চলমান সংবাদ

নিরাপদ নারী অভিবাসন কতদূর?

কাজের জন্য অন্য দেশে পাড়ি দিয়ে অনেক সময় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন কেউ৷ কেউ বা মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়েন৷ পাচারকারীদের মূল টার্গেট নারীরা৷ আন্তর্জাতিক মানবপাচার প্রতিরোধ দিবসে বিশেষ প্রতিবেদন৷

ভারতে পাচার হওয়া প্রায় দুই হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ ভারতে পাচার হওয়া প্রায় দুই হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷

সৌদি আরব থেকে ফিরে আসাএকজন নারী বলেছিলেন, ‘‘জানুয়ারি মাসে এক দালালকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলাম৷ সেখানে যে বাসায় কাজ দেওয়া হয়েছিল সেখানে মালিক খেতে দেয় না, মারধর করে৷ তিন দিন বাথরুমে আটকে রেখেছিল৷ একদিন রাতে তার ঘরে আমাকে ডেকে নেয়৷ আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতন করে৷ এরপর তার নির্যাতন বেড়ে গেলে একদিন সুযোগ বুঝে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই৷ অনেক কষ্টে বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলাম৷ ১৫ দিন দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে থাকার পর দেশ থেকে ২২ হাজার টাকা পাঠালে তারা আমার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে৷” এভাবেই নিজের নির্যাতনের কথা জানান তিনি৷

সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মাকসুদা বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিদেশ থেকে ফিরে আসা নারী কর্মীদের নিয়ে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ৮০ ভাগ নারী জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো- বিএমইটিকে না জানিয়েই দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছে৷ ফলে তারা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন৷ কল্যাণপুরের একটি বস্তিতে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, সেখানে গত ৬ মাসে যত নারী বিদেশে গেছেন তাদের ৯৫ ভাগই দেশে ফিরে এসেছেন৷

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই শনিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস৷ বিএমইটির তথ্য মতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২২-এর মে মাস পর্যন্ত ১০ লাখ ৫০ হাজার ৮১৯ জন নারী অভিবাসী হয়েছেন৷ যাদের অনেকের নির্যাতনের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য মতে, ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন ১২ জন নারী৷ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরেছেন ৬৫ জন৷

ব্র্যাকের অভিভাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নিরাপদ নারী অভিবাসন এখন সময়ের দাবি৷ এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, গ্রামের একজনকে নারীকে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ এই নারী হয়তো কোনোদিন ঢাকাতেই আসেননি৷ তিনি সেখানের ভাষা বোঝেন না, খাবারের সঙ্গে পরিচিত না, সেখানে তিনি কীভাবে নিজেকে সামলে নেবেন? আমাদের যত নারী বিদেশে আছেন তার অর্ধেকই সৌদি আরবে গিয়েছেন৷ এখন প্রশিক্ষণ দিয়ে যদি তাদের পাঠানো হয় এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা যায় তাহলেই একমাত্র নিরাপদ নারী অভিবাসন সম্ভব৷

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন করে৷ এই আইনে ২০১২ থেকে গত জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ৫২০ টি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলায় দেখা গেছে, তেরো হাজারেরও বেশি মানুষ পাচারের শিকার৷এতে মোট আসামীর সংখ্যা সাড়ে ৩১ হাজারেরও বেশি৷ কিন্তু ৬ হাজার ৫২০টি মামলার মধ্যে গত দশ বছরে মাত্র ৭২৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে৷ এর মধ্যে মাত্র ৫০টি মামলায় মাত্র ৯৬ জনের সাজার হয়েছে৷ বাকিরা অব্যাহতি পেয়ে গেছেন৷ বাকি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মামলা এখনো চলমান৷ মামলা নিষ্পত্তির হার এগারো শতাংশ৷ আর সাজা হয়েছে দুই শতাংশেরও কম৷ ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঠিক সময়ের মধ্যে বিচার কাজ শেষ না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে৷

কেন বিচারে এত দীর্ঘসূত্রতা? জানতে চাইলে আইনি সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মহিলাআইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিয়ে করে অনেক স্বামী স্ত্রীকে বিক্রি করে দেয় দালালদের কাছে৷ অনেকেই স্বামীর সঠিক নাম ঠিকানা বলতে পারেন না৷ তারা দরিদ্র, তাই অর্থাভাবে মামলা চালিয়ে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাছাড়া মামলার ক্ষেত্রেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা৷ পাচার আইনে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর নিরাপত্তার বিষয়টি থাকলেও লোকবলের অভাবে তা সম্ভব হয় না৷ পক্ষান্তরে পাচারকারী চক্র প্রভাবশালী হয়৷

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ওয়ার্ক ফ্রি ফাউন্ডেশনের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন মতে, পাচার হওয়া ভুক্তভোগীদের ৭১ শতাংশ নারী ও মেয়ে শিশু এবং ২৯ শতাংশ পুরুষ ও ছেলে শিশু৷ শনিবার আন্তর্জাতিক মানব পাচার প্রতিরোধ দিবসউপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকশন বলেন, ‘‘প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেমন পাচারকারী ব্যক্তিরা তাদের কাজ করছেন, আমরাও প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর বিরুদ্ধে সোচ্চা হতে পারি৷ মহামারির কারণে পাচারের সংখ্যা বেড়ে গেছে৷অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও পাচার অন্যতম সমস্যা৷ পাচার রোধে আমরা বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি৷আমরা প্রায় ৩০ হাজার নারীকে অবৈধভাবে পাচার রোধে প্রশিক্ষণ দিয়েছি৷”যারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরছেন তাদের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ আছে কি না? জানতে চাইলে সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজ- সিডবিউসিএসের সভাপতি অধ্যাপক ইসরাত শামীম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিমানবন্দরে আমাদের অভিবাসন ডেস্কে যারা বসে আছেন তাদের সবাই পুরুষ৷ এমনকি হেল্প ডেস্কে যারা আছেন তারাও পুরুষ৷ তারা নারীদের সহায়তা দেবেন কীভাবে? আমরা সুপারিশ করেছি, এসব ডেস্কে আগে নারীদের বসাতে হবে৷ এই নারী অভিবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে৷ নিজেদের পরিবারেও স্বচ্ছলতা আনছেন৷ অথচ তারাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসছেন৷

সৌদি আরব পাঠিয়ে বিক্রি করা চক্রের পাঁচ জনকে গত শুক্রবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে৷  সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার খালেদুল হক হাওলাদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে ফিরে আসা কোন নারী যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করেন আমরা গুরুত্ব সহকারী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি৷ গত বছরের অক্টোবরে এক নারীকে উচ্চ বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সৌদি আরবে পাঠান চক্রের সদস্যরা৷ তাকে বলা হয়, সৌদি আরবে যেতে তাকে কোনো অর্থ খরচ করতে হবে না৷ তবে বিষয়টি পরিবারের কাউকে জানানো যাবে না৷ ওই নারীকে বলা হয়, সৌদি আরবে কোনো সমস্যা হলে দ্রুততম সময়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে৷ চক্রটির এমন প্রলোভনে পড়ে ওই নারী পরিবারের কাউকে না জানিয়ে নভেম্বরে সৌদি আরবে যান৷ সেখানে পাচার করে ওই নারীকে চার লাখ টাকায় একটি দালাল চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়৷ তাকে দাম্মাম এলাকার একটি বাসায় আটকে রেখে গৃহকর্মীর কাজে বাধ্য করা হয়৷ সেখানে তার ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ প্রায় তিন মাস পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেননি তিনি৷”

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আটক অবস্থায় থাকার একপর্যায়ে মোবাইল ফোনে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন৷ তখন স্বামীকে বিস্তারিত ঘটনা জানান৷ নারীর স্বামী ডায়নামিক স্টাফিং সার্ভিসেস ওভারসিজ লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করেন৷ তখন প্রতিষ্ঠানটি মুক্তিপণ হিসেবে তার কাছে চার লাখ টাকা দাবি করে৷ গত জুনে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে তিন দিনের মধ্যে ওই নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেওয়া হয়৷ তবে তাকে দেশে আনা হয়নি৷ এরপর তিনি আমাদের কাছে অভিযোগ করেন৷ দ্রুত আমরা ওই এজেন্সির পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছি৷আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যেই ওই নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে৷”

তবে বাংলাদেশ থেকে কতজন নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না৷ তবে ভারতে পাচার হওয়া প্রায় দুই হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম পাচারের শিকার ৬৭৫ জন নারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ১৬ থেকে ২০ বছরের কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি পাচারের শিকার হচ্ছে৷