বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা: মিখাইল গর্বাচভ  

-বিজন সাহা (৬১)

মিখাইল গর্বাচভ – সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ও শেষ প্রেসিডেন্ট, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ৩০ আগস্ট ২০২২ মারা গেলেন এবং বলতে গেলে মরেই তিনি নতুন করে খবর হলেন। অনেকেই বলছে একটা যুগের অবসান হল। আমার মনে প্রশ্ন জাগে নাকি তিনি নিজে মরার অনেক আগেই একটা যুগ, একটা সামাজিক পরীক্ষা, একটা স্বপ্ন যাকে ঘিরে বিশ্বের দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতেন কল্পনায় তাকে নিজ হাতে হত্যা করেছিলেন? রাজনৈতিক আকাশে তাঁর আগমন ছিল অনেকটা ধূমকেতুর মতই অপ্রত্যাশিত। হয়ত সেজন্যেই তিনি বিশ্বকে চমক দিতে চেয়েছিলেন অনেকটা জাদুকরের মত। ফলাফল – বিশ্বের মানচিত্র থেকে একটি দেশ ভেল্কিবাজির মত উধাও হয়ে গেল, আশা ভঙ্গ হল কোটি কোটি মানুষের, মরল লাখ লাখ। এখনও মরছে। বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে বলা যায় তিনি যে দেশ, যে পৃথিবী পেয়েছিলেন অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে নিজের অতিবিশ্বাসের ফলে সেটা হারিয়েছেন। কারণ যে কর্মযজ্ঞ তিনি শুরু করেছিলেন সেটা শেষ করার মত বিচক্ষণতা, জ্ঞান ও মানসিক শক্তি কোনটাই তাঁর ছিল না। ফলে রুগী তো নিরাময় হয়ই নাই বরং তার অকাল মৃত্যু ঘটেছে। মানুষ মরণশীল। কেউ মারা গেলে সে যে মারা গেছে সেটা বলার মধ্য দিয়ে কাজ শেষ করা যায়। সাধারণত বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে সেটা বলা হয়। যদি সুস্থ ও অল্প বয়স্ক কেউ মারা যায় প্রশ্ন করে কেন মারা গেল, তাকে বাঁচানো আদৌ সম্ভব ছিল কিনা? মৃত্যু কি অবশ্যম্ভাবী ছিল? আর যদি ব্যধি দুরারোগ্য হয় তবে মানুষ জানার চেষ্টা করে কিভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। মানুষের মত যেকোনো সমাজ বা দেশের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। তাই গর্বাচভের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আসবে আর এসব প্রশ্ন আসবে তার ব্যর্থতার কারণে। মানুষ যখন কোন পরিকল্পনা নিয়ে কাজে নামে শুধুমাত্র সেটা বাস্তবায়িত হলেই আমরা তাঁকে সফল বলতে পারি। কিন্তু যদি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হয়, পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয় সেটাকে কোন ভাবেই সাফল্য বলা যাবে না, এমনকি যদি বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে অন্য কোন ভালো ফলাফল পাওয়া যায়ও।

অনেক দিন থেকে, বলতে গেলে সেই ২০১৪ সাল থেকেই রাশিয়ার বিভিন্ন টক শোর এক বিরাট অংশ দখল করে থাকে ইউক্রেন। একবার বন্ধু ভিক্তরকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ইউক্রেন নিয়ে তোমাদের এত কথা কিসের? কেন সব সময় ওদের নিয়ে কথা বল?” ও বলল “দেখ, এদেশের মানুষ বেলারুশ ও ইউক্রেনিয়ানদের খুব কাছের মানুষ মনে করে। যদি এ নিয়ে টিভিতে কথা না বলে মানুষ বিভিন্ন গুজব ছড়াতে শুরু করবে। কারণ এটা সত্যি সত্যি খুব স্পর্শকাতর বিষয়। তাই সরকার এ নিয়ে কথা বলে, তাদের মনোভাব জানাতে চায়। বিভিন্ন মতের মানুষদের এখানে ডাকে। শুধু রাশিয়ারই নয়, ইউক্রেন, বেলারুশ, পোলিশ, জার্মান, আমেরিকান, চেক – সব দেশের বিশেষজ্ঞরা থাকে। তর্ক বিতর্ক হয়। মানুষ বিভিন্ন মতামত শোনে। অন্তত পক্ষে ইনফরমেশন ভ্যাকুমে থাকে না।”

গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্পেশাল মিলিটারি অ্যাকশন শুরু হবার পর থেকে এ নিয়ে কথা বেড়েছে। মূল চ্যানেলগুলো প্রায় সারাদিন এ নিয়ে আলাপ করে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন রিপোর্ট দেখায়, দেখায় ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর। দেখায় সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার। স্বাভাবিক ভাবেই চেষ্টা করে বিদেশি খবর অসত্য আর নিজেদের খবর সত্য প্রমাণ করার। তবে যেহেতু দুই পক্ষের খবরই থাকে কেউ চাইলে নিজের মত করে সেটা ইন্টারপ্রেট করতে পারে। অর্থাৎ এর মধ্য থেকে সত্যের কাছাকাছি একটা ভার্সন ঠিক বের করা যায়।

এদেশের মানুষ কাজেকর্মে, অফিসে, ক্যাফেতে এসব নিয়ে তেমন একটা কথা বলে না। হতে পারে আমি নিজে হয়তো সেরকম কোম্পানিতে চলি না। সত্যি বলতে আমি নিজে প্রায় সব সময়ই একা থাকতে পছন্দ করি। তবে কেউ কিছু বললে সেটা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। আমাদের দেশের লোকজন ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে যত আগ্রহী এদের কখনই ততটা মনে হয়নি। অনেকের মতে এটা সৈনিকদের আর রাজনীতিবিদদের কাজ। ওরা করুক। আমাদের যদি ডাকে – সাধ্য মত চেষ্টা করব। তার মানে এই নয় এরা দেশের ভাগ্যের ব্যাপারে নিঃস্পৃহ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে ঐক্য সৈনিক, জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে গড়ে উঠেছে সেটা অভূতপূর্ব।

যেহেতু গত আট বছর ধরে দনবাসের মানুষ ইউক্রেন উগ্রবাদীদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে তাই অনেকেই সরকারের নিষ্ক্রয়তায় বিরক্ত ছিল। মনে রাখতে হবে যে এরাই কিন্তু সরকার ক্রিমিয়াকে রুশদেশের অন্তর্ভুক্ত করলে তাকে ব্যাপক ভাবে সমর্থন করেছিল। এটা ভূখণ্ডের কারণে নয় – মানুষের মুক্তির জন্য। তাই শেষ পর্যন্ত সরকার যখন সৈন্য পাঠায় দনবাসে ব্যাপক মানুষ এটাকে ন্যায় যুদ্ধ বলে মনে করে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই অনেকের মধ্যে বিরক্তি আসছে। তার কারণ ইউক্রেন প্রতিদিন আবাসিক এলাকায় আঘাত হানছে আর তাতে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে। আমার স্ত্রী গুলিয়াকেও দেখি আজকাল প্রায়ই বিরক্তি প্রকাশ করতে। বিশেষ করে যখন টক শোতে কেউ বলার চেষ্টা করে এসব সমস্যার শুরু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে। আর তখন গুলিয়া এসব শুনে সবার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে। পুতিনও বাদ পড়ে না। ওর কথা “সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যদি সব সমস্যার মূল তবে যারা দেশ ভাঙলো তারা কেন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়? গর্বাচভকে কেন বিচারের আওতায় আনা হয় না। এই যে আমার নিজের ভাই আর তিন কাজিন মারা গেল কাজের অভাবে সে দায় কাদের?” এই প্রশ্ন ওর একার নয়, এই প্রশ্ন লাখ লাখ সোভিয়েত মানুষের। ভারত বিভাগ স্বাধীনতা এনেছিল কিন্তু তাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, যার সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক ছিল না, লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, বাস্তু হারা হল কোটি কোটি মানুষ সেই দায়িত্ব কিন্তু কেউ নেয় না। এখানেও তাই। যারা দেশ ভাঙল, যাদের ভুল রাজনীতির কারণে লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, বাস্তুহারা হল লাখ লাখ মানুষ তারা হয় আজও ক্ষমতায় অথবা বেকসুর খালাস। আমরা যারা দূর থেকে বিচার করি, যারা নিজেদের ছাত্র জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে পেরেস্ত্রোইকার বিচার করি তাদের কথা এক রকম আর যারা এর ভুক্তভোগী তাদের কথা আরেক রকম। সাধারণ মানুষ খুব বেশি কিছু চায় না। তা সে যে দেশেই হোক। তারা চায় মাথা গোঁজার ঠাঁই, সন্তানদের শিক্ষা চিকিৎসা চাকরি এসব। এক কথায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরেকটু সুন্দর ভবিষ্যৎ। এটা ভালো বা মন্দ নয়। এটা জীবন। এরা যাকে বলে অল্পে সন্তুষ্ট। এরা নিষ্ক্রিয় জনতা সেই অর্থে যে তারা গতানুগতিক ভাবে জীবন কাটাতে চায়। সব সমাজেই কিছু অতি রকম সক্রিয় মানুষ থাকে যাদের বলা হয় প্যাশনারী বা অনুরাগী মানুষ – যারা সব পুরাতন বাঁধ ও বাধা ভেঙ্গে নতুনের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে আর এদের হাত ধরেই ঘটে সামাজিক বিপ্লব, সামাজিক পরিবর্তন। এদের সংখ্যা খুব কম। তবে এরাই সমাজের চালিকা শক্তি। কিন্তু অধিকাংশ সোভিয়েত মানুষ ছিল নিষ্ক্রিয় জনতা। তাদের ছিল ফ্রি শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, চাকরি আর কমবেশি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর সুদূর ভবিষ্যতে সাম্যবাদের স্বপ্ন। আর ছিল ডিফিসিট বা পণ্যের অপ্রতুলতা, পণ্যের অভাব। এখন পণ্য অঢেল, ডেফিসিট অর্থের – টাকার অভাব ও জীবনের অর্থের অভাব। এটা ঠিক বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, দোকানে দোকানে অঢেল পণ্য সবার জন্যই এসেছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষের জন্য এসেছে দারিদ্র্য, অর্থাভাব। যদিও এখন ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি ঘটছে, কিন্তু নব্বুইয়ের দশকে অনেকেই হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে, হারিয়েছে তাদের স্বপ্ন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে তারা পরবর্তী জীবনে যতই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, সেই দুঃসময়ের কথা আজও ভুলতে পারে না, ভুলতে পারেনি এরাও। তাই শুধুমাত্র বড় বড় শ্লোগান দিয়ে সেই সময়ের বিচার করলে হবে না, বিচার করতে হবে মানুষের রক্ত, কান্না, ঘামে ধুয়ে।

