমেরিকান ইন্ডিয়ান থেকে শুরু করে মীর জাফর হয়ে ইনুকোভিচ পর্যন্ত কারো সাথে তারা কথা রাখেনি, তারা কথা রাখে না। চার্চিল তো এমনিতে বলেননি যে তাদের কোন মিত্র নেই আছে জাতীয় স্বার্থ। পশ্চিমা বিশ্ব যখন অন্য দেশের সাথে কোন চুক্তি করে আসলে তারা সময় নেয় পরে সময় মত ছোবল মারার জন্য। তারা হয় অন্যদের বাধ্য করে নিজ দেশের জন্য আরও অপমানজনক শর্তে সেই চুক্তি রক্ষা করতে অথবা নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে। তাদের সাথে কোন চুক্তি মানে বন্ড সই করা যা নিজের দেশকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। তাহলে কি চুক্তি করব না? করব, তবে মনে রাখতে হবে এটা সাময়িক, তারা যেমন সময় খুঁজছে ছোবল মারার জন্য অন্যদেরও তেমনি সময় খুঁজতে হবে এই নাগপাশ ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার জন্য। এটাই হোক গর্বাচভের ব্যর্থতা থেকে আমাদের প্রধান শিক্ষা।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো