মতামত

গাঁজা উদ্ধার – আদালতের রায় এবং কিছু প্রশ্ন। …

-অপু সারোয়ার

অপু সারোয়ার (ফাইল ছবি)

এক

বিরাজিত সমস্যা সমাধানের জন্য আইন -আদালত মানুষের  আশ্রয়।  নির্ধারিত আইন-কানুনের  আওতায় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত কোন বিচারাধীন মামলার রায় নির্ধারণ করে। দন্ড বিধির কোন ধারায় সম্ভাব্য কি সাজা হতে পারে তা স্পষ্ট ভাবে নির্ধারিত রয়েছে। প্রচলিত দন্ড বিধি মোতাবেক খুনের মামলার সম্ভাব্য কি সাজা হতে পারে তা নির্ধারিত। ঠিক একই ভাবে চুরির মামলার সম্ভাব্য কি সাজা হতে পারে তা নির্ধারিত। চুরির মামলার আসামীর যেমন খুনের মামলার সাজা হতে পারে না। তেমনি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত খুনের মামলার আসামির চুরির মামলার শাস্তি হতে পারে না। প্রচলিত দণ্ডবিধিতে এই বিষয় গুলি স্পষ্ট ভাবে বিধিবদ্ধ।

সম্প্রতিক দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত  সংবাদ গাঁজা উদ্ধারের মামলায় দুই আসামি দোষ স্বীকার করায় সাজার পরিবর্তে এক বছর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত পাশাপাশি দুটি এতিমখানায় দুজন এতিমকে বাংলা অনুবাদসহ দুটি কোরআন শরিফ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুই আসামি হলেন মোহাম্মদ হোসেন আবদুর রহিম সোমবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলাম রায় দেন  বিষয়টি নিশ্চিত করে আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আগের কোনো মামলা নেই সাধারণত এসব মামলায় এক বছরের সাজা হয়ে থাকে আসামিদের সংশোধনের জন্য শর্তসাপেক্ষ আদালত সাজার পরিবর্তে নির্দেশ দেন প্রবেশন কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে থাকবেন আসামিরা ”  ( ৩০ অগাস্ট ২০২২ )

বাংলাদেশের প্রচলিত দন্ড বিধি ব্রিটিশ আমলে প্রণীত। বিগত ৭৫ বছরে বিভিন্ন সময় কিছু সংযোজন – বিয়োজন হয়েছে। তবে মৌল কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে নাই। গাজা রাখার মত  মামলা গুলি দন্ড বিধিতে ফৌজদারী মামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটিশ প্রণীত আইন গুলির বিভিন্ন সমালোচনা রয়েছে। তবে এই আইন-কানুন ও সাজা ধর্ম নিরেপেক্ষ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।  অপরাধের আইনে যা সংজ্ঞায়িত করা আছে বা যে শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে তার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন বা সংশোধনের কোনো এখতিয়ার আদালতের নেই।  এই রায়  দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট – নিম্ন আদালত। নিন্ম আদালতে সংবিধান বা আইন নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

মাদকাসক্তি একটা ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। মাদকাসক্তি পরিবার ও সমাজকে ধ্বংস করে। বাংলাদেশ এই সমস্যায় জর্জরিত। মাদকের কুফলের পরিধি ব্যাপক। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে মাদকের কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশের সমাজে । মাদকের কারণে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বহু পরিবার ধ্বংস হচ্ছে। অকালে ঝরে  যাচ্ছে বহুতাজা প্রাণ। সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। লক্ষ তরুণ কর্মশক্তি, মেধা ও সৃজনশীলতা হারিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়। অনেক সময় বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। দূরে ঠেলে দেয় আপন জনকে। ভেঙ্গে যায় পরিবার। মাদকাসক্তি কারণ বহুবিধ। জনসংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চাইতেও বেশি-দরিদ্র, বেকারত্ব, কর্ম সংস্থানের অভাব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক মন্দাভাব, হত্যা, সন্ত্রাস সহ হাজারো সমস্যায় মানুষ যখন নাজেহাল তখন মাদকাসক্তির মত  বিষয় গুলির  বিস্তার করে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি একদিকে যেমন অনুউৎপাদনশীল।  তেমনি নানা ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করছেন। মাদকাসক্ত ব্যক্তি আমাদের সমাজের মানুষ। সর্ব সাধারণের সন্তান। গণ সচেতনতাই মাদক সমস্যা উত্তরণের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পথ। গণ সচেতনার পাশাপাশি মাদকের উৎসকে আইন গত ভাবে বিচারের মাধমে বন্ধ করার বিকল্প নেই।  “ কারাগারের যে হাজতিরা রয়েছে তাদের অপরাধের দিকে তাকালেও মাদকের ভয়াবহতা টের পাওয়া যাবে সারা দেশের হাজতির ৭৫ শতাংশই মাদক মামলা সংক্রান্ত আসামি (( সূত্র : মানব জমিন ১ মার্চ ২০২২ )

 

গাঁজা – একটি মাদক। অপেক্ষাকৃত সস্তা ও সহজ লভ্য মাদক। মাদকের চাহিদা আছে, তাই সরবরাহও আছে৷ আর এই সরবরাহ বন্ধ করতে না পারলে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না ৷ আদালত যখন কোন বিষয়ে রায় দেয় সেই রায় কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আদালত -পুলিশ – কারাগার একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।  চট্টগ্রামের আদালত দুই গাঁজা সরবরাহকারীদের এক বছর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার আদেশ দিয়েছেন। প্রথমত এই জাতীয়  আদেশটি শুধু মাত্র একটি সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য। অন্য কোন সম্প্রদায়ের একই অপরাধের জন্য এই সাজা দেওয়া সম্ভব নয়। সেই ক্ষেত্রে আইন -আদালতের সার্বজনীনতা  ক্ষুন্ন হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ অপরাধ স্বীকার কারীরা যে  পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত পড়বেন তা পর্যবেক্ষণের কোন সুযোগ নেই। দণ্ডিত এই দুই ব্যক্তি কি সত্যিই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন তার খোঁজ রাখার জন্য দুইজন সার্বক্ষণিক আদালত বা প্রশাসন নিযুক্ত লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে। যা ব্যায়বহুল ও নানা বিধ প্রায়োগিক জটিলতার রয়েছে।

সমসাময়িক সময়ে সারা দেশে প্রচুর পরিমানে মাদক মামলা রয়েছে। বিচারাধীন মামলার শতকরা ৭৫ ভাগ মাদক মামলা। বিদ্যমান মাদক মামলা গুলি চট্টগামের এই মামলার আলোকে বিচার প্রত্যাশা করলে করতেই পারে। এই মামলার আলোকে অন্য মাদক মামলার বিচার হওয়া শুরু হলে বিদ্যমান দন্ড বিধি ও বিচার প্রক্রিয়ার সাথে ছেদ ঘটবে। একজন মানুষ নামাজ পড়লেই বা বেশ ভুষায় ধার্মিক হওয়া লক্ষণ থাকার পরেও মাদক কিংবা আরো গুরুতর অপরাধের সাথে যুক্ত হতে পারে।  কক্সবাজারে কোরান শরীফের ভেতরে লুকিয়ে ইয়াবা পাচারের  ঘটনা কিংবা মাথার পাগড়ির মধ্যে ইয়াবা পাচারের সংবাদ বহুল আলোচিত । ( সূত্র  বিবিসি ১৫ মার্চ ২০১৮ ), করোনাকালে লাশবাহী গাড়িতেও মাদকের চালান-  (প্রথম আলো  ২৪ জুন ২০২০, ) এর মত ঘটনা রয়েছে।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়,  গত ২২ মে বন্দর থানার পোর্ট কলোনি ১ নম্বর রোডের নতুন মার্কেট জামে মসজিদের সামনে থেকে এক কেজি গাঁজাসহ মোহাম্মদ হোসেন ও আব্দুর রহিমকে গ্রেপ্তার হয়। আদালতে দুই আসামি   দোষ স্বীকার করেন। জামে মসজিদের সামনে থেকে গাঁজা সহ গ্রেফতার হওয়া থেকে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে আসামীরা মসজিদ ও মুসুল্লিদের সাথে মিশে গিয়ে মাদক ব্যবসা করছিল। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠতে পাড়ে যে মানুষ শুরুতেই  ধর্মীয় ভাব -গাম্ভীর্যতাকে তোয়াক্কা না করেই মসজিদের সামনে মাদক ব্যবসা করছিল , সেই  মানুষদের ধর্মীয় অনুশাসন পালনে বাধ্য করে কতটুকু সুফল পাওয়া সম্ভব।  ধর্মীয় বিধিনিষেধ প্রয়োগ ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা দেয় না।  পুরোনো বাংলা প্রবাদ ‘ চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। ‘