গর্বাচভকে অনেকেই শান্তির দূত বলে মনে করে। এটা ঠিক তাঁর প্রচেষ্টাতেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটেছে, বিশ্বের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু তাঁর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে একের পর এক জ্বলে উঠেছে যুদ্ধের আগুন। জর্জিয়ার গৃহ যুদ্ধ, আর্মেনিয়া আজারবাইজানের যুদ্ধ, বাল্টিকের দেশে দেশে বিদ্রোহ, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জাতিগত যুদ্ধ – যা তুষের আগুনের মত আজও জ্বলছে। এমনকি বর্তমানের ইউক্রেনের যুদ্ধ এটাও অতীতের ভুল রাজনীতির ফল। মার্গারেট থ্যাচার বলেছেন গর্বাচেভ পারমাণবিক অস্ত্রের পরিপূর্ণ বিলুপ্তির পক্ষে ছিলেন কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তাতে রাজি হয়নি কারণ এতে ট্র্যাডিশনাল যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দুই জার্মানির একত্রীকরণে আমেরিকা, বৃটেন ও ফ্রান্স রাজী ছিল না অতীতের দু দুটো মহাযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। এমনকি পশ্চিম জার্মানি নিজে পর্যন্ত বিরুদ্ধে ছিল এত দ্রুত একাজ করতে। জার্মানি চেয়েছিল এই মিলন ধীরে ধীরে ঘটাতে। কিন্তু গর্বাচেভের কারণে সেটা তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে তিনি পূর্ব জার্মানির নেতাদের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি। এর ফলে এরিখ হোনেকারকে পর্যন্ত জেল খাটতে হয়েছে। একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ এ ধরণের কাজ করেন না। এটা শুধু রাজনীতির প্রশ্ন নয়, মানবতার প্রশ্ন। যারা পূর্ব জার্মানির নেতৃত্বে ছিলেন তারা সেই দেশের প্যাট্রিয়ট ছিলেন। তারা তাদের কাজ করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা অনেক কিছুই করেছেন সোভিয়েত নেতৃত্বের প্রেস্ক্রিপশনে।