 

দুই

একই আদালত এর আগেও ধর্মীয় পক্ষপাত মূলক রায় দিয়েছেন।  দৈনিক সমকাল এর ভাষ্যানুযায়ী -” এর আগে কারাদণ্ডের বদলে আদালত বিনা বেতনে যে সংগীতশিল্পীকে শিক্ষার্থীদের গান শেখানোর নির্দেশ দেন তার নাম ফাহমিদা রহমান তিনি বাংলাদেশ বেতার টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী ফাহমিদা চট্টগ্রাম ওয়াসায় চাকরি করেন তার বিরুদ্ধে এক মানহানির মামলার রায়ে আদালত বলেন, ছয় মাসের কারাদণ্ডের বদলে তাকে ছয় মাস বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের গান শেখাতে হবে তাকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দুটি গান ফ্রি গাইতে হবে অথবা দুটি গানের সম্মানী নিয়ে সেই টাকায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বা তাকে নিয়ে লেখা বই কিনে তা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দিতে হবে এসব কর্ম সম্পাদিত হয়েছে কিনা, সমাজসেবার প্রবেশন কর্মকর্তা আদালতকে জানাবেন – ( দৈনিক সমকাল -৩০ আগস্ট ২২ )

এই মামলার মোদ্দা কথা হচ্ছে জনৈক শিল্পীর বিরুদ্ধে একজন মানহানির মামলা দায়ের করেছিল। এই মামলার রায় – ফলাফল  হচ্ছে অভিযুক্তাকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখানোর আদেশ । মামলার ফলাফল কোন ভাবেই মানহানির বিষয় আমলে নেয় নাই। অভিযুক্তা অন্যকে গান শেখানোর মধ্য দিয়ে কারো মানহানীর ঘটানোর প্রতিকার হয় নাই। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। উভয়ের ক্ষেত্রেই নৈতিকতার বিষয়টি প্রযোজ্য। একজন শিক্ষার্থী যখন জানবেন , যিনি বিনা পারিশ্রমিকে গান শিখতে উদ্দ্যোগী তিনি আদালতের নির্দেশে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই তথ্য জানার পরে শিক্ষার্থীর ভক্তি শ্রদ্ধা কিছুটা হলেও উবে যাবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য খর্বিত হয়ে পড়বে।

অভিযুক্তকে দুটি গানের সম্মানীর   টাকায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বা তাকে নিয়ে লেখা বই কিনে তা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক প্রশ্ন কেন কবি  কাজী নজরুল ইসলাম কেন অন্য কবি বা লেখকের বই নয় ? আদালতের এই আদেশ পালনের মধ্য দিয়ে মানহানির অভিযোগের কোন সুরাহা হয় নাই। গাঁজা উদ্ধার ও মানহানির মামলায় আদালত সাজার পরিবর্তে যে আদেশ – রায় ও পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও আস্থা রেখে সকল নাগরিকের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন সমুন্নত থাকবে এ প্রত্যাশা।