রাজনীতি প্রেম করা নয়। এখানে আবেগের সুযোগ কম। বিশেষ করে প্রতিপক্ষের সাথে। এটা খুব সুক্ষ্ম ক্যালকুলেশনের ব্যাপার। রিগ্যান বারবার বলেছেন দোভেরিয়াই নো প্রোভেরিয়াই মানে বিশ্বাস কর তবে যাচাইও কর। কিন্তু গর্বাচেভ কখনোই যাচাই করেননি শুধু বিশ্বাস করেই গেছেন। তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে ব্যক্তি গর্বাচেভকে ভালোবাসাতে পেরেছিলেন কিন্তু রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভালোবাসাতে পারেননি। তাই তাঁকে পশ্চিমা বিশ্ব বন্ধু হিসেবে মেনে নিলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে নেয়নি। আজকে বিশ্বের অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে গর্বাচভের সারল্য বা সঠিক ভাবে বললে নির্বুদ্ধিতা। তিনি পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের চিট করেছে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে তিনি নিজে তাদের সেই সুযোগ দিয়েছেন। নিজের বোকামির দোষ নিজেকেই নিতে হয়, অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ নেই। কিন্তু সমস্যা হল তার ফল ভোগ করছে আজ সারা বিশ্ব।

কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করে সব পরিবর্তনশীল কিন্তু তাদের নেতারা ছিলেন অপরিবর্তনীয়। সেই যে ব্রেঝনেভের নাম শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে তিনিই পার্টি তথা রাষ্ট্রের প্রধান। আমি ইতিমধ্যে স্কুল শেষ করে কলেজ শেষ করার পথে। একই কথা বলা চলে কোসিগিন, মাও এদের ক্ষেত্রে। ব্রেঝনেভের মৃত্যু প্রমাণ করল যে সোভিয়েত নেতারাও মরণশীল। তাই আন্দ্রোপভ বা চেরনেনকোর মৃত্যু অকস্মাৎ ছিল না। আসলে টিভিতে তাদের দেখে মনে হত এক পা তাঁরা মৃত্যুপুরীতে রেখেই ক্ষমতায় বসলেন। ফলে চেরনেনকোর জীবদ্দশায়ই এরপর কে সেই জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। সোভিয়েত বন্ধুরা অধিকাংশ রোমানভের নাম বলতেন। তখন দেয়ালে দেয়ালে পার্টির পলিটব্যুরোর যে ছবি থাকতো তাতে তিনি পঞ্চম স্থানে। লেনিনগ্রাদের পার্টি প্রধান। অনেকের মতে জার বংশোদ্ভূত। তবে সেটা ঠিক নয়। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। এ জন্যেই শুরুতে বলেছিলাম গর্বাচভের উত্থান ছিল অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত। তারপরেও তিনি জনসমর্থন পেয়েছিলেন। কেন? ব্রেঝনেভ, আন্দ্রোপভ, চেরনেঙ্কো সবাই বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছিলেন সেখানে ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সের গর্বাচভ ছিলেন তরুণ। এদেশের মানুষ তখন পরিবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, যেকোনো পরিবর্তনকেই তারা স্বাগত জানাচ্ছিল, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল পার্টি যা করবে তাদের মঙ্গলের জন্যই করবে। এর আগে তারা কোন নেতাকে দেখেনি সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে। তারা ছিলেন দেবতাদের মত – গ্রহান্তরের মানুষ। সেখানে গর্বাচভ অনায়াসে মানুষের কাছে যেতেন, নিজে বলতেন, তাদের কথা শুনতেন। এখন অবশ্য পেছনের দিকে তাকালে সেটা অন্যভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছোট বাচ্চা যখন সবে কথা বলতে শেখে তখন সে কী বলছে তা বড় কথা নয়, সে যে বলছে সেটাই আসল। কিন্তু একটু বড় হলে সবাই জানতে চায় সে কী বলছে। ফলে প্রথম দিকে গর্বাচভের সাবলীল কথা শুনতে ভালোই লাগত, কিন্তু অচিরেই সেই ভুল ভাঙে। মানুষ বুঝতে পারে তিনি রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মত – অনেক কথা বলে গেলেও আসলে কোন কথাই বলছেন না, তাই তারা ধীরে ধীরে তাঁর কথা বোঝার আশা জলাঞ্জলি দেয়।

কেন এমন হয়? এ নিয়ে আমরা কথা বলব পরের পর্বে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